ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গওহর গালিব

ঔপনিবেশিক মন ও রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৪ আগস্ট ২০১৭

ঔপনিবেশিক মন ও রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার

ঊনবিংশ শতাব্দীর যে পর্বে রবীন্দ্রনাথের মানসজগৎ গড়ে উঠছিল তখনও বাংলার তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতার তুলনায় একেবারেই ভিন্নমাত্রার সদ্যাগত ইউরোপীয় জীবনবোধের সঙ্গে পুনরুজ্জীবনবাদী গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শের দ্বন্দ্ব চলছিল। এই সময়ে নতুন যুগের পক্ষে চিন্তাচেতনার ভিত রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ নমস্য ব্যক্তিবর্গ। সেই অর্থে ‘রবীন্দ্রনাথ রামমোহন-ডিরোজিও-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-মাইকেলের যোগ্যতম উত্তরসূরি এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁসের সর্বোৎকৃষ্ট ফসল।’ সুতরাং রামমোহন বিদ্যাসাগররা সময়ের যে নতুন মশাল জ্বালিয়েছিলেন, তা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এসে বর্তাল রবীন্দ্রনাথের হাতে। রবীন্দ্রনাথ তা সার্থকভাবে পালন করতে পেরেছিলেনও বটে। রামমোহন-ডিরোজিও-বিদ্যাসাগরদের মূলত ধর্মীয় নেতা ও সমাজপতিদের সঙ্গে লড়াই করেই জীবনপাত করতে হয়েছে। তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না নতুন সময়ের উপযোগী দর্শন, সাহিত্যশিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং জীবনাচরণের খুঁটিনাটি দাঁড় করানো, ক্রমে তাতে সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও অভিষিক্ত করা। মোটকথা সূচিত নতুন সময়কে সার্থকতা দানের কাজটি ছিল সাধনার মতো। সে-দায় স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই সাহিত্য দিয়ে সমাজ সংস্কার কিংবা সাহিত্যকে সাধারণের কল্যাণে নিয়ে যাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে করতে হয়েছে ভিন্নপথের সূচনা। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়– ‘রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যকে দেখতে হবে বাংলা সাহিত্যের, বাঙালী জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে। তার প্রথম কারণ এই যে কথাসাহিত্যে দেশকালের প্রভাব খুব প্রবল; তা ভূগোল নির্ভর, ইতিহাসে বিন্যস্ত।...কিন্তু তাঁর উন্মেষের সময় গদ্য ছিল অপরিণত; উপন্যাস সদ্যোজাত এবং ছোটগল্প নামক পদার্থের অস্তিত্ব ছিল না। লিখতে লিখতে ভাষা তৈরি করতে হয়েছে তাঁকে, গড়তে হয়েছে নতুন রূপ, নতুন রীতি; বাংলা গদ্যের যোজনব্যাপী পরিণতি এক জীবনে তিনি সমাধা করেছেন। এক জীবনে, কিন্তু ধীরে।’ এভাবে ব্রিটিশশাসিত সমাজ বাস্তবতায় নতুন এক গদ্য হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন বাংলা ছোটগল্পের সুউচ্চ দুর্গ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বকীয়তা চিহ্নিত করতে গিয়ে বলা যায় বাংলা সাহিত্যে গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধে তিনি পূর্বসূরীদের কাছ থেকে একটা উত্তরাধিকার পেলেও, ছোটগল্পের ক্ষেত্রে ছিলেন প্রথম পুরুষ। দীর্ঘ জীবনে নানা বিষয়ে বিবিধ আঙ্গিকে সাহিত্যচর্চা করলেও বাংলা ছোটগল্পের সফল স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সমধিক পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্প লেখা শুরু করলেন সেই সময়ে, যখন গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের তরী চলছে পালে পূর্ণ হাওয়া লাগিয়ে। ব্রিটিশ কালপর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পে ঔপনিবেশিক বাস্তবতার স্বরূপটি উন্মোচিত হয়ে আছে; যার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, দেশ ও সংস্কৃতি, সর্বোপরি ইংরেজ শাসন ও শোষণের ইতিহাস আবিষ্কার করা সম্ভব। এ সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথের মানসজগৎ গড়ে উঠেছিল দুটি ভিন্ন ধারায়। একদিকে ভারতবর্ষের হাজার বছরের সাধু-সন্ত ও প্রকৃতবাদী জীবনাচারের দীর্ঘ ইতিহাসের উত্তরাধিকার, অন্যদিকে ইংরেজদের আগমন উপলক্ষে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভিঘাত। অর্থাৎ সে-সময়ে ‘উনিশ শতকের প্রথম পর্বে বাঙালী বুদ্ধিজীবীর বিকাশ আরম্ভ হয়েছিল দুটি স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট ধারায়–একটি ধারা দেশীয় ঐতিহ্যের আর একটি ধারা পাশ্চাত্য আদর্শের অনুগামী।’ এ দ্বিবিধ নিয়ামকের নির্যাস বিচ্ছুরিত হতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের রচনায় বিশেষত ছোটগল্পে। ‘যে গল্প রবীন্দ্রনাথকে প্রথম শ্রেণীর গল্পলেখকের খ্যাতি দিল তা হিতবাদীতে প্রকাশিত ‘পোস্টমাস্টার’। ছোটগল্পের সব অনিবার্য লক্ষণ এতে আছে: পরিমিতিবোধ, অনিবার্যগতি, ঘটনা ও চরিত্রের স্বল্পতা, একাগ্র পরিণামমুখিতা ও ‘শিল্পীর নিরাসক্তি’। শুধু তাই নয় এ পর্বেই নাগরিক আভিজাত্যের তুঙ্গশিখর ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ নেমে এসেছেন পল্লীবঙ্গের বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে। ফলে ঔপনিবেশিক চাকচিক্যে ভরপুর কলকাতা থেকে নাগরিক সুবিধায় পুষ্ট ব্যক্তিমানুষকে অকস্মাৎ বিচ্ছিন্ন করলে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে তা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। আর এই অভিজ্ঞতার চেতনাস্পর্শী সৃষ্টিই হলো ‘পোস্টমাস্টা’র গল্পের পোস্টমাস্টার চরিত্রটি। গল্পের কাহিনীতে দেখা যায় উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারের কর্মজীবনের সূত্রপাত। নাগরিক পরিবেশ ছেড়ে কলকাতাবাসী পোস্টমাস্টার এর আগে কখনও স্থায়ীভাবে গ্রামে বাস করেনি। তাই ডাঙ্গায় তোলা জলের মাছের মতোই গ-গ্রামে তাঁর ‘আধমরা’ অবস্থা। ‘প্রবাস’, ‘ঘোর প্রবাস’, ‘নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাস’Ñ এই ধরনের অভিব্যক্তি পোস্টমাস্টারের প্রেক্ষণবিন্দু থেকে বার বার সমস্ত গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। কলকাতার ছেলে পল্লীগ্রামে কারও সঙ্গে ভাল করে মিশতে জানে না, সেই অর্থে কাজ না থাকায় দু’একটি কবিতা লিখে যার একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টা, জোর করে যে গ্রামের প্রকৃতির সান্নিধ্যে মন প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করেÑ তার অন্তরের সত্যিকার বাসনা কী সে-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানাচ্ছেনÑ ‘কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোন দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলি কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।’ এই মনোভাবনা প্রমাণ করে কলকাতায় বসবাসরত নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে ঔপনিবেশিক মানসিকতা কত গভীরে প্রবিষ্ট হয়েছিল। নাগরিক সুবিধায় বেড়ে ওঠা যুবক পোস্টামাস্টারের কেন পল্লীর কর্মসংস্থানে বীতশ্রদ্ধভাব জাগবে এর উত্তর পাই যখন দেখি ঔপনিবেশিক শোষণে জর্জরিত গ্রামে তার কর্মস্থলের ছবিটি দৃশ্যত এমন ‘একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাহার আপিস; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল।’ গল্পে আরও দেখি অখ্যাত গ্রামের অতিমন্থরগতির জীবনস্রোতে ‘রতন’ নামের একটি বালিকা পোস্টমাস্টারের একমাত্র মানসিক অবলম্বন সঙ্গী। সেবাকারিণী পিতৃমাতৃহীন ত্রয়োদশী রতন অনেক কর্মহীন দুপুরে আর নিস্তব্ধ রজনীতে পোস্টমাস্টারের একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। অচিরেই পরিচারিকা রতন সেবাকারিণী, ভগিনী ও জননীর পদে অধিষ্ঠিতা হয়ে রোগশয্যাশায়িত পোস্টমাস্টারকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু স্বল্পতর বেতন ও তদুপরি স্বল্প কর্মভারে ক্লান্ত উদ্যমহীন পোস্টমাস্টার কলকাতায় ফেরার আকুলতায় ব্যাকুল। তাই সে রতনের ভালবাসাকে বুঝতেই পারেনি এবং রতনের ‘দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে ?’Ñ এ বাক্যালাপ হেসেই উড়িয়ে দেয়। বিদায় বেলায় তার পা ধরে ক্রন্দনরত রতনের হৃদয়ের আকুতিকে উপেক্ষা করে পোস্টমাস্টারকে আমরা কলকাতাগামী নৌকায় উঠতে দেখি। নৌকায় একবার পিতৃমাতৃহীন রতনের জন্য তার ফেরার চিন্তা মনে হলেও সচেতন মস্তিষ্কে উদয় হয় এক নতুন তত্ত্বের, ‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার!’ এ বক্তব্য, এ তত্ত্ব কেবল নদীর চোখে তীরের গল্প নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। এই বেশি কিছুই ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতার মূল ধুঁয়ো ধ্বনি।’ ‘পৃথিবীতে কে কাহার’ এ দর্শন তাদের দ্বারাই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব যারা আত্মসর্বস্ব আত্মমগ্ন চিন্তায় সর্বদাই ব্যাকুল। তাই আমাদের পোস্টমাস্টারের মধ্যে এ চারিত্র্যিক লক্ষণ থাকা খুবই স্বাভাবিক কারণ ‘এ দেশে সদ্য-আগত ইউরোপীয় সভ্যতার অসম রশ্মিপাতে তৈরি উপনিবেশের অধীন কলকাতা নগরে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।’ পোস্টমাস্টার গল্পটির সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন বাঙালী সমাজ-মানসে যে অভিঘাতের সূচনা করে তার বৈপ্লবিক তাৎপর্য উপলব্ধি করার মধ্যদিয়ে কলোনিশাসিত ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের এবং তৎকালীন শিল্পসাহিত্যের রূপ-রস-গন্ধের সম্যক পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে অবস্থা ও ব্যবস্থা ইংরেজ শক্তিকে প্রভুর আসনে বসতে সাহায্য করেছিল এবং শক্তির মূলে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছিল মূলত তার প্রভাবেই কলকাতা নগর শাসক ও শাসিতের প্রধানতম তীর্থস্থানে পরিণত হয়। কলোনিশাসিত সেই সময়ে নগর কলকাতা বাঙালীর জীবনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তার সারাৎসার সম্পর্কে বলা যায়– ‘ইংরেজ-আধিপত্যের পরে কলকাতার গুরুত্ব এবং ইংরেজীর গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি হওয়ার ফলে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলায় নতুন এক সংস্কৃতির গোড়াপত্তন হয়। সমাজে ধনিক-বণিকের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, সমাজের মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্রটি শিথিল হতে থাকে। রাজশক্তি বিদেশী ইংরেজ। ধনিক-বণিকের সম্মানই তাদের কাছে বেশি। রাজা যাকে সম্মান করেনÑ সমাজে তারই মর্যাদা ও শক্তি বেশি। ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারাই যেখানে স্বার্থসিদ্ধির উপায়, সেখানে ইংরেজী আদব কায়দার অনুকরণ না হয়ে পারে না।’ এভাবেই বাঙালী জীবন ও সংস্কৃতি কলোনিশাসিত সমাজ বাস্তবতায় পরিবর্তিত হয়ে পাশ্চাত্য অভিমুখে এক ভিন্নসুরে ধাবিত হতে থাকে।
×