ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র প্রয়াণ স্মরণে

রবীন্দ্রনাথের নারী চেতনা

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৪ আগস্ট ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের নারী চেতনা

সুবিশাল রবীন্দ্র প্রতিভার সৃজন এবং মননশীলতায় নারীর অবস্থান ছিল অত্যন্ত জোরাল এবং মানবিক বোধে উদ্দীপ্ত। তিনি মনে করতেন বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীকে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশমান ধারায় সম্পৃক্ত করতে না পারলে সামনে চলার গতি রুদ্ধ হয়, উন্নয়নের পথযাত্রা থমকে দাঁড়ায়। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, শোষণ, বঞ্চনা এবং মনুষ্যত্বের অপমান তাকে পীড়িত করে। সমাজের দুর্বল অংশ হিসেবে নারী জাতির অসম্মান, নিপীড়ন এবং অমর্যাদার বিরুদ্ধে বরাবরই তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি মনে করতেন সমাজের প্রায়ই অর্ধাংশ নারী জাতিকে স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত এবং সৃষ্টি ও কর্মযজ্ঞে যুক্ত করতে না পারলে সমাজের চলিষ্ণুতা থেমে যায়, সভ্যতার আলোয় অন্ধকার নেমে আসে। সাহিত্য সাধনার সুদীর্ঘ পথ যাত্রায় কবির ভাবনা, চেতনা কিংবা মনন সব সময় এক জায়গায় স্থির থাকেনি। সময়ের দাবিতে যুগের প্রয়োজনে তাঁর নারী চেতনার উত্তরণ ঘটে বিভিন্ন পর্যায়ে। সেটা বুঝতে হলে তৎকালীন উনিশ শতকীয় সমাজব্যবস্থার সঙ্গে কবির চিন্তা-চেতনার অবিচ্ছিন্নতাকেও তুলে আনা জরুরী। উনিশ শতকের সমৃদ্ধ যুগে জন্ম নেয়া কবি যে বিরাট ঐতিহ্যের স্বর্ণ অধ্যায়ে শৈশব, কৈশোর পার করে যৌবনে পা রাখেন সেখানে তাঁর মানস চেতনা সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে সেটাই স্বাভাবিক। যুগোত্তীর্ণ সৃষ্টিশীল ক্ষমতা কবিকে যেমন সমকালের ঐতিহ্য আতস্থ করায়, সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যিক চেতনাও তাকে অনুক্ষণ অনুপ্রাণিত করে। একইভাবে অল্প বয়সে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ তাঁর সৃজনী প্রতিভাকে নানাদিক থেকে পরিপূর্ণও করে। উনিশ শতকীয় নতুন আলোর প্রবহমান দীপ্তি। ঠাকুরবাড়ির স্বকীয় মহিমা, প্রাচীন সমাজের ভাবসম্পদ এবং বিদেশ সফরের বিরাট অভিজ্ঞতা কবির সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে, মহিমান্বিত করে সর্বোপরি কালকে অতিক্রম করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। সাহিত্যের বহুমাত্রিক আঙ্গিনায় সদর্প বিচরণ করতে গিয়ে সব সময় স্বপ্নালোকে কিংবা কল্পনাশ্রয়ী চেতনায় নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেননি। কঠিন জীবন, রূঢ় বাস্তবও তাঁর সৃষ্টিশীলতায় ভর করে, ভাবুক কবিকে সমাজ সচেতন করে। তাঁর সামগ্রিক এই ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নারী সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, কর্তব্যবোধ, নারীকে দেখার তীক্ষè ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি। ১৯৩৬ সালে ৭৫ বছর বয়সে ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ সংকলনের ‘নারী’ প্রবন্ধে নারী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবন লালন করা চিন্তা-চেতনা মূর্ত হয়ে ওঠে, যা তার নারী ভাবনার মৌলিকতা নির্দেশক। শুধু সৃজনশীলতাই নয়, ব্যক্তি জীবনেও নারী তাঁর কাছে ছিল কল্যাণময়ী সত্য, সুন্দরের চিরন্তন প্রতিনিধি এবং নারীর হৃদয়বৃত্তির অনুপম সৌন্দর্য শুদ্ধতা ও শুচিতার প্রতীক। অপরদিকে পুরুষের শক্তিময়তা, দাম্ভিকতা পৌরুষের প্রবৃত্তি কিন্তু সব ক্ষেত্রে মাঙ্গলিক নয়। বরীন্দ্রনাথের মতে, ‘পৃথিবীকে জীবের বাসযোগ্য করার জন্য