ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লন্ডনে লর্ড কার্লাইলরা জামায়াত-বিএনপির লবিস্ট

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩ আগস্ট ২০১৭

লন্ডনে লর্ড কার্লাইলরা জামায়াত-বিএনপির লবিস্ট

সাজিয়া স্নিগ্ধা, লন্ডন থেকে ॥ রাজনীতি নিয়ে যারা একটু পড়াশোনা করেন লর্ড কার্লাইলয়ের নাম তাদের কাছে খুব বেশি অপরিচিত নয়। বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী বক্তব্যে সবসময় এই ব্যক্তিটির উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ২০১২ সালে সারাদেশের মানুষ যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ তখন ঘাতকদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন লর্ড কার্লাইল। ২০১২ সালের ২৯ নবেম্বর বাংলাদেশ সরকারের কট্টর সমালোচনা করেন তিনি। দেশেও আন্তর্জাতিক সব জায়গায় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ঠেকাতে তদবির করতে থাকেন এই লর্ড। ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জামায়াতের ওয়েবসাইটে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লেখা সাবেক সৌদি কূটনীতিক ডঃ আল খামদির লেখায় তার প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। সে বছরই লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশনকে আবেদন করে একটি চিঠিও পাঠান তিনি। যেটিতে লেখেন সরকার পক্ষের আইনজীবী, আসামি পক্ষের আইনজীবী, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করতে বাংলাদেশ যেতে চান তিনি এবং এই বৈঠকের সময় সরকারের কোন লোক যেন উপস্থিত না থাকেন। ২০১৩ সালের ৭ জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন লর্ড কার্লাইল। ২০১৩’র ২০ সেপ্টেম্বর আবারও ইউনাইটেড ন্যাশনের হিউম্যান রাইটস কমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের কাছে একটি বিশাল চিঠি লেখেন লর্ড কার্লাইল। যেখানে ইরাক, সিরিয়া, মিসরের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হয়। আর বলা হয়, নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের সমালোচকরা নিয়মিত গ্রেফতার এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা এবং বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করেছেন কয়েকবার। কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় নিয়ে উদ্বেগ, নিয়মবহির্ভূত বিচারের অভিযোগ করেন তিনি। মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প নির্ধারণেরও সুপারিশ করে জাতিসংঘকে অবিলম্বে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১৯ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন লর্ড কার্লাইল। জামায়াতের ওয়েবসাইটে তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের কসাইখ্যাত কুখ্যাত মীর কাশেম আলীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ বাতিলের জন্য জাতিসংঘে জোর লবিং করেছিলেন লর্ড কার্লাইল। এ নিয়ে তার একটি বিবৃতি ১ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। ২০১৪’র ৭ নবেম্বর লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশনকে যুদ্ধাপরাধী কামরুজ্জামান এবং জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় ২ নেতার ফাঁসির আদেশ বন্ধের জোর দাবি জানিয়ে চিঠি দেন লর্ড কার্লাইল। জামায়াতের সহসম্পাদক কামারুজ্জামানের রায় এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে শঙ্কা এবং প্রশ্ন করেন কার্লাইল। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত সকল প্রমাণিত অভিযোগ এবং রায় অবিলম্বে স্থগিত করার জোর দাবিও জানান। ২০১৫’র ২৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিএনপির সংলাপের জোর দাবি জানান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের স্বতন্ত্র এই সদস্য কার্লাইল। ২০১৫’র ১০ এপ্রিলে কুখ্যাত রাজাকার কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ নিয়ে লর্ড কার্লাইলের হতাশা এবং মন্তব্য ব্রিটিশ মিডিয়াতে ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৫’র ১০ এপ্রিল হাউস অব লর্ডের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে লর্ড কার্লাইল ৯ মে ২০১৩ তে দেয়া কুখ্যাত রাজাকার কামারুজ্জামানকে দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের তীব্র সমালোচনা করে বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। ১১ নবেম্বর ২০১৫ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার প্রক্রিয়া যখন চলছিল তখন লর্ড কার্লাইল এক বিশাল আর্টিকেল লেখেন সালাউদ্দিন কাদেরের সাফাই