ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাপিত রবি দাসের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী

তুফান ও তার সহযোগীরা ফের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩ আগস্ট ২০১৭

তুফান ও তার সহযোগীরা ফের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বগুড়ার আদালত বুধবার দেশজুড়ে আলোচিত বর্বরোচিত ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তুফান সরকার (শ্রমিক লীগ থেকে বহিষ্কৃত) এবং তার সহযোগী ক্যাডার মুন্নাকে দুইদিন করে, তুফানের স্ত্রী আশা ও শাশুড়ি রুমি খাতুনকে একদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এছাড়া, শুধু নাপিত রবিদাস জীবন এদিন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তুফান সরকারের তিন সহযোগী ক্যাডার আতিক, দীপু ও রূপমকে তিনদিনের রিমান্ড শেষে বুধবার বিকেলে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাদের বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছিল। একই সঙ্গে দুইদিনের রিমান্ড শেষে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন, শাশুড়ি রুমি খাতুন, ক্যাডার মুন্না ও জিতুকে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ অধিকতর তদন্তের স্বার্থে তুফান সরকার, তার স্ত্রী আশা খাতুন ও শাশুড়ি রুমী খাতুনের প্রত্যেকের সাতদিন করে রিমান্ড চায়। এ্যাকশনে যাচ্ছে পুলিশ একই দিনে বগুড়ার ঘটনা নিয়ে পুলিশের উর্ধতন মহল জরুরী সভা করেছে। সূত্র জানায়, বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক তুফান সরকারের মেজো ভাই মতিন সরকারের (যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত) যে মামলাগুলো ঝুলে আছে বা কোন কারণে বন্ধ হয়ে আছে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি মামলায় পুলিশের নথিতে সে পলাতক (!) আছে। পুলিশ জানায়, তারা জেনেছে এ বছরের ২০ জুন একটি হত্যা মামলায় মতিন সরকারের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। পুলিশ এই বিষয় নিয়ে খোঁজ খবর করছে। সাইকোলজিক্যাল ট্রমায় ধর্ষিতা তোলপাড় করা এই ঘটনার ধর্ষিতা তরুণী সাইকোলজিক্যাল ট্রমায় আক্রান্ত। অত্যাধিক মানসিক চাপ অব্যাহত থাকলে মনস্তাত্ত্বিক এই আঘাত দীর্ঘায়িত হতে পারে। তা হলে এই ট্রমা ক্রনিক পর্যায়ে চলে যাবে। তখন মানসিক অসুস্থতা বিপর্যয়ের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে। সে বর্তমানে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের ২৯ নম্বর কেবিনে আছে। মঙ্গলবার বিকেলে সে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘটনার জবানবন্দী দেয়। বর্তমানে ধর্ষিতা তরুণী ও তার নির্যাতিতা মা শজিমেক হাসপাতালে পুলিশের নিরাপত্তায় রয়েছে। এদিকে বগুড়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-১ শিশু আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ্যাডভোকেট আমানউল্লাহ্র এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই আদালতের বিচারক ধর্ষিতা তরুণীর নিরাপত্তা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য বগুড়া পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ্যাডভোকেট আমানউল্লাহ্ এই বিষয়ে বলেন, ধর্ষিতা তরুণীর মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স বর্তমানে ১৪ বছর ৩ মাস। যদিও তার বাবা বলছেন মেয়ের বয়স ১৭ বছর। মেয়েটির বাবা পিপি আমানউল্লাহ্কে বলেন, যে ঘটনা ঘটল তারপর পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা কঠিন হবে। কারণ তুফান সরকার মতিন সরকারের লালিত সন্ত্রাসীরা এতটাই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির যে গডফাদারের নির্দেশ পেলে তারা নৃশংসভাবে মানুষ খুন করে। এই অবস্থায় কি করে তারা নিরাপত্তা পাবে। ধর্ষিতার মেয়ের বাবার এই আকুতির প্রেক্ষিতে পিপি আমানউল্লাহ শিশু আদালতে আবেদন করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বগুড়ার