ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পঋদ্ধ গল্পের কারিগর

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৪ আগস্ট ২০১৭

শিল্পঋদ্ধ গল্পের কারিগর

একুশ শতকের গোড়ার দিকে গল্পের ভুবনে এক সম্মোহনী শক্তি নিয়ে হাজির হলেন গল্পকার নাজিব ওয়াদুদ (জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬১)। হাতে করে নিয়ে এলেন ‘কাক ও কারফিউ’। সালতামামির শিরায়ত হীরক মুকুটে তখন খোদিত আছে ১৯৯৮ সাল। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কাক ও কারফিউ’র ক্ষেত্র যেভাবে উপস্থাপন হয়েছে তাকে কোনওভাবেই ভ্যানগগ, মুকবুল ফিদা হুসেন কিংবা এস. এম. সুলতানের চিত্রশিল্প থেকে আলাদা করা যায় না। গ্রামীণ জীবনের জৈবিক সাংঘর্ষিক গূঢ়তা, মাটি মানুষের ভেতরের সূক্ষ্মতা, আত্মশ্লাঘার সমাবর্তনীয় সনদ কিংবা নর-নারীর কামজ কামনার কোলাজ কলাপসিবল আকারে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গল্পে। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কাক’ ১৯৮৯ সালে প্রকাশ পায়, যখন জাতির প্রত্যাশার আকাশে নানা রকম অপ্রাপ্তি আর হতাশার বীজ দানা বেঁধে একটু একটু করে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারী শাসকের শোষণ নিপীড়নের প্রেক্ষাপটটি গল্পের প্রধান চরিত্র বুড়ির আত্মকথনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ভূমিগ্রাসী নারী-লোলুপ জফির গল্পে স্বৈরাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ গল্পে যেমন উৎপ্রাস দেখানো হয়েছে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে, তেমনি উৎপ্রেক্ষাও এসেছেÑ ‘খিচুড়ির খোশবু ছুটছে বাতাসে। মাঝে মধ্যে নাক দিয়ে গলা বেয়ে পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ে’। আর উপমার ব্যবহারের মুন্সিয়ানা মোকাম্মেল রাখতে পেরেছেন তাঁর প্রতিটি গল্পেÑ ‘বুড়ির শুকনো বাদামের মতো ঠসঠসে শরীরেও ঘামের তরল আঠা’, অথবা ‘আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ গাঢ় নীলে কাশফুলের গোছার মতো ভাসছে’। মোট আটটি গল্পের সংকলনে পুরো গ্রন্থটি জুড়েই রয়েছে গ্রামীণ জীবনযাত্রার জোয়ার-ভাটা, আর নিত্যকার রোজনামচা একেবারে আঞ্চলিক ভাষায় উঠে এসেছে এবং এখানেই গল্পকারের জটিল ভাষা থেকে সরে আসার স্বতঃসিদ্ধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় গল্প ‘মেঘ ভাঙা রোদ’, যে গল্পে লেখক তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে অন্তরে যে স্বাধীনতার সাজুয্য এসে শামিল হয়েছিল তাই তুলে ধরেছেন গল্পের প্রধান চরিত্র রমিজের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আত্মরক্ষা ও পররক্ষার দোলাচলে দুলিত মানুষের অবস্থা কেমন হয় এ গল্পে তারই দেখা মেলে। নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে তারপর অন্যের প্রাণ রক্ষার্থে রমিজ প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু মা আর অর্ধাঙ্গিনীকে রক্ষা করতে পারেনি, অপর দিকে রমিজের পিতা তমিজুদ্দীনের চরিত্রের মাধ্যমে পরিস্থিতির শিকার একটা অসহায় অবস্থা যে ঘৃণ্যতার অনলে কতটা পোড়াতে পারে তা এখানে অসাধারণ শিল্পগুণে ফুটে উঠেছে। তৎকালীন রাজনীতির অঙ্গার এ গল্পে কিছুটা আঁচ কাটলেও লেখক রমিজের প্রতিবাদ প্রজ্ঞার দিকে জোর দিয়ে স্বাধীনতাকেই সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। অনুগল্পের আকারে লেখা ‘অন্ধগলি’তে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টায় গল্পাকার আপন রক্ত বেচা টাকা নিয়ে অন্ধগলির ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছেন। গল্পকার