ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস ২৪ ঘণ্টা খোলা, শুল্কায়ন বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৪ আগস্ট ২০১৭

চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস ২৪ ঘণ্টা খোলা, শুল্কায়ন বেড়েছে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমস হাউস। সরকারের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন বেড়েছে। তবে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারিতে উন্নতির চিত্রে এখনও ধীরগতি। কর্মঘণ্টা বৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে কাস্টমসে বাড়ানো হয়েছে জনবল। প্রতিদিন দুই শিফটে দিনরাত উপস্থিতি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পণ্য খালাস এবং ডেলিভারির গতি বাড়াতে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর ব্যবহারকারী সংস্থাগুলোর সহায়তায় সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। দিন যতই গড়াবে কাজের গতি এবং ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাবে, এমনই আশা করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমস একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অপর সংস্থাটি অসম্পূর্ণ। কেননা, বন্দরে যে পণ্যগুলো আসে সেগুলোর শুল্কায়ন করে কাস্টমস। এতদিন ধরে সারাবছর বন্দরে পণ্য ওঠানামা থাকলেও বন্দর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সার্বক্ষণিক না থাকায় সুফল মিলছিল না। তবে যন্ত্রপাতি এবং পর্যাপ্তসংখ্যক জেটি না থাকাসহ বেশকিছু সঙ্কট রয়েছে বন্দরেরও। বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস এবং পোর্ট ইউজারদের সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার এএফএম আবদুল্লাহ খান বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, সরকারী পর্যায়ে সিদ্ধান্তের পর ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে কাস্টমস হাউসে। জনবলের তীব্র সঙ্কটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন পদে প্রায় ১১০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা যোগদান করেছেন। ফলে সঙ্কট একেবারে শতভাগ না কাটলেও কাজ চালিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে না। দৈনিক দুই শিফটে কাজ চলছে। প্রথম শিফট সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় শিফটের কাজ। বিল অব এন্ট্রি গ্রহণ এবং শুল্কায়নের ভলিউম এরমধ্যেই কিছুটা বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কার্যক্রম ধীরে ধীরে আরও বৃদ্ধি পাবে। কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম শুল্ক ভবনে আমদানি এবং রফতানি মিলে প্রতিদিন অন্তত ৬ হাজার বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়ে থাকে। তীব্র জনবল সঙ্কট এবং সার্বক্ষণিক কার্যক্রম না থাকায় এ কাজ সমাধায় অনেকটা হিমশিম অবস্থা ছিল। আমদানি-রফতানিকারক এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন প্রতিনিধিদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস হাউস এবং বেনাপোল স্থলবন্দর সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা। তাদের যুক্তি, বিমান বন্দর যদি চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে, বন্দর কেন নয়। বিমান বন্দরে সারাদিনই যেভাবে বিমান ওঠানামা করে ঠিক তেমনিভাবে সমুদ্র বন্দরেও ভিড়ছে জাহাজ। বিমান বন্দর ইমিগ্রেশন যেভাবে সার্বক্ষণিক কার্যকর থাকে ঠিক সেভাবেই কার্যকর থাকতে হবে বন্দর-কাস্টমসও। শুধু তাই নয়, বিমান বন্দরের মতো সমুদ্র পথে আসা কন্টেনারের জন্যও গ্রীন চ্যানেল ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে অভিমত তাদের। কন্টেনার খালাস এবং ডেলিভারিতে গতি আনার লক্ষ্যে গ্রীন চ্যানেল ব্যবস্থা চালু করার চিন্তা ভাবনাও সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছে কাস্টমস। এ প্রসঙ্গে কাস্টমস হাউসের কমিশনার জানান, বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সিদ্ধান্তের বিষয়। কোন ধরনের কন্টেনার গ্রীন চ্যানেলের আওতায় আসবে সে সিদ্ধান্ত দেবে এনবিআর। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এন্ড প্লানিং) মোঃ জাফর আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বন্দরে পণ্য ওঠানামার কাজ আগেও বছরের দুটি ঈদের দিনের প্রথম শিফট ছাড়া প্রতিদিন চালু ছিল। পণ্য ডেলিভারি গ্রহণের বিষয়টি নির্ভর করে আমদানিকারক এবং ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সক্রিয়তার ওপর। কাস্টমসে শুল্কায়নের পর কাগজপত্র গ্রহণ করা হতো রাত ৮টা পর্যন্ত। এখন সার্বক্ষণিক খোলা আছে। তবে প্রথম দু’দিন অর্থাৎ গত শুক্র ও শনিবার যে পরিমাণ পণ্য ডেলিভারি হয়েছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে খুব একটা বেশি নয়। সাপ্তাহিক ছুটির এ দু’দিনে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি গেছে গড়ে আড়াই হাজার টিইইউএস কন্টেনার। সাতদিন খোলা রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকরের আগেও শুক্র এবং শনিবারে ডেলিভারির পরিমাণ তেমনই ছিল। এর পরিমাণ আরও অনেক বাড়া উচিত। সাধারণত স্বাভাবিক দিনে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টিইইউএস কন্টেনার ডেলিভারি হয়ে থাকে। তিনি জানান, কাজে গতিশীলতা বাড়াতে একটি পদক্ষেপ এরমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। শিফট পরিবর্তনের সময় একজন অপারেটরের দায়িত্ব শেষ হওয়ার অন্তত পনেরো মিনিট আগে পরবর্তী অপারেটরের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। চিটাগাং কাস্টমস ক্লিয়ারিং এ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্স এ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি একেএম আকতার হোসেন জানান, সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা বন্দর-কাস্টমস খোলা রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার সুফল মিলতে শুরু করেছে। এর ফলে পণ্যের শুল্কায়নের জন্য বেশি সময় পাওয়া গেছে। আগে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চাপ ছিল। অনেক সময় প্রক্রিয়াগত বিলম্বের কারণে পণ্যের শুল্কায়ন গড়িয়েছে পরের দিন পর্যন্ত। এখন সকল সেকশন খোলা থাকছে। আমদানি-রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে কাজের সুফলও বাড়তে থাকবে। বন্দর এবং কাস্টমস চব্বিশ ঘণ্টা খোলা রাখার দাবিতে সবচেযে বেশি সোচ্চার ছিল পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। কেননা, সর্বাধিক আমদানি এবং রফতানি মূলত এ খাতেরই। শিল্পের কাঁচামাল যেমন আমদানি করতে হয়, তেমনিভাবে রফতানি হয় তৈরি পোশাকও। বন্দর এবং কাস্টমস সপ্তাহের সাতদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা না থাকায় রফতানিকারকরা লিড টাইম অনুযায়ী পণ্যের বুকিং দিতে পারছিলেন না বলে অভিযোগ তাদের। সমুদ্র পথে জাহাজীকরণ করতে না পারায় আকাশ পথে রফতানি করতে হয় পণ্য। এতে চার্জ গুনতে হয় অনেক বেশি। এদিকে, সপ্তাহে সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা চালু রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষও গ্রহণ করেছে ২১টি সিদ্ধান্ত। কাস্টম হাউস, চিটাগাং চেম্বার, বিজিএমইএ, সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েসন, বেসরকারী আইসিডি মালিকদের সংগঠন, শিপিং এজেন্টস এ্যাসোসিয়েসনসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়। উদ্দেশ্য পণ্য খালাস এবং ডেলিভারিতে গতি বাড়ানো এবং ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি। কাজে গতি বাড়াতে সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সকল পক্ষ। এ লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাস্টমস হাউসসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সঙ্গে একাধিক দফায় বৈঠক করেছে। সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালকের (পরিবহন) নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সকল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট এবং সুপারিশ প্রদান করবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বন্দর সূত্রে জানা যায়, যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এলসিএল কন্টেনার জাহাজ থেকে নামানোর দু’দিনের মধ্যে শুল্কায়নসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা, এফসিএল (ফুললোড) কন্টেনারের শুল্কায়ন এবং খালাস দিনে দিনেই সম্পন্ন করা, বৃষ্টিপাতের জন্য যেন আনস্টাফিং ও শুল্কায়ন কার্যক্রম ব্যাহত না সেজন্য একটি স্থান নির্ধারণ করা, ৩৭ ধরনের পণ্যের কন্টেনার সরাসরি অফডকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শতভাগ কার্যকর করা, বেসরকারী আইসিডিগুলো নীতিমালা মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা তা তদারক করা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওভারফ্লো ইয়ার্ড নির্মাণ ও চালু করা, গ্রীন চ্যানেল চালু করতে কাস্টমসের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমদানি পণ্যের বিল অব এন্ট্রি দাখিল এবং শুল্কায়ন কাজ সম্পন্ন করা। এ সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করা গেলেই বন্দর কাস্টমস সার্বক্ষণিক খোলা রাখার সুফল পুরোপুরি মিলবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা।
×