বিস্তর আলোচিত হয়েছে, জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রজা-পীড়ক ছিলেন কিনা? বাদীপক্ষ যেমন, তেমনি বিবাদীপক্ষও পাহাড় প্রমাণ তথ্য, যুক্তি-তর্কÑ সবই হাজির করেছেন।
আমরা যদি এই উভয়পক্ষের কথাগুলো শুনি এবং তা নিয়ে বিশ্লেষণে বসিÑ তাতে কী পেতে পারি, সেই চেষ্টাটাই করি না কেন!
প্রথমেই দেখে নেয়া যাকÑ রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারি পেলেনÑ তখন তাঁর উপর দায়িত্বটা কেমন ছিল?
এই চাপটা নেহাৎ কম নয়Ñ কেননা দায়িত্ব পাওয়ার সময়ই কবির কাঁধে চেপেছিল জমিদারি পাওয়ার দু’বছর আগের অর্থাৎ ১৮৯৪ সালের বার্ষিক ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার খরচের বোঝা।
তথ্য বলছে : ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পাওয়ার অব এ্যাটর্নির মাধ্যমে সমগ্র জমিদারি সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথের উপর ন্যস্ত করেন। এই সম্পর্কিত একটি চিঠি পাওয়া যায়Ñ যেখানে মহর্ষি রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখছেন :
‘এইক্ষণে তুমি জমিদারির কার্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও। তোমার কার্যে তৎপরতা ও বিচক্ষণতা আমার প্রতীতী হইলে আমি তোমাকে মফঃস্বলে থাকিয়া কার্য করিবার ভার অর্পণ করিব।’
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের হাতে জমিদারি থাকবে কি থাকবে নাÑ এই বিষয়ে তাঁর উপর ওই বার্ষিক খরচের জোগান সামলানোর চাপ ছিলই।
এবার দেখে নেয়া যাক সেই সময় ঠাকুর স্টেটের আয়-ব্যয় কেমন ছিল।
১৮৯৪ সালের ঠাকুর স্টেটের জমাখরচের হিসাবে দেখা যায় :
মোট আয়Ñ ২ লাখ ৩৪ হাজার ২ শত ৭৫ টাকা ৫০ পয়সা। আর খরচÑ ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৫ টাকার মতো। সেইমতো উদ্বৃত্ত টাকার পরিমাণÑ পাঁচ হাজার টাকার কাছাকাছি।
শিক্ষানবিশ হিসেবে জমিদারি পরিচালনার ছয় বছরের মাথায়, অর্থাৎ ১৮৯৯ খ্রি. মহর্ষি শেষ উইল করেন। সেখানে জমিদারির আয় থেকে সমস্ত শরিকদের বার্ষিক পাওনা বাবদ খরচ ছিল মোট ৯৭ হাজার ৪০০ টাকা, এর সঙ্গে সরকারের ট্যাক্স বাবদ ৫০ হাজার টাকা মোট খরচ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ শ’ টাকা। সেই সঙ্গে স্টেটের কর্মচারীর বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ১৮৯৪ সালের খরচ নিশ্চয় বেড়েছিল।
অর্থাৎ শিক্ষানবিশের ৬ বছরের মাথায় এই বিপুল আর্থিক দায় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এককভাবে জমিদারির গদিতে বসেন।
মনে রাখতে হবে এই সমগ্র আয়ের একটা বড় অংশ আসত প্রজাদের থেকে আদায় করা খাজনা বাবদ। আর কিছু অন্যান্য ব্যবসার আয় থেকে।
এখন কথা হল জমিদারি আয়ের মুখ্য উৎস যখন প্রজাদের প্রদেয় খাজনা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑ এই বিপুল খরচের আদায়ের ব্যাপারে প্রজাদের ওপর কমবেশি জুলুম কি-না হয়ে থাকত?
তথ্য কিন্তু তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। অমিতাভ চৌধুরী তাঁর ‘জমিদার রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে লিখছেন : ‘এমন কথাও শোনা যায় যে, ঠাকুর স্টেটের আমলাদের বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ, নানা রকম অসন্তোষ জমা হচ্ছিল প্রজাদের পক্ষ থেকে এবং জমিদারি সংলগ্ন কুমারখালীর মনীষী হরিনাথ মজুমদারের (কাঙাল হরিনাথ) কাগজ ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় (গ্রাম বাংলা থেকে প্রথম প্রকাশিত একমাত্র নির্ভীক সংবাদপত্র। যার গ্রাহক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ) সেই সব অসন্তোষের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছিল।’
এখন কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নেবার পরও কি এই সব অত্যাচার অব্যহত ছিল? নাকি তিনি তা দমন করে ‘প্রজা দরদী’ জমিদার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন?
এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সেই সময়কার কলকাতার একশ্রেণীর মানুষÑ এই বলে সোচ্চার হয়েছিলেন যে, জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অত্যাচারী ছিলেন, প্রজাদের ভাতে মেরে নিজের পরিবারের ভা-ার ভরাট করেছিলেন। তাঁর জমিদারি এলাকার বহু মানুষও এমন প্রচার করতেন।
এই প্রচারের কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেও উল্লেখ করেছেন : ‘লোকে অনেক সময়ই আমার সম্বন্ধে সমালোচনা করে ঘরগড়া মত নিয়ে। বলে, ‘উনি তো ধনীর ঘরের ছেলে। পল্লীগ্রামের কথা উনি কি জানেন।’এই তথ্য যদি ‘শোষক জমিদার’Ñ এই পক্ষে যায় তো, পাল্টা তথ্যও হাজির করেছেন কবি-পক্ষের মানুষেরা।
তারা ‘পুণ্যাহ’ ঘটনাকে তুলে এনে দেখিয়ে দেবেন যে, জমিদার অভিষেকের প্রথম দিনেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রজা দরদী’ মনোভাবকে যথেষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। (আগ্রহী পাঠকরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেনÑ শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কর্মচারী শচীন অধিকারীর লেখা ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে।
এই ঘটনাটিকে সামনে রেখে এবং বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আর একটি তৃতীয় গোষ্ঠী রবীন্দ্র-জমিদার চরিত্রের ব্যক্তি-কূটৈষণার দিকটি তুলে ধরেছন। তাদের ব্যাখ্যাÑ এই ঘটনা এ কথা বলে যে, পুণ্যাহতে রবীন্দ্রনাথ যা করেছেন, তা দেখে মনে হতে পারেÑ তিনি যথার্থই আমলা-বিরোধী এবং প্রজা-দরদী জমিদার ছিলেন। এটা রবীন্দ্রনাথের বাইরের একটা ‘ছদ্ম’ দিক। তারা মনে করেনÑ এই উপরসা উদারতার অন্তরালে ছিল জমিদারি ‘কায়েমি স্বার্থ’ রক্ষার জন্য ‘জমিদারি-ডিপ্লোমেটিক’ একটা কৌশল। অর্থাৎ ‘প্রজাদরদী’ মুখোশের আড়ালে থেকে তিনি আসলে জমিদারি স্বার্থকেই রক্ষা করে গেছেন।
তারা তাদের মতো প্রতিষ্ঠিত করতে উল্লেখ করেছেন—শুধু কলকাতা শহরের মানুষেরা তো নয়, কবির প্রজাবর্গের মধ্যেও এই নিয়ে বিস্তর অসন্তোষ লেগে ছিলই।
এই মতকে খ-ন করেছেন রবীন্দ্র পক্ষকারীরা। তারা যুক্তি ও তথ্য তুলে ধরে দেখিয়েছেন যেÑ প্রজাবর্গের মধ্যে যারা জমিদার-রবীন্দ্রনাথের বিরোধী ছিলেন, তারা এলাকার সুদখোর সম্পন্ন মহাজন ও তাদের স্বার্থ-দেখভালকারী জমিদারের আমলারা।
