ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র তিন ঘণ্টায় ১২১ মিলিমিটার বৃষ্টির সর্বোচ্চ রেকর্ড ডুবেছে রাজধানী

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৪ আগস্ট ২০১৭

মাত্র তিন ঘণ্টায় ১২১ মিলিমিটার বৃষ্টির সর্বোচ্চ রেকর্ড ডুবেছে রাজধানী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানী অচল। বৃহস্পতিবার মাত্র ৩ ঘণ্টায় ১২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিদফতর। সাম্প্রতিক অতীতে এত কম সময়ে এত বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই আবহাওয়া অধিদফতরের হাতে। তারা জানায়, এই মৌসুমে গত ১২ জুন রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৩৯ মিলিমিটার। তবে তা ছিল ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। তারা জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যেই যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে তার পরিমাণ ১২১ মিলিমিটার। আবহাওয়া অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, নিকট অতীতে এত কম সময়ে এত বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড তাদের নেই। তবে তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৪ সালে এবং ২০০৯ সালে একদিনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরপর আর এত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন কম সময়ে বেশি বৃষ্টিপাতও একটি বড় রেকর্ড। বৃহস্পতিবার তিন ঘণ্টায় টানা মুষলধারে বৃষ্টিপাতের কারণে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়ে কাজের প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষজন। বৃষ্টিতে তাদের যেমন কাকভেজা হতে হয়েছে তেমনি রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। কোন এলাকায় জ্যামের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে দেখা গেছে। আবার কোন এলাকায় বৃষ্টির কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকতে দেখা গেছে। যানবাহন বন্ধ থাকার কারণে বৃষ্টির মধ্যে জনসাধারণকে গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। রাজধানীর একটি ব্যস্ততম এলাকার নাম গাবতলীর পাশে টেকনিক্যাল মোড়। সাধারণত বড় ধরনের বৃষ্টিপাতেও এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। কিন্তু বৃহস্পতিবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর ১ নম্বর পর্যন্ত এলাকা বৃহস্পতিবার বৃষ্টিপাতে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। ফলে পুরো বৃষ্টির সময় ধরেই রাস্তায় সমস্ত গাড়ি আটকে থাকতে দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর ১ নম্বর থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় সিএনজিচালিত গাড়িগুলো পানিতে বিকল হয়ে যায়। ফলে টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর ১ নম্বর হয়ে চিড়িয়াখানা রোড এবং ১০ নম্বর এলাকা পর্যন্ত গাড়ি আটকে থাকে পুরো বৃষ্টির সময় ধরে। আবার মিরপুর ১ নম্বর এবং চিড়িয়াখানা রোড এলাকায় রাস্তায় পানি জমে যাওয়ার কারণে গুলিস্তানগামী বা অন্য রুটে কোন গাড়ি ছাড়তে দেখা যায়নি। এ সময় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়ে যায় হাজার হাজার যাত্রী। সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকনিক্যাল মোড়, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট পর্যন্ত হাজার হাজার যাত্রী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করেও যাত্রীবাহী কোন গাড়ির দেখা মেলেনি। ফলে বৃষ্টিতে সাধারণ যাত্রীদের কাকভেজা হতে হয়েছে। অপরদিকে কল্যাণপুর, শ্যামলীতে রাস্তায় পানি না জমলেও আসাদগেট, সংসদ ভবন, ২৭ নম্বরের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে যায় এই এলাকা। সিএনজিচালিত পরিবহনগুলো পানিতে বিকল হয়ে যাওয়ায় মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় জ্যাম লেগেই ছিল। সংসদ ভবনের পশ্চিম মাথা থেকে শুরু করে ধানম-ির ২৭ নম্বর পর্যন্ত হাঁটু পর্যন্ত পানি জমে যায়। অনেককে পায়ের স্যান্ডেল জুতো খুলে, প্যান্ট ভাঁজ করেই পানি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে। আবার পরিবহনগুলো যখন পানিতে ঢেউ তুলে চলাচল করছিল তখন পায়ে হাঁটা যাত্রীরা ভিজে একাকার হয়ে যায়। এদিকে সংসদ ভবনের পূর্ব মাথা থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত সড়ক পানিতে ডুবে ছিল। এই রোড়ে পানি জমে যাওয়ায় গাড়িগুলো আটকে পড়ে। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। খামারবাড়ি রোডে পানি না জমলেও রাজধানীর কারওয়ানবাজার যেন নদীতে পরিণত হয়ে পড়ে। রাস্তার ডিভাইডার আর পায়ে হাঁটা ফুটপাথ সম্পূর্ণই পানির নিচে চলে যায়। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কোন নদীর দৃশ্য এটা। এই এলাকায় অলিতে-গলিতে পানিতে সয়লাব হয়ে পড়ে। এদিকে বাংলামোটর থেকে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তায় খুব বেশি পানি না জমলেও বাংলামোটরের এসি মার্কেটের সামনের রাস্তায় হাঁটু পানি বেঁধে যায়। ফলে যানবাহনগুলো ধীরে ধীরে চলতে দেখা গেছে। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব, মৎস্য ভবন এলাকায়ও বৃষ্টির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই সংশ্লিষ্ট এলাকার সড়কগুলোতে পানি বেঁধে যায়। বৃষ্টির কারণে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত দেখা দেয় তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে যাত্রীরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাত হয় তাদের। বৃষ্টিতে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা গেছে, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। কোন কোন সড়কে ড্রেনের ময়লা আর দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ায় পানিতে হাঁটাও যাচ্ছে না। এদিকে বৃষ্টিতে রাজধানীতে প্রধান প্রধান সড়কগুলোর দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়। অনেক দোকান খোলা থাকলেও দোকানগুলোর ভেতরে পানি উঠে যায়। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া সড়কে পানি জমার কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর হয়ে ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাতে সড়ক ও নিম্ন এলাকা তলিয়ে যায়। পুরানা পল্টন এলাকায় বৃষ্টি কারণে মানুষজনের এক ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, চানখাঁরপুলের চারপাশের সড়ক ও আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। রাজধানীর বাড্ডা, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা লিংক রোডসহ আশপাশের এলাকায় সাধারণ মানুষজনকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ময়লা আবর্জনায় ড্রেন ভর্তি হয়ে যাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে পারছে না। তারা জানায়, আগে ঢাকায় ৪০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত না হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না। এখন সামান্য বৃষ্টিপাতেই সৃষ্টি হচ্ছে ভয়ানক জলাবদ্ধতা। এ জন্য মূলত দায়ী ওয়াসার ড্রেনগুলো ভর্তি হয়ে যাওয়া। বৃহস্পতিবার বৃষ্টির সময় প্রত্যক্ষ করা গেছে, রাস্তার মাঝখানে ওয়াসার যেসব ঢাকনা রয়েছে তার মুখ ছিল বন্ধ। ফলে অনেক ঢাকনা দিয়ে পানি নামার সময় আবর্জনায় তার মুখগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সঠিক গতিতে পানি নামতে পারেনি। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন থেকেও রাস্তার দুই ধারে যেসব ড্রেন করা হয়েছে তা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে পানির ধারণক্ষমতা অনেক কমে গেছে। ড্রেনের ধারণক্ষমতা কমে গিয়ে পানি উপচে রাস্তায় চলে আসছে। জলাবদ্ধতার সঙ্গে পচা দুর্গন্ধ পানি মিশে একাকার হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করা গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতা অনেক কমে আসবে। বিশেষ করে প্রত্যেক বাসা-বাড়িতে যদি বৃষ্টির পানি ধারণে আধার নির্মাণ করা যায় তাহলে রাস্তায় পানি কম জমবে। এছাড়া বৃষ্টির পানি পাতালে চলে যাওয়ার সুযোগ দিলেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে কম। তারা জানায়, কংক্রিটের শহরের বৃষ্টির পানি পাতালে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে পাইপ গেড়ে যদি পানি পাতালে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় তাহলে দুর্ভোগ কমবে। এছাড়া প্রত্যেক বাসাবাড়িতে পানি ধরে রাখার জন্য বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে পানির আধার তৈরি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এদিকে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। বৃষ্টির সময় ভ্যাপসা গরম কিছুটা কমলে অন্য সময়ে গরমে টেকা মুশকিল হয়ে পড়ছে। কয়েকদিন ধরেই প্রকৃতিতে ভ্যাপসা আবহাওয়া বিরাজ করছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বৃষ্টির মধ্যেও গরমের ভাব কমছে না। আবহাওয়া অফিস বলছে, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সারাদেশে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্বদিকে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছেÑ রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে।
×