তার মেসেজকে শিল্পবোধ ও ইনটেলেকচুয়াল প্রকাশভঙির সাহায্যে উপাখ্যানের রৈখিক প্লটকে জৈবনিক সূত্রে গেঁথে দিয়েছেন। গল্পের চরিত্র পরিক্রমায় গ্রামীণ প্রতিচ্ছবি ঘুরে ঘুরে আসার প্রপেনসিটি গল্পকে অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী করেছে। শক্তিমান লেখক আবু রুশদ-এর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লগ্নকে কেন্দ্র করে রচিত ‘নোঙর’-এর মতো বিদগ্ধ, বুদ্ধিযোগী সুচারু শিল্পীসত্তার অধিকারী সাহিত্যিক নাজিব ওয়াদুদও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মুক্তির প্রাক্কালে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষাকে দেখিয়েছেন ‘কারফিউ’ গল্পে। স্বৈরতন্ত্রের ধ্বংস এবং গণতন্ত্রের মুক্তির স্ফুরণ গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সখিনার জীবনে কারফিউ ভাঙার ভাষ্য ভুবনজোড়া আঙরনে এখানে ফুটে উঠেছে। ‘পরনে তেনা শাড়ি, ব্লাউজহীন অঙ্গে নখের আঁচড়, কচি ঠোঁটে পীড়নের বিষ’ এসব যন্ত্রণা ছাড়িয়ে এ পৃথিবীর নাগালের বাইরে যেতে চেয়েছিল সখিনা কিন্তু মানুষ সে, তাই পারে না। আধুনিক জীবনধারায় গণতন্ত্রের মুক্ত বাতাস লাগলেও কোথায় যেন এখনও গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হয়ে আছে যে অবরুদ্ধ দেয়াল ভাঙার প্রয়াস করেছেন আনোয়ার পাশা তার ‘সন্ধানী নীড়’ নিশুতি রাতের কথা’ কিংবা’ রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসে। গ্রাম্য উপজীব্যতার ভেতর দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে যেমন কথার শিল্পতরী ভাসিয়েছেন তেমনি গল্পকার নাজিব ওয়াদুদও খানিকটা একই ধারার আলেখ্য আলোচনায় রাজনীতির মতনৈক্য ও দ্বন্দ্ব থেকে সরে এসে মুক্ত হৃদয় চেতনাকে প্রতিষ্ঠা দেবার লক্ষ্যে রোকন-মিলির পড়–য়া চরিত্রের অবতারণা করেছেন ‘বৃত্ত’ নামক গল্পে। লেখক এখানে তার লেখক সত্তার ষোলো আনা মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। জীবন যে একই বৃত্তে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচালিত হচ্ছে তাই সংসার সংস্কৃতির বৃত্তে উঠে এসেছে। জীবন সংগ্রামের মাইক্রো এনালিসিস তাঁর গল্পে যেভাবে এসেছে তিনি যে কথাশিল্পের অঞ্জন সাহিত্য নয়নে আঁকতে পেরেছেন তা বলিষ্ঠতারই পরিচয়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের চেয়ে শিল্পী শরৎচন্দ্রের কাছে যেমন সমাজ প্রাধান্য পেয়েছে, হাসান হাফিজুর রহমান যেমন পল্লীর নিরন্ন মানুষের জীবনযাপনের কথা উঠিয়ে এনেছেন তেমনি ‘কাক ও কারফিউ’ গ্রন্থে গল্পের আধার সৃষ্টি হয়েছে ‘পিছুটান’ গল্পে। নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের আশা-আকাক্সক্ষা ও জীবিকার দ্বন্দ্বের টুকরো ছবির মধ্য দিয়ে জীবনের অনেক গল্প তিনি ম্যাগনিফাইড করে দেখিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা সূক্ষ্মদর্শী ও মর্মস্পর্শী। নাজিব ওয়াদুদ পরিশীলিতভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও মাননিক বিমূর্ত ছবিগুলোকে তার গল্পে মূর্ত করে তুলেছেন বিচক্ষণ ক্ষমতায়। তাই দেখা যায় ‘মেঘ ভাঙা রোদ’-এর চরিত্র বিচারে তমিজুদ্দীন নিজের অন্তরের গ্লানি, ক্ষোভ, শ্লাঘা আত্মসাৎ করে রমিজের কাছ থেকে বাবা ডাকটি শুনতে চেয়েছে। পিতৃত্বের উষ্ণ টান এ গল্পে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ফুটে উঠেছে। প্রতিটি চরিত্রকে চিরে তার ভেতর থেকে অন্তর্নিহিত রস বের করে এনেছেন গল্পকার, তার প্রথম গল্প গ্রন্থের প্রায় সব কটি গল্পের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। দেশ বিভাগোত্তর বাংলাদেশে যখন ধর্ম রাজনীতি আর কুসংস্কারের বিতল চট্টান মেঘ পুরো আকাশকে একটু একটু করে গ্রাস করছে তখন তার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত সমাজ। তারই বিদগ্ধ হাওয়া বয়ে গেছে নাজিব ওয়াদুদের ‘বাঁচামরা’ কিংবা ‘পিছুটান’ গল্পের ওপর দিয়ে। গল্পে হামেদ আলী সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জীবনের যন্ত্রণা কেমন। এখানে হামেদ আলী অথবা ‘ভগ্নযাত্রা’র নওয়াব আলী প্রত্যেকেই আলোড়ক হয়ে গল্পে কাজ করেছে। সমাজের শ্রেণীস্তর যখন যুগে যুগে জাতিসত্তার অন্তরীত গভীরে অনুচ্চারিত হয়ে ব্যাদান বর্মের আঘাত সৃষ্টি করে তখনই লেখকের অজান্তেই কলমের ডগা দিয়ে উচ্চারিত হয় সেসব যন্ত্রণার ভাষা। আর সেসব নানামুখী জীবন যন্ত্রণার যূথবদ্ধ প্রতিনিধিত্বকারী লেখক হিসেবে নাজিব ওয়াদুদ তার শিল্পীসত্তা নিংড়ানো নির্যাস অকৃত্রিম সাধনায় সাহিত্যসমাজে সংযুক্ত করবার প্রয়াস করেছেন। তিনি কমিটেড লেখক বলেই সামাজিক জীবন শৃঙ্খলাহীনতায় স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০০৮ সালে ছোটগল্পের আকাশে সংযুক্ত করেন নতুন নক্ষত্র গল্পগ্রন্থ ‘নষ্ট কাল অথবা হৃদয়ের অসুখ’। এ গ্রন্থেরও ভিত ভাঁজে রয়েছে আঞ্চলিকতার আকর। পল্লীর জীবনচিত্র যেমন মাহবুব উল আলম মধুর ও বিধুর রসে সরস করেছেন অথবা আবু ইসহাক তার ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ নিয়ে যেমনভাবে সাহিত্য জগতে এসেছেন কিংবা সরদার জয়েনউদ্দিন, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্লিষ্ট জীবনের জয়গান গেয়েছেন তেমনি নাজিব ওয়াদুদ গল্প বলতে গিয়ে গল্প না বলে গল্প অঙ্কন করেছেন। আর বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ঘরগেরস্থালির আবরণ ‘এ্যাক্রিলিক সেগমেন্টে’র আলোছায়ায় নিপুণভাবে দাঁড় করিয়েছেন। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘আবাদ’। নিম্নবিত্ত জগলু এখানে প্রতীকী ঝা-া হাতে এসেছে। জীবনকে জয় করার অদম্য আকাক্সক্ষাই তাকে নিষ্ফলা জমিচাষ ও বন্ধ্যা রুপাকে বিয়ে করায় ব্রতী করে। একইসঙ্গে বাস্তববাদী ও নিরীক্ষাধর্মী এ গল্পে জগলুর মনে যে বাসনা বাসা বাঁধে তারই প্রকাশ পায় আঞ্চলিক ভাষায় এভাবেÑ ‘মাটি ক্যানে বাঞ্জা হবে গো? চষো, উল্টায়ে-পাল্টায়ে চষো। সার দ্যাও, পাঁউশ দ্যাও, পানি দ্যাও, জো মুতন বীজ ফ্যালো, যত্তন ল্যাও। তা-ও যদিল না হয় তে জো বদলাও, অন্য বীজ ছিটাও। এ্যারই নাম আবাদ। তে মানুষও তো জমিরই লাহান।’ এছাড়া ‘কসাই’ কিংবা ‘নষ্ট কাল অথবা হৃদয়ের অসুখ’ এসব গল্পগুলোতে শিল্প-আকর অপ্রতুল হলেও সামাজিক জীবনব্যবস্থার অনন্য রূপ বিষয় চিন্তা গ্রন্থকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে যারা মরে তাদের বলা হয় ভীরু, কাআত্মা। অথচ সংসারের জটিল সংকটে নিয়ত মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে আবার তার ভেতর থেকেই মানুষ উঠে আসছে। সারাক্ষণ একটা মৃত্যুচেতনা তাড়া করে ফিরছে। আলিফ মামার প্রকৃতিতেও সেই চেতনার স্তর থরে থরে গজিয়ে উঠেছে। অপূর্ব শিল্পরীতির শৈলীতে এ গল্পের আকৃতি জীবনের গভীর থেকে আকীর্ণ হয়েছে। গল্পকার এখানে সত্যি এক দক্ষ প্রতœতাত্ত্বিক শিল্পশ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন আর মৃত্যুচেতনার ভেতর থেকে খনন করে খনি রতœ ‘খনন’কে তুলে এনেছেন। অপরদিকে ‘স্বামীর কথার পিঠে কথা গেঁথে যুক্তি দাঁড় করায় মাযরাÑ ‘ক্যান পারবে না? ম্যাডার বি’ হয়া গেলে ঝাড়া হাত পা।’ এরকম নির্মোদ পল্লীভাষায় হাজির হয় গল্প ‘কসাই’। রহস্যময়তার কোনও জায়গা নেই, সাদাসিধে উস্থাপন অন্তরের পশুবৃত্তিকে দমন করে পশুর প্রতি মমত্ববোধ এ গল্পে সৃষ্টি হয় গল্পকারের একেবারে নিজস্ব ভঙ্গিমায়Ñ যা প্রচলিত গল্প থেকে আলাদা করতে সাহায্য করেছে। এরপর ‘জীয়নকাঠি’, ‘গ্রীন হাউস উপকথা’, ‘মৃত্যুঞ্জয় মারা গেছে’, ‘আরো দুটি খুন’ সবগুলোই উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। এ গ্রন্থেও অনুগল্প আছে শহীদ হয়ে বেহেস্তে যাবার কথা বুড়ির মুখে এসেছে আর গল্পের সংক্ষিপ্ত অবয়বে বেশ ক’টি চরিত্রের সংমিশ্রণ ঘটেছে ‘জীয়নকাঠি’ শিরোনাম গল্পে, যে কাঠি মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে তারই সংলাপী রূপ এখানে দেখা যায়। বিজ্ঞানের কথাও এসেছে নাজিব ওযাদুদের গল্পে যেমন ‘গ্রীন হাউস উপকথা’। ‘নোনাপ্রেম’-এ প্রকাশ পেয়েছে গ্রাম্যতার গরিমা। সমাজপতিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব, বাদশা আর সেরেনার মধ্যে সাংসারিক কলহ, আঞ্চলিকতার সঙ্গে গল্পকারের নিজের সংলাপ আঞ্চলিকতার আবরণ স্থান বিশেষ বিবর্ণ করতে যে মনন মাধুর্য অবচেতনে আসে এ গল্পে তা আচ্ছন্ন করতে পারেনি। রফিজা-আলীমকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে ‘কান্না হাসির উপাখ্যান’। সন্তানহীন মাতৃত্বের বেদনা আর সন্তান-বিচ্ছেদী মায়ের ক্রন্দন এ গল্পে ফুটে উঠেছে। নগরজীবনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের অপূর্ব মিশেল সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত বলতে হবে গল্পকারকে। মানবজীবনের সমস্ত পর্বই সাহিত্যের মুকুরে ভেসে উঠে। ‘ভালো ও মন্দ’-এ লেখক সেলিনাকে সে দৃশ্যে চিত্রায়িত করেছেন। শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ লেখক নাজিব ওয়াদুদ। প্রতি গল্পের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি গল্পে সবার থেকে আলাদা ও অনন্য। একাধারে অনুবাদ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়াগ্রন্থ রচনা করেও বিবেকের কাছে সমাজের কাছে সাহিত্যের কাছে তাড়িত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। হচ্ছেন জৌলুসিত। ২০১১ সালে সেই জৌলুসের জীবন্ত জুলফি ধরে এলো এক ব্যতিক্রমী নামের ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’ সংঘবদ্ধ সপ্ত সংখ্যার গল্পে গ্রন্থের ক্রমিক। কবি আলাওলের পদ্মাবতীর রূপবর্ণনা যেমন মোহিত করে পল্লীবালা পদ্মাবতীও তেমন, আর তার মধ্যে ঘটেছে অসাধারণ কল্পনার মিশেল। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার যুবতী বিধবা স্ত্রীর জীবনালেখ্য নিয়ে এ গল্পগ্রন্থে এসেছে ‘শহীদ ইদু কানার বউ’। সাহিত্যে আবেগের প্রাধান্য যেমন তেমন যুক্তিরও। ‘আপস’, ‘নাকফুল’, ‘অন্তর্গত’, ‘একজন প্রতিবন্ধী ও একটি মহাসড়কের গল্প’, ‘সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’- এসব গল্পে গল্পকার জীবনের কাহিনীতে তার আপন মাধুরীর সিসৃক্ষায় অসামান্য করে তুলেছেন। কথাশিল্পী কোনও না কোনও কালের সমাজবাস্তবতায় ও গতিশীল আবহের মধ্য দিয়ে নিজে যেমন বেড়ে উঠে তেমনি তার শিল্পকর্মের আধারেও দেশ-কাল-সমাজবাস্তবতার খনি মৃত্তিকা থাকে। নাজিব ওয়াদুদ গল্পের বিষয়বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকে নতুন ধারার সূচনা সংযুক্ত করে বাংলা ছোটল্পের জগতে স্থায়ী আসন করে নিবেন। তাঁর শিল্পচৈতন্যে প্রকৃতি মানুষ ও আধ্যাত্ম অটুট বন্ধনে বাঁধা থাকবে, তিনি বাংলাসাহিত্য ভাঁড়ার তাঁর সৃষ্টিকর্মে ভরিয়ে তুলবেন, দিকে দিকে তার মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়নই খুলে দিবে তার ভূয়সী সাফল্যের দ্বার শিল্পঋদ্ধ ভুবনে।
×