ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনবল, যন্ত্রের অভাব

রাস্তা, সেতু স্থাপনা নির্মাণের মান পরীক্ষা করা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩ আগস্ট ২০১৭

রাস্তা, সেতু স্থাপনা নির্মাণের মান পরীক্ষা করা যাচ্ছে না

মশিউর রহমান খান ॥ অভিজ্ঞ জনবল আর প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব যন্ত্রের অভাবে দেশের রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্টসহ সকল স্থাপনা নির্মাণের যথাযথ মান পরীক্ষা করতে পারছে না স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। ফলে ঝুঁকি নিয়েই অবকাঠামো নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। সড়কে যান চলাচলের উপযোগিতা নির্ধারণ করতে না পারা, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সময়মতো মাটি পরীক্ষা করতে না পারা, সড়কের ভার বহন ক্ষমতা নির্ণয়কারী যন্ত্র না থাকা, কোন কোন ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি থাকলেও তা ব্যবহারের জন্য দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল না থাকার ফলে সড়কসহ সকল স্থাপনার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তবে সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তারও সঠিক প্রয়োগ সময়মতো করা হয় না। এছাড়া সঠিক সময়ে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে সারাদেশের পল্লী অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ মাধ্যম। আর নাগরিকগণ বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে নতুন ও পুরনো সকল রাস্তায় লাখো যানবাহন চালাচ্ছেন পাশাপাশি নির্মিত স্থাপনাগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে দৈনন্দিন কর্মকা- সম্পাদন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সারাদেশের পল্লী অঞ্চলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) পল্লী সড়ক রয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৮৯ কিলোমিটার। এর বাইরে রয়েছে ছোট-বড় কয়েক লাখ পুরাতন ও নির্মাণাধীন স্থাপনা। নির্মিত একটি সড়কে যান চলাচল কতটুকু উপযোগী তা নির্ণয় করতে যে মেশিন ব্যবহার করা হয় তার নাম রাফোমিটার। দেশের ৬৪ জেলায় ন্যূনতম দুটি করে রাফোমিটারের প্রয়োজন থাকলেও সারাদেশের লাখো কিলোমিটার সড়কের পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করতে মাত্র ১৬টি রাফোমিটার রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। আর এর মধ্যেও আটটি রাফোমিটারই নষ্ট রয়েছে। এতে সহজেই অনুমেয় যে সমস্যা কতটা প্রকট। দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসব পল্লী সড়কে দিন দিন যানবাহনের চাপ অতি দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। ফলে অধিক ব্যবহারের কারণে নষ্টও হচ্ছে তাড়াতাড়ি। এছাড়া সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়ন করতে থাকায় প্রতিনিয়তই পল্লী অঞ্চলে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করতে হচ্ছে। মূলত, প্রতিনিয়তই সড়কের চাহিদা বাড়লেও সে তুলনায় এলজিইডিতে সড়ক সংস্কার খাতে রক্ষণাবেক্ষণ বরাদ্দ বাড়ছে না। জানা গেছে, সড়কের যান চলাচলের উপযোগিতা নির্ণয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রটি রাজধানীর এলজিইডির প্রধান কার্যালয় থেকেই সরবরাহ করা হয়। ফলে প্রয়োজন হলেও অধিকাংশ সড়কে ও স্থাপনায় মান নির্ণয়ের পরীক্ষাটি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দুর্বলভাবেই সরকারের শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হচ্ছে স্থাপনা। যার প্রভাবে পরবর্তীতে রাস