ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফের রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর, জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৪ আগস্ট ২০১৭

ফের রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর, জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ

সমুদ্র হক/মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া থেকে ॥ বগুড়ার ধর্ষক তুফান সরকার, তার ভাই, ক্যাডার ও আত্মীয়দের নানা কুকীর্তির খবরগুলো মিডিয়াতে আসার পর দেশজুড়ে নিন্দা ও ধিক্কারের যে ঝড় উঠেছে তা থামছেই না। একে একে বের হয়ে আসছে খবরের আড়ালের খবরগুলো। এদিকে তুফান সরকার তার ভাই মতিন সরকারকে যথাক্রমে শ্রমিক লীগ ও যুবলীগ থেকে বহিষ্কারের পর বগুড়ার সুধীজন বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। একই সঙ্গে লোকমুখে উচ্চারিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন ঐতিহ্যের এই রাজনৈতিক দলে পৌরসভার সংরক্ষিত নারী আসনের বিএনপির নেত্রী তুফান সরকারের জ্যাঠাস মার্জিয়া হাসান রুমকির জায়গা হয় কি করে! মাত্র পাঁচ মাস আগে রুমকি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করেই আওয়ামী মহিলা লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদ পেয়ে যান। এই সেই রুমকি যার বাড়িতে ধর্ষিতা তরুণী ও তার মাকে সন্ত্রাসীদের দিয়ে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারপিট ও অমানবিক নির্যাতনের পর নাপিত ডেকে মা ও মেয়ের চুল কেটে ন্যাড়া করে দেয়া হয়। বুধবার বিকেলে বগুড়ার অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নাপিত জীবন ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনায় জবানবন্দী দিয়েছে। বগুড়ার সুধীজন মার্জিয়া হাসন রুমকিকেও দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে। তারা সরাসরি বলেছেন, মাদক সম্রাট, অস্ত্র ব্যবসায়ী, হত্যাকারী, ধর্ষক, চোরাকারবারিসহ কোন দানব-দানবী যেন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনে যোগ দিতে না পারে। এরাই প্রাচীন ঐতিহ্যের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করছে। সুধীজনের এমনও আশঙ্কা : তুফান সরকার মতিন সরকার ও তাদের ভাইদের বিরুদ্ধে এখনই যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া যায় এবং কোনভাবে তারা যদি ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে কি অবস্থা হবে! ফের তো তারা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। তুফান সরকারের কুকীর্তির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বগুড়ার মানুষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। পরিচিতজন ফোনে এই ঘটনা জানার পর শেষে উচ্চারণ করে ‘ছিঃ’। তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুনের বড় বোন মার্জিয়া হাসান রুমকি এতটাই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির সে কিভাবে জনপ্রতিনিধি হলো এনিয়েও এখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছে। তুফান সরকারের আত্মীয় (স্ত্রীর বড় বোন) হওয়ায় সে তুফানের ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করত। তার ভয়ে পৌরসভার অনেক অফিসার আতঙ্কিত থাকত। এলাকার লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করত, এমন বিস্তর অভিযোগ এখন বের হয়ে আসছে। তুফান সরকার তরুণীকে ধর্ষণের পর কিভাবে তুফান সরকারের লালিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে মা ও মেয়েকে অপহরণ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে তার বর্ণনা শুনলে যে কোন সুস্থ মানুষ শিউরে উঠবে! ঘটনার দিন ২৮ জুলাই। ওই দিন ছিল শুক্রবার। দুপুরের দিকে তুফানের স্ত্রী আশা খাতুন, পৌর কাউন্সিলর রুমকির নির্দেশে তুফান সরকারের ক্যাডার সন্ত্রাসী আতিক, দীপু মুন্না ও শিমুল ধর্ষিতা তরুণী ও তার মাকে নামাজগড় বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তার পর সেই বাড়ি তালাবদ্ধ করে দেয়। ধর্ষিতা তরুণী ও তার মাকে নিয়ে যাওয়া হয় কাউন্সিলর রুমকির বাদুরতলা বাড়িতে। সেখানে আগে থেকেই ছিল তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন, জ্যাঠ শ্যালিকা রুমকি ও শাশুড়ি (আশা ও রুমকির মা) রুমী খাতুন। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরই রুমী খাতুন, রুমকি-আশা ও ক্যাডাররা মা- মেয়েকে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। ক্যাডার মুন্নাকে নাপিত ডাকতে পাঠানো হয়। মুন্না গাবতলী গিয়ে নাপিত জীবন রবিদাসকে জোর করে ধরে আনে। জীবন ঘরে ঢুকে নির্যাতনের এমন দৃশ্য দেখে চুল কাটতে রাজি হয় না। তার কাঁচি নিয়ে আশা রুমকি ও রুমী ধর্ষিতা নারীর চুল কাটে। ক্যাডাররা চুল কাটে মেয়ের মায়ের। তারপর নাপিতকে মা ও মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দিতে বলে তারা। নাপিত মাথা ন্যাড়া করে দেয়। নির্যাতনে মা ও মেয়ের অবস্থান অবনতি হলে তাদের শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ ধর্ষক তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন ও শাশুড়ি রুমী খাতুনের একদিনের রিমান্ডে শেষে বৃহস্পতিবার অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করা হলে পুলিশ অধিকতর তদন্তের স্বার্থে পুনরায় এই দুইজনকে পাঁচদিন করে রিমান্ডের আবেদন জানায়। এ সময় শুনানি শেষে আদালত ফের রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে পাঠায় এবং জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেয়। কে এই রুমকি চকসূত্রাপুর এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী জামিলুর রহমান রুনুর মেয়ে রুমকি গত পৌর নির্বাচনে ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়। রুমকির বাবাও বিএনপির ওয়ার্ডস্তরের নেতা। রুমকি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চানের ভাগ্নি। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করার পরই রুমকি মহিলা আওয়ামী লীগের বড় পদ (যুগ্ম সম্পাদক) পেয়ে নিজেকে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। তার ওপর তার ভগ্নিপতি তুফান সরকার ও আত্মীয় মতিন সরকারের ক্ষমতার দাপটে নিজেকে ক্ষমতাধর মনে করে। যখন তখন যে কাউকে হুমকি-ধমকি দেয়। অনেক সময় দুই বোন তুফানের গাড়িতে চরে মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসীদের স্কট নিয়ে ঘোরে। সে এতটাই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির যে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তার ভয়ে তটস্থ থাকত। ওদের ভয়ে কেউ মুখ খুলত না। এই রুমকিকে গ্রেফতার করার পর তাকে চারদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রুমকির বাড়িতে এখন কেউ নেই। বাড়ি তালাবদ্ধ দেখা যায়। চকসূত্রাপুর এলাকার তুফান সরকার ও মতিন সরকারের যারা সহযোগী তারা গা ঢাকা দিয়েছে। দুদকের তদন্তের প্রস্তুতি সম্পন্ন অল্পদিনেই তুফান সরকার তার ভাই মতিন সরকার, সোহাগ সরকার, ঝুমু সরকার, পুতু সরকার, জাহাঙ্গীর সরকার, ওমর সরকারের এত বিত্ত-বৈভব কিভাবে হলো দুদক তা দ্রুতই তদন্ত করবে। ইতোমধ্যে অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্তের জন্য ওপর মহলে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, তদন্তের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করা হচ্ছে, দু’একদিনের মধ্যে অনুমোদন আসবে। মতিন সরকারের ওয়ারেন্ট পাওয়া গেছে পুলিশ সুপার জানান, তুফান সরকারের ভাই মতিন সরকারের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো দায়ের করা আছে তার একটির ওয়ারেন্ট বুধবার রাতে বগুড়া থানায় এসেছে। শীঘ্রই ওয়ারেন্ট তামিল করা হবে। তুফার সরকার ও মতিন সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো পর্যালোচনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাটবাজার ইজারা দখল তুফান সরকার ও তার ভাইয়েরা বগুড়া জেলার যত হাটবাজার আছে তার ইজারা নিত জোর করে। জায়গা-জমির মতো ইজারাও দখল করেছে তারা। অসৎ উদ্দেশ্যে যে জায়গা দখল করতে চেয়েছে তুফান সরকার ও তার ভাইয়েরা সন্ত্রাসী পাঠিয়ে তা দখল করে দিয়েছে। এ জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ তারা হাতিয়ে নিয়েছে। মানববন্ধন ও সমাবেশ বৃহস্পতিবার সকালে শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, মানবাধিকার সংগঠনের বিভিন্ন সংস্থা, পেসডসহ কয়েকটি এনজিও ও ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধর্ষক তুফান ও তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি নুরুন্নবী বুলু, সহসভাপতি আমিনুল হক, নির্বাহী সদস্য কানিজ রেজা, রাশিদা খাতুন, এমদাদুল বারী প্রমুখ। পুলিশ সুপারের বক্তব্য বগুড়ার পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, এই ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হচ্ছে। এজাহারে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের পর তাদের জবানবন্দীতে অনেক প্রমাণ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এমন কিছু আলামত ও সাক্ষী আছে যা অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। এই ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। খুবই দ্রুত এই দুই মামলার (ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন) তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া যাবে, এমনটিই আশা করেন তিনি। এক সূত্রে জানা গেল, মা-মেয়ের চুল কাটা ও ন্যাড়া করার ঘটনার ভিডিও করেছে রুমকির মেয়ে। এই বিষয়ে পুলিশ সুপার জানান, ভিডিও করা থাকলে তা সংগ্রহ করা হবে। তবে ওই দিনের ঘটনায় নাপিতের যে জবানবন্দী পাওয়া গেছে তাই মামলার সাক্ষ্য দেবে।
×