গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশে নব্য জেএমবির কর্মকা- চালানোর নেপথ্য কারিগরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশী আইএস জঙ্গী ডক্টর সাইফুল্লাহ ওজাকী। তিনি জঙ্গী সংগঠনটির মাধ্যমে এদেশে আইএসের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। সিরিয়ায় এক ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধে ওজাকীর মৃত্যুর পর এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। জাপান প্রবাসী ওজাকী স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী সন্তান আইএসের কাছেই রয়েছে। তবে তারা জীবিত না মৃত তা নিশ্চিত হতে পারেনি গোয়েন্দারা। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও ওজাকীর পরিবার কিছুই প্রকাশ করেনি। আইএসে যোগ দেয়ার আগে ওজাকী তিনবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রতিবারই তিনি একজন করে জঙ্গীকে নিজ খরচায় ইরাক ও সিরিয়া পাঠিয়ে আইএসে যোগদান করিয়েছেন। ওজাকী এদেশীয় জঙ্গীদের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াও নানাভাবে সহায়তা করেছেন। ওজাকীর সঙ্গে হলি আর্টিজানে হামলাকারী নব্য জেএমবির জঙ্গীদের যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হয়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ডক্টর সাইফুল্লাহর ওজাকী বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে। পিতার নাম জনার্দন দেবনাথ। ওজাকীর মায়ের নাম অনিতা রানী দেবী। ওজাকীর পিতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের জিনদপুর বাজারের প্রতিষ্ঠিত কাপড় ব্যবসায়ী। স্থায়ী দোকান খোলার আগে ওজাকীর পিতা বিভিন্ন হাটে ঘুরে ঘুরে কাপড় বিক্রি করতেন। জনার্দনের ছেলে সুজিত কুমার দেবনাথ। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে সাইফুল্লাহ ওজাকী নাম ধারণ করেন। ২০০২ সালে ছাত্রজীবনে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপানে যান সাইফুলাহ ওজাকী। সেখানেই তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। ২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভের পর কিয়োটোর রিৎসুমিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব ইন্টারন্যাশনালে শিক্ষকতা শুরু করেন।
পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির সহযোগী অধ্যাপক হন। বিয়ে করেন জাপানী নারীকে। তাদের সংসারে তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ওজাকী সপরিবারে জাপান থেকে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। রাজধানী ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানায় ২০১৫ সালের ২৪ মে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা ২৩ নম্বর মামলার আসামি ছিলেন সাইফুল্লাহ ওজাকী।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর নিখোঁজদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে ওজাকীর নামও ছিল। জাপানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই তার বিষয়ে প্রথম তথ্য প্রকাশ করে। একটি বিদেশী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের আইএসের আমির হিসেবে ওজাকীর নাম প্রকাশের পর তার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হয়। এরপর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। ওজাকী একাধিকবার দেশে এলেও বাড়িতে যেত না।
মনিরুল ইসলাম আরও জানান, ওজাকী অন্তত তিনজনকে বাংলাদেশ থেকে নিজ খরচায় সিরিয়া পাঠিয়ে আইএসে যোগদান করিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে বাংলাদেশে জঙ্গীদের চালানো হামলায় ওজাকীর সরাসরি জড়িত থাকার কোন তথ্য মেলেনি। বাংলাদেশ থেকে যারা আইএসে যোগ দিয়েছেন, তাদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। বিদেশে জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত থাকা বাংলাদেশীদের দেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তাদের পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১৫ সালে ওজাকী সপরিবারে প্রথমে বুলগেরিয়া যান। সেখান থেকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দেন। সিরিয়ায় এক যুদ্ধে ওজাকীর মৃত্যু হয়। এ বিষয়ে ওজাকীর পরিবারের সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়। পরিবারের সদস্যরা ওজাকীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওজাকীর স্ত্রী সন্তানরা আইএসের কাছে ভাল রয়েছে বলেও ওজাকীর পরিবারের সদস্যদের দাবি।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, ওজাকীর একটি ফোরাম ছিল। ওই ফোরামে তার দৃষ্টিতে যেসব ব্যক্তিকে কঠোর জিহাদী মনোভাবের বলে মনে হতো, তাদেরই ওজাকী টার্গেট করত। তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলত। তাদের নানাভাবে ব্রেনওয়াশ করার পর নিজ খরচায় ইরাক বা সিরিয়া পাঠিয়ে আইএসে যোগদান করাত। এভাবে সে তিনজনকে এদেশ থেকে আইএসে যোগদান করিয়েছে। ওজাকী নব্য জেএমবির মাধ্যমে বাংলাদেশে আইএসের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক গুলশান হলি আর্টিজানে হামলার মাস্টারমাইন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম আহমেদ চৌধুরী দেশে এসে আইএসের জন্য যোদ্ধা সংগ্রহের কাজ শুরু করে। সে জুনুদ আল তাওহিদ আল খালিফা নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সংগঠনটিই পরবর্তীতে নব্য জেএমবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশী আইএস জঙ্গীর সংখ্যা শতাধিক। যারা ইরাক ও সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশে রয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশী প্রবাসী। তারা যেসব দেশে বসবাস করতেন, সেইসব দেশ থেকেই তারা বিভিন্ন পথে ইরাক ও সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৮ জন এবং তাদের পরিবারকে শনাক্ত করা হয়েছে। আইএস জঙ্গীদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ৪ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী জঙ্গীদের দেশে অনুপ্রবেশ আমৃত্যু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে নামীয় তালিকা পাঠানো হয়েছে সীমান্ত ও বিমানবন্দরে।