ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেও ঘোষণা আসেনি

শর্তের বেড়াজালে এরশাদেও নতুন জোট

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৪ আগস্ট ২০১৭

শর্তের বেড়াজালে এরশাদেও নতুন জোট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সামনে নির্বাচন। তাই ক্ষমতার স্বাদ চাই। রাজনীতি মানেই ক্ষমতা। আর যারা ক্ষমতার স্বাদ একবার পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে তো খুব স্বাভাবিক বিষয়। দেড় বছর বাকি থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি আগেভাগেই। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জোট গঠন করেছে। ৫৮টি দল এই জোটে। যদিও বেশিরভাগই নামসর্বস্ব। কথায় আছে. কোন কোন দলের প্যাড পর্যন্তও নেই। এতেও ভরসা পাচ্ছেন না এরশাদ। ক্ষমতায় যাওয়া বা রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে শক্তি প্রয়োজন। তাই দলে ভেড়াতে হবে আরও কিছু দল। যাদের মানুষ চেনে। হয়ত এমন চিন্তা থেকেই আরেকটি জোট গঠনের চেষ্টা তার। নতুন করে পুরনো বন্ধুত্ব। রাজনীতি ও ক্ষমতার গাঁটছড়া। এজন্য বুধবার রাতে ভাই জিএম কাদেরকে পাঠিয়েছিলেন বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বি চৌধুরীর বাসায়। যিনি বিএনপির আমলে রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। যদিও এখন তিনি বিকল্পধারার সভাপতি। সেখানে সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়। কথা ছিল বৃহস্পতিবার জাপা চেয়ারম্যানের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে সমমনা সব দলের শীর্ষ নেতারা যোগ দেবেন। নতুন আরেকটি জোটের ঘোষণা দেবেন এরশাদ। যার মধ্য দিয়ে তৃতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক জোটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু বিধি বাম। এরশাদের প্রস্তুতি ঠিকই ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে সমঝোতায় আসতে পারেনি শরিক দল। জোট গঠন করতে জাতীয় পার্টিকে কিছু শর্ত দিয়েছে বিকল্পধারা, জেএসডি, গণফোরামসহ অন্যান্য দলের নেতারা। সবার পক্ষে জাপার সঙ্গে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন বি চৌধুরী। শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জোট করার পক্ষে রয়েছেন সবাই। কিন্তু কেউই এরশাদকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য যে কোন সময় এরশাদ পল্টি নিতে পারেন। ভবিষ্যতে তাই করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা চান শরিক নেতারা। পাশাপাশি জোট গঠন করলে কার অবস্থান কি হবে? এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আসন ভাগাভাগির বিষয়েও কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠক জিএম কাদেরকে এসব বিষয় জানানো হলে তিনি দল প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোন কথা দিতে পারেননি। তাই শেষ পর্যন্ত বড় রাজনৈতিক জোট গঠনের ঘোষণাও আসেনি। এমন বাস্তবতায় জোট শরিকদের শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে দলের নীতি নির্ধারণী প্রেসিডিয়ামের বৈঠক ডেকেছেন এরশাদ। চলতি মাসের মাঝামাঝি এ বৈঠক হতে পারে। তবে সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক বিষয় ও দেশের চলমান অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ। নতুন জোট গঠন নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। বিকল্পধারা বাংলাদেশের সঙ্গে জাতীয় পার্টির জোট করার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে এরশাদের পাশে বসা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে আমরা একটি পৃথক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। বুধবার একটি বৈঠক ছিল, সেখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ছিলেন। কিছু রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছে, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো কথাবার্তা সেখানে হয়নি। এখন এ বিষয়ে প্রেসিডিয়াম ফোরামে আলোচনা হবে; আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে জোট হবে কি না। জাপা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৫৮ দলের সমন্বয়ে জোট গঠন করেছে জাপা। পাশাপাশি ফের মহাজোট গঠন করে নির্বাচনের প্রস্তুতিও রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০০ আসন চেয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। আবার একক নির্বাচনের কথাও বলছেন দলের চেয়ারম্যান। ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকাও শেষ করা হয়েছে। আসনপ্রতি তিনজন করে প্রার্থী বাছাই করেছে জাপা। আগামী নির্বাচনের জন্য কর্মপরিকল্পনা শেষ করা হয়েছে। তাই নতুন জোট করলে নির্বাচনী রূপরেখা কিভাবে হবে, অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া ও এর সঙ্গে যুক্ত সকল বিষয়ের ফয়সালা চান জোটের শরিকরা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গত নির্বাচনের আগেও এরশাদ-বি চৌধুরীসহ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বার বার জোটভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। একমঞ্চে তিন দলের তিন নেতা হাত মিলিয়ে এক হয়ে পথ চলারও অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতিই টেকেনি। ভেস্তে গেছে। এখন নতুন করে সবার পথচলা কতটুকু সম্ভব বা মসৃণ হবে তাই এখন দেখার বিষয়। এদিকে বি চৌধুরীর বাড়িতে তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গঠনের বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা সরব। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়িতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতার বৈঠককে ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’ আখ্যা দিয়ে এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সংবাদ সম্মেলনে এরশাদের দেয়া বক্তব্য নিয়েও মুখ খুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই বৈঠক নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এটা খুব ভাল, গণতন্ত্রের শত ফুল ফুটেছে। এটা তো ভাল; এটাকে আমি বলব, গণতন্ত্রের শত ফুল ফোটা। এটা তো গণতন্ত্রের বিউটি। আমি এটাকে বলব গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে এ মেরুকরণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বি চৌধুরীর বারিধারার বাড়িতে ওই বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে তৃতীয় জোট গড়ার কথা বলে আসা এই রাজনীতিকদের বৈঠকে সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির এইচএম এরশাদের ছোট ভাই ও দলটির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও অংশ নেন। সম্ভাব্য রাজনৈতিক জোট গঠনের এই আলোচনা-উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচনে আদর্শগত বিষয়টি মুখ্য নয়, এখানে এ্যালায়েন্সটা কৌশলগত; সময়ের প্রয়োজনে এবং নির্বাচনে জেতার জন্য... আমি এটাকেই বলি গণতন্ত্রের বিউটি। ‘গ্রুপিং, এ্যালায়েন্স এগুলো হতে থাক। মেরুকরণ হচ্ছে, এটি নির্বাচনকে সামনে রেখে হচ্ছে। এটি একটি ভাল দিক। এই বৈঠকে নেতিবাচক কিছু না দেখলেও এর পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকা কাদের বলেন, তারা তো ওখানে ষড়যন্ত্র করছে না, জোট করছে, তাতে অসুবিধা কি? পরিণতি দেখতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে গত ১৩ জুলাই রাতে রবের উত্তরার বাসায় বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, মান্না, সুব্রত চৌধুরীরা এক হয়েছিলেন, যাতে বাগড়া দিয়েছিল পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, বাধা তো দেয়া হয়নি; অতি উৎসাহী কেউ করেছে কিনা, আমি সেটি জানি না। এ ধরনের কোন বাধা সরকার বা দলের পক্ষে নির্বাচনী কর্মকা-ে কখন দেয়া হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী ও রব এনডিএফ জোট গঠন করে বিএনপির পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও ওই নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। তবে বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পরও নানা নাটকীয়তার পর সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ। সংসদের প্রধান বিরোধী দলটির তিনজ সদস্য বর্তমান সরকারে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন। তবে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদ একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার লজ্জা ঘোচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এর আগেও তিনি মহাজোট ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন; বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি জোটও গঠন করেছেন। তবে সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ যে মোটেই চিন্তিত নয়, তা স্পষ্ট করেই বললেন ওবায়দুল কাদের, তারা সরকারে না থাকতে চাইলে চলে যেতে পারেন। তারা স্বেচ্ছায় সরকারে এসেছেন, তারা যেতে চাইলে যাবেন। আমরা এমন কোন সঙ্কটে পড়িনি যে, তারা চলে গেলে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। এখন তো কোন মহাজোট নেই, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সরকারে আছেন। এরশাদ নিজেও তো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, পতাকাবাহী গাড়িতে তিনি যাচ্ছেন। তবে এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের অংশীদারিত্ব ছাড়বে বলে মনে করেন না কাদের। আমার মনে হয় না এমন কোন ইশারা-ইঙ্গিত পাইনি যে, তারা সরকার থেকে চলে যাবেন। আমার তো মনে হচ্ছে না। জানা গেছে, সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে যে কোন ইস্যুতে টানাপোড়েন হয় জাপার। তখন মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ ও বিশেষ দূত থেকে নিজের সরে আসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন তিনি; যা শেষ পর্যন্ত নিজ দফতরেই আছে। গণভবন পর্যন্ত যায়নি।
×