ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৪ আগস্ট ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) নওরোজের আলো মার্চের ১৫ তারিখ নাগাদ আগ্রায় সুখবরটা উড়ে এলো। শাহজাদা সুলাইমানের বাহিনী বাংলার বিদ্রোহী সুবেদার শাহ সুজাকে বেনারসে পরাস্ত করেছেন। সুজার বিশাল নৌবহর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কেউ বলছে হাতির পিঠে আবার কেউ বলছে নৌকায় চড়ে সুজা পালিয়েছেন পাটনার দিকে। তা তিনি যেদিকেই যান, দিল্লীর বাদশাহ হবার শখ নিশ্চয় মিটে গেছে। মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে দাক্ষিণাত্যে অভিযানে যাওয়া মহারাজ যশোবন্ত সিংয়ের কাছেও খবর পাঠানো হয়েছে। আপোসনামা মেনে ফিরে না গেলে বেনারসে সুজা বাহিনীর যে দশা হয়েছে বাকি শাহজাদাদের ক্ষেত্রেও যেন তাই করা হয়। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়লো লাল কেল্লায়। উপস্থিত অমাত্যরা পালা করে সম্রাট শাহজাহান ও শাহজাদা দারাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছেন। একমাত্র শাহজাহানের ছোট কন্যা রওশন আরা ছাড়া বাকি সবাই খুশী সুলাইমানের বীরত্বে। রওশন আরা সন্দেহ পোষণ করছেন এই জয় সাময়িক। গোপন সংবাদে তিনি জেনেছেন সেনাপতি জয় সিং ইচ্ছাকৃতভাবে শাহ সুজাকে নিরাপদে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রাজনীতিতে অজ্ঞ সুলাইমান পিতার আজ্ঞা রক্ষা করতে এখন দৌড় ঝাঁপ করে সময় নষ্ট করবেন সুজার পেছনে। এই সুযোগ আওরঙ্গজেব হাত ছাড়া করবেন না। ঘটনা আঁচ করে আড়ালে মুখ টিপে হাসলেন ছোট শাহজাদী। শাহজাহান ঘোষণা দিলেন এই উপলক্ষে এবারের নওরোজ উৎসব ঘটা করে পালন করা হবে। মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হলো নওরোজ। পারস্য দেশের হাজার বছরের রীতি অনুযায়ী নতুন বছর শুরুর এই উৎসবটি সম্রাট বাবরের সময় হতে হিন্দুস্তানে প্রচলন শুরু করেছেন মুঘলরা। জাহান আরা ও হারেমের প্রধান খোজা বর্ষীয়ান ফিরুজ খান উৎসবের মূল দায়িত্ব নিলেন। প্রদীপ ও মোমের আলোয় সাজানো হয়েছে প্রতিটি মহল ও কেল্লার আনাচে কানাচে। পুঁতির মালা, দামী পাথর, মসলিন কাপড়, অলংকৃত তরবারি, কারুকাজময় কোমর-বন্ধনী, আরবী ঘোড়া, সুগন্ধি ইত্যাদি নানা রকম উপহার দেয়া হলো বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ উজির-নাজিরদের। হেরেমের বাইজী ও দাসী-বাঁদীরাও বাদ পড়লো না। সন্ধ্যা রাতে ফুরফুরে মেজাজে সুরা পানের ইচ্ছাপোষণ করলেন সম্রাট। কন্যা জাহান আরা চিকিৎসকের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বাধা দিলেন না। সম্রাটকে উৎসবের রঙে রাঙানো হতে বঞ্চিত করতে চাইলেন না জাহান আরা। ছোট বেলা হতে পরিমিত পান করার অভ্যাস তাঁর। মধ্য বয়সে সুরা পান ছেড়ে দিয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানে ভাঁড়ারে রাখা সমস্ত মদ চম্বল নদীতে ফেলে দেন। অনেক সভাসদ এই বিয়োগান্ত দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি। পরে অবশ্য মমতাজ বেগমের মৃত্যুর পর সন্ন্যাস ব্রত ত্যাগ করে আবার সুরা পান শুরু করেন সম্রাট। জাহান আরা পর্তুগাল থেকে আনা বিশেষ সুরা সম্রাটের সামনে পেশ করলেন। Ñএই চমৎকার রাতে আমরা বাপ-বেটি আরক পান করবো না? জিজ্ঞাসা করলেন সম্রাট। Ñনা আব্বাজান। পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা এই বিশেষ মদের পিপেটা উপহার দিয়ে গেছে। হাল্কা টক-মিষ্টির এই নতুন স্বাদ আপনার ভালো লাগতে পারে। মিষ্টি হেসে বললেন জাহান আরা। সম্রাট অল্প করে ঠোঁটে ছোঁয়ালেন পানীয়টি। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাসে ভিন দেশী সুরার ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলেন। তারপর একটু থেমে গোটা এক চুমুকে অর্ধেক খালি করে ফেললেন পানপাত্র। Ñমাশাল্লাহ! জিভ দিয়ে উপর নিচ দুই ঠোঁট চেটে পানীয়টির প্রশংসা করলেন সম্রাট। Ñধীরে আব্বাজান। এখনো রাত অনেক বাকি। আর আপনার শরীরটাও আগের মতো নেই। সাবধানে খানা-পিনা করুন। মনে নেই বুজুর্গ হাফিজ কি বলে গেছেন? -কি বলেছেন তিনি? আরেক চুমুক দিয়ে জানতে চাইলেন শাহজাহান। -‘হাফিজ তোমার বয়স হলো, ভুলে যাও শরাবখানা। নষ্টামি আর মদের স্বাদ, যৌবন ফুরালে আর পাবে না’। বহুত খুব! কিন্তু বুড়ো বাপকে আর কতো পেরেশান করবে বেটি? কতোই বা আমার বয়স হলো বলো? কন্যার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করলেন বৃদ্ধ সম্রাট। আচ্ছা বাদ দিন। আপনার আনন্দ মাটি করতে চাই না। বরং আমাদের বড় দাদাজান মহামতি বাবরের প্রথম বেগম সম্পর্কে কিছু বলুন। পূর্ব পুরুষের ইতিহাস জানতে জাহান আরার অনেক আগ্রহ। শুনতে রূপকথার মতো লাগে তাঁর। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবেন সম্রাট। তারপর বলতে থাকলেন। আপন চাচাত বোন আয়েশা সুলতানা বেগমকে বিয়ে করেছিলেন বাবর। কিন্তু তাঁদের সংসার স্থায়ী ও সুখের হলো না। বিয়ে টিকেছিল মাত্র চার বছর। তারপর? আয়েশার বাবা সুলতান আহমদ মীর্জা ছিলেন সামারখন্দ ও বুখারা এলাকার সুলতান। বাবরের বয়স যখন পাঁচ বছর তখনই সদ্য জন্মানো আয়েশা’র সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা পারিবারিকভাবে পাকাপাকি করা হয়। এর এগারো বছর পর তাঁদের শাদী মোবারক হলেও বাবর নববধূকে সব সময় লজ্জা পেতেন। কোনভাবেই আয়েশা বেগমের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইতেন না কিংবা পারতেন না। বাবরনামায় পড়েছিলাম তাঁর নাকি তখন অনুরাগ জন্মেছিল স্থানীয় বাজারে দেখা এক বালকের প্রতি। নাম তার বাবুরি। ঠিক তাই। মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলেন শাহজাহান। বাবরের আম্মাজান নারী জাতির প্রতি পুত্রের নিষ্পৃহতা লক্ষ্য করে খুব দুঃখ পেলেন। বকাঝকা করে জোর করে নতুন বৌ-এর ঘরে ঠেলে পাঠাতে লাগলেন বাবরকে। কখনো প্রতি মাসে একবার বা চল্লিশ দিন পর তিনি নববধূকে দেখতে যেতেন। তাঁর ভীষণ লজ্জা ও সংকোচ হতো। সুতরাং যা হবার তাই হলো। অসম্পূর্ণ অসচেতন ধাক্কাধাক্কির মেলামেশায় একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিলেও ফখরুন্নেসা নামের সেই অভাগা সন্তানটি জন্মের এক মাসের মাথায় মারা যায়। বাবরের প্রতি সমকামিতা ও নপুংশকতার মিথ্যে অভিযোগ তুলে আয়েশা বিবি পালিয়ে গেলেন। বিয়েটিও ভেঙ্গে যায়। একটু দম নিলেন সম্রাট। পর্তুগীজ সুরায় চুমুক দিতে দিতে বললেন, বাবুরি নামের প্রেমিক বালকটিকে উৎসর্গ করে কি তিনি লিখেছিলেন জানো? নিশ্চয় কোন প্রেমের কবিতা? জাহান আরা অবাক হন না। ‘আমার মতো বিক্ষিপ্ত ও বিধ্বস্ত প্রেমিক যেন কেউ না হয়, তোমার মতো নিষ্করুণ ও নিষ্পৃহ প্রেমিকও যেন কেউ না হয়।’ মারহাবা! অপূর্ব কবিতা। মনে মনে প্রতিটি শব্দ মুখস্থ করে নিলেন জাহান আরা। রাতের প্রথম প্রহরে কেল্লার প্রধান ফটক আকবরী দরজার সামনে কামানের তোপ দাগানোর শব্দে বাপ-বেটির খোশগল্পে ছেদ পড়লো। সেই শব্দে অজানা আশঙ্কার ছায়া পড়লো শাহজাহানের চোখে। নওরোজের আলো সেই দুশ্চিন্তার ছায়া মুছে দিতে পারলো না। পিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে জাহান আরা নিজেও অনুধাবন করলেন আগামী নওরোজ হবে অন্য রকম। (চলবে)
×