গেয়ে। যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা এবং কার্যক্রম আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডের সিনিয়র সদস্য এবং আইনজীবী লর্ড আলেকজান্ডার চার্লস কার্লাইলের বাংলাদেশ সম্পর্কিত দীর্ঘ ইতিহাস বলার হেতু তৈরি হয়েছে কদিন আগে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনার কেন্দ্র করে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের কড়া নেড়ে যখন ব্যর্থ লর্ড সাহেব তখন তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসের আর্চবিশপ রুমে পরস্পর বিপরীতমুখী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতকে এক মঞ্চে আলোচনা সংলাপের জন্য বসাতে চেয়েছিলেন তিনি। যিনি সবসময় বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কট্টর সমালোচনা করেছেন, দেশের আইন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছেন, এমন একজন মানুষের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের লন্ডনে আগমন নিঃসন্দেহে বিস্মিত করেছে অনেককে এবং নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে কি করেনি তার চেয়েও বড় কথা বিতর্কিত একজনের আমন্ত্রণে লন্ডনে আগমন। যদিও তারা বলেছেন যে তারা জানতেন না এটি ব্যক্তিগত, কিন্তু লর্ড কার্লাইল সেটিও অসত্য বলে দাবি করেছেন এবং আমন্ত্রণপত্রের একটি কপি ইমেল বার্তায় পাঠিয়েছেন। যাতে পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে এটি রুদ্ধদ্বার ব্যক্তিগত বৈঠক। সরকারের প্রতিনিধি কোন দেশ, সংগঠন বা ব্যক্তির আমন্ত্রণে যাওয়ার আগে সেই আয়োজনটি সম্পর্কে, ব্যক্তিটি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার মতো যথেষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে। কিন্তু লন্ডনে এসে, জেনে, তথ্য খোঁজখবর নিয়ে তারপর বর্জন করাটা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা অনুমেয়। এর আগেও আমরা দেখেছি বিএনপি জামাত হাউস অব লর্ডসে বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সার্বিক বিচার ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিভিন্ন কক্ষে আলোচনায় বসেছেন আন্তর্জাতিক নানা সংগঠন কিংবা ব্যক্তির আয়োজনে। কিন্তু ৩ বার ক্ষমতায় থেকেও সরকার দলীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কখনই হাউস অব লর্ডস কিংবা হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে বসতে দেখা যায়নি। ২০১২ সাল থেকে বিএনপি জামায়াতের পক্ষে কথা বলার জন্য হাউস অব লর্ডসের লর্ড কার্লাইল, আইনজীবী টবি ক্যাডমেনসহ অনেককেই সোচ্চার দেখা গেছে কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য লর্ড সভার কোন সদস্য বা আন্তর্জাতিক কাউকে সোচ্চার দেখা যায়নি। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সমালোচনায় ব্রিটিশ মিডিয়াগুলো যেভাবে সরব থাকে অসামান্য কভারেজ দিয়ে যায়, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে তেমন সরব কিংবা মিডিয়া কভারেজ দেখা যায় না। লন্ডনে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া রাজনৈতিক, সাধারণের কাছে প্রচার প্রচারণার জন্য লবিস্ট গ্রুপ নিয়োগ দিয়ে থাকে। লেবার পার্টি লিডার জেরেমি করবিন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিয়ার এবং মার্কেটিং এজেন্সি ফ্রেশওয়াটারের প্রতিষ্ঠাতা হোরেলকে তার নতুন ডেপুটি ডিরেক্টর অব স্ট্র্যাটেজিক এ্যান্ড কমিউনিকেশন্স নিয়োগ দিয়েছেন। যিনি লেবারের মিডিয়া স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কাজ করছেন। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিরও রয়েছে লবিস্ট এবং পি আর কোম্পানি। বিদেশে অভিনেতা, অভিনেত্রী রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল সকলেরই নিজস্ব নিয়োগকৃত পিআর কোম্পানি আছে। আমেরিকার নির্বাচনের আগে এবং পরে হিলারি ক্লিনটন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন পিয়ার কোম্পানির নিয়োগ দিয়েছেন। শোনা যায় ড. মোহাম্মদ ইউনূসও ব্রিটিশ পিয়ার কোম্পানি ব্যবহার করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিদেশীদের অযাচিত আগ্রহ, উপযাচক হয়ে এক মঞ্চে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনার আয়োজন দেখে ধারণা করা যায় বিএনপি জামায়াতেরও এ্যাপয়েনটেড পি আর কোম্পানি এবং লবিস্ট গ্রুপ রয়েছে যারা দিন রাত তাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং উজ্জ্বল করার জন্য দেশে কিংবা বিদেশে কোন প্রফেশনাল পি আর কোম্পানি বা লবিস্ট গ্রুপকে দেখা যাচ্ছে না মাঠে যা রাজনৈতিক অসচেতনতার শামিল।
×