জঘন্য কলঙ্কিত এই ঘটনার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে তিনি লড়বেন। মতিন সরকার, তার ভাই ও সাঙ্গোপাঙ্গরা পালিয়েছে তুফান সরকারের মেজো ভাই বগুড়া শহর যুবলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম সম্পাদক মতিন সরকার, তার সন্ত্রাসী ভাই ও সাঙ্গোপাঙ্গরা পালিয়ে গেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দল থেকে বহিষ্কার করার পর তাকে ও তার ভাইদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ক্যাডারওরাও আত্মগোপন করেছে। এলাকার লোক জানায় ওইদিন দুপুর পর্যন্ত সে চকসূত্রাপুর বাড়িতে ছিল। তবে বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করত না কথা বলত না। ধর্ষিতার জবানবন্দীর উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্ষিতা তরুণী (মা বাবার একমাত্র মেয়ে) এ বছর বগুড়া জুবিলী হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে। তার ফলাফল নিম্ন গ্রেডে ছিল। সে চকযাদু রোড দিয়ে বাড়িতে যাতায়ত করত। চকযাদু রোডেই তুফান সরকারের তূর্য স্যানেটারি স্টোর। সে ও তার ক্যাডাররা তরুণীকে রিক্সায় চলাচল করতে দেখত। তরুণীর মাথার চুল ছিল দীর্ঘ। সহজেই নজর কাড়ত। তুফান সরকারেরও নজর কাড়ে। তুফান তার ক্যাডারদের দিয়ে মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করত। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি জানত তুফানের স্ত্রী আছে। সে নাকচ করে দেয়। মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে মেয়েটি কৌশলে ভুল নম্বর দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তুফান। ঘটনা প্রবাহে তুফানের ক্যাডাররা জানতে পারে মাধ্যমিকে মেয়েটির ফলাফল ভাল না। সে সরকারী আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। সুযোগটি কাজে লাগায় তুফান। সে মেয়েটিকে জানায়, কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবে। কাগজপত্র নিয়ে যেতে বলে। মেয়েটি কাগজপত্র দেয়। পরে ভর্তি করাতে পারে না। গত ১৭ জুলাই তুফান তার ক্যাডারদের দিয়ে খবর পাঠায় এই দিন তুফান সরকার স্ত্রীকে আনার জন্য ঢাকায় যাবে। মেয়েটি যেন বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্র নিয়ে আসে। তুফান সরকার মেয়েটিকে আনার জন্য তার গাড়ি ও ড্রাইভার জিতুকে পাঠায়। মেয়েটি গাড়িতে করে তুফান সরকারের বাড়ি আসে। গিয়ে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে যায়। ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে বাইরে প্রহরা বসায় তুফান সরকার। গাড়ি চালক ও দুই ক্যাডার আতিক ও মুন্না দরজার ওপারে প্রহরা থাকে। তুফান সরকার মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি রাজি না হলে জোর করে ধর্ষণ করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পর তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন ও তার জ্যাঠাশ (আশার বড় বোন) পৌর নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি ক্যাডার দিয়ে মা ও মেয়েকে জোর করে ধরে এনে নির্যাতন চালায়। এ সময় সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে নেয়। ধর্ষিতা ও তার মায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির অভিযোগ আনে। এক পর্যায়ে গাবতলী থেকে রবিদাস জীবন নামের এক নাপিতকে ডেকে নিয়ে এসে মা ও মেয়ের মাথার চুল কেটে ন্যাড়া করে দেয়। নির্যাতনে তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই দিন মা ও মেয়েকে শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে খবরটি পুলিশে জানানো হলে পুলিশ গিয়ে সব শুনে মামলা দায়ের করে নিয়ে পরদিন ২৯ জুলাই ভোরে তুফান সরকার ও তার তিন সহযোগী ক্যাডার আতিক, দীপু ও রূপমকে গ্রেফতার করে। দুই দিনের মধ্যে মামলায় এজাহারভুক্ত ৯ জন, নাপিত ও সন্দেহভাজন দুইজনসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
×