তাদের এই যুক্তির সপক্ষে রয়েছে ‘রবীন্দ্র-ইতিহাস’ জগতে ‘কবি-কৃত’ একটি বিতর্কিত মন্তব্য। পুণ্যাহের দিনে কবি যে ‘সমাসনের’ জন্য জিদ ধরে আমলাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেছিলেন : ‘জমিদারির প্রাচীন প্রথা আমি বুঝি না, সবার একাসন করতে হবে। জমিদার হিসেবে এই আমার প্রথম হুকুম।’ সেদিন জমিদারের মুখে এমন বিরল-কথা ও দরদী আচরণে দরিদ্র প্রজারা খুশি হলেও বিরক্ত হয়েছিলেন ‘মানী মহাজন’দের সঙ্গে আমলারাও। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও সেদিন বুঝেগিয়েছিলেন তাঁর লড়াইটা কাদের সঙ্গে। আর সেটা বুঝতে পেরে তিনি একটি ‘অসতর্ক-বিতর্কিত’ সংকল্প ঘোষণা করে বললেন : ‘সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে। এটাই আমার সর্ব প্রধান কাজ।’Ñ এই বিতর্কিত মন্তব্যের একটা ব্যাখা দিয়েছেন অমিতাভ চৌধুরী। তিনি বলছেন : ‘সাহা’ বলতে রবীন্দ্রনাথ কোন জাতিকে বোঝাননি। ‘শেখ’ বলতেও তা নয়। যেহেতু তাঁর জমিদারিতে অধিকাংশ মহাজনই সাহা সম্প্রদায়ের হিন্দু, সেই জন্যই মহাজন অর্থে তিনি ‘সাহা’ শব্দের ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জমিদারিতে অধিকাংশ দরিদ্র প্রজাই মুসলমান। তাই ‘শেখ’ বলতে তিনি দরিদ্র প্রজাদেরই বুঝিয়েছেন।’
এসব আলোচনা পরিসরের শেষ পর্বে এসে আমরা যদি ‘খোলামনে’ দেখি, তাহলে এটাই প্রতীয়মান হয়, যে ‘শোষক-জমিদার রবিকবি’ শিরোনামটি যথেষ্ট আপেক্ষিক।
পরিশেষে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ‘জমিদারিত্ব’ প্রসঙ্গে জমিদার-কবি নিজে তার কোন্ ‘মনোসামাজিক’ (চংুপযড়-ংড়পরধষ) অবস্থানে ছিলেন? এই জিজ্ঞাসার উত্তরের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে তাঁর নিজস্ব কিছু ভাবনা ও মন্তব্যের দিকে লক্ষ্য রাখলে।
এই ক্ষুদ্র পরিসরে দু’একটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে এবং তা উল্লেখ করে নিবন্ধ শেষ করব।
ধরা যাক ইন্দিরাদেবীকে লেখা একটা চিঠির অংশ, যেখানে ধরা পড়েছে প্রজাবর্গের সম্পর্কে কবি-মনের এক অনবদ্য চিত্র।
পতিসর থেকে লেখা এই চিঠিতে লিখছেন : ‘এখানকার প্রজাদের উপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এদের কোনরকম কষ্ট দিতে আদপে ইচ্ছে করে না। (প্রজারা) যখন তুমি বলতে বলতে তুই বলে ওঠে, যখন আমাকে ধমকায়, তখন ভারি মিষ্টি লাগে।‘ (পৃথিবীর আর কোন জমিদারকে দেখতে পাওয়া যায়নি, যাকে প্রজারা ‘তুই’ বলে ‘ধমকায়’)।
এ রকম আর একটি চিঠি, যেখানে ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন : ‘আহা, এমন প্রজা আমি দেখিনিÑ এদের অকৃত্রিম ভালবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে। বাস্তবিক, এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক।’
এ রকম আর একটি চিঠির উল্লেখ করব, যেটি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে জমিদারি পাওয়ার কালে ১৯৩০ সালে লিখেছেন : ‘জমিদার-ব্যবসায়ে আমার লজ্জা বোধ হয়। আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে নিচে এসে বসেছে। দুঃখ এই যে, ছেলে বেলা থেকে পরোজীবী হয়ে মানুষ হয়েছি।’
(বিশ্বের শোষণবাদী জমিদার সমাজে প্রজাদের জন্য দু’ফোটা চোখের জল আর কোন্ জমিদারের চোখে দেখা গেছে?)
পাছে এই সব স্ব-ভাবনা নিয়ে বিতর্ক না হয়Ñ সে জন্য রবীন্দ্র-মনোসমীক্ষণের ভার ঢ়ংুপযড়-ধহধষুংঃ দের উপর ভরসা রেখে নিবন্ধটি শেষ করছি।