অনেক যুগ গেছে ঢালাই-পেটাই করা মিস্ত্রির কাজে, সেটা আধখানা শেষ হতে না হতেই প্রকৃতি শুরু করলেন জীবন সৃষ্টি, পৃথিবীতে এল বেদনা। প্রাণ সাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছে নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীব পালনের সমস্ত প্রবৃত্তি জাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহমনের অন্তরে অন্তরে। এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেয়ে হৃদয় বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্তভাবে। এই সেই প্রবৃত্তি নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাঁথছে নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখার জন্য প্রেমে, স্নেহে, সকরুণ ধৈর্য। মানব সংসার গড়ে তোলার বেঁধে রাখার এই আদিম বাঁধুনী। এই সেই সংসার যা সকল সমাজের সকল সভ্যতার মূলভিত্তি। সমাজ বন্ধনের এই কাজটি মেয়েদের। নারীকে আরও ভাবেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পরম অনুভূতিতে যা তাঁর সাহিত্যে প্রতিটি নারী চরিত্রে দীপ্যমান। স্নেহে, মায়ায়, মমতায় নারী মাতা আর প্রেমে, পূজায়, নিবেদনে নারী প্রিয়া। এই ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর শৈল্পিক চৈতন্যের শুরু থেকে শেষ অবধি। নারীকে মানুষ ভাবার দৃঢ় প্রত্যয়ও তাঁর সৃজন ও মননে এক চিরস্থায়ী আদর্শিক বোধ। তাঁর মতে সভ্যতার যা কিছু অসঙ্গতি, দৈন্য, সঙ্কট তার অনেকটাই নারীর যথার্থ স্থানে অধিষ্ঠিত না হওয়ার ফলশ্রুতি। সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতিকে শৃঙ্খলিত, অধিকার বঞ্চিত এবং মর্যাদাহীনতায় আবদ্ধ করলে কোন সমাজ তথা সভ্যতার সুস্থ স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবেই। কবি আধুনিক স্বাধীনচেতা নারী বলতে যা বোঝান তা হলো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সুশিক্ষিত, বৃহত্তর কর্মযোগে তাদের যথাযথ ভূমিকা যা একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও বাঞ্ছনীয়। তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের নারীবিষয়ক যে অভিব্যক্তি সেখানে তিনি অনেকটাই ঐতিহ্যবাহী, সময়ের দাবিতে নবদিগন্তের বর্ণচ্ছটায় কিছুটা আধুনিক, বাকিটা দুই ধারার মিলিত প্রবাহে স্বকীয় চেতনার নির্মল, শৈল্পিক দ্যোতনা। তাঁর সাহিত্যের সর্বাংশ জুড়ে নারীর যে দৃপ্তমহিমা সুন্দর আর লাবণ্যের মিলিত সৌরভে সেখানে নারী একেবারে ঐতিহ্যিক শক্তি। জীবনের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ সত্তরোর্ধ কবির মননে সন্নিবেশিত হয় বিশ্বপরিসরে নারীর কর্মপ্রবাহ, আধুনিকতার বিস্তীর্ণ বলয়ে তাদের সৃষ্টিদ্যোতনা এবং এর সঙ্গে জোরালভাবে সংযুক্ত হয় বৈজ্ঞানিক চেতনা আর আবিষ্কারের নবোদ্যম। অর্থাৎ প্রাচীন সমাজের চিরায়ত প্রাচীর, নতুন সমাজের আধুনিকতার জয়মাল্য এবং দুই ধারাই যথার্থ সংযোজনে তাঁর নিজস্ববোধে চেতনায় নারীকে ভাবার ত্রিধারার যে স্পষ্ট অভিব্যক্তি সেটাই তাঁর সৃষ্টিশীলতা আর মানস ভাবনায় স্থায়ী ছাপ পড়ে। জীবনের শেষ প্রান্তেও এই ধারার ব্যত্যয় ঘটেনি। কালের প্রবাহে, সাহিত্যের আবেদনে, সৃষ্ট নায়িকাদের হরেক রকম টানাপোড়েনে ধারাগুলো ভিন্ন ভিন্ন আদলে উপস্থাপিত হয়, বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি না ঘটিয়ে চৈতন্যের ভাব সম্পদে সামনে কিংবা পেছনের দিকে যাওয়া-আসা করে মাত্র। মঙ্গল আর মাধুরীর অনুপম শৌর্যে লক্ষ্মী প্রতিমার অম্লান ঐশ্বর্যের কোন ব্যত্যয় তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যের পথযাত্রায় কখনও দৃশ্যমান হয়নি। নারী যে শুধু নারীই এ অভিমত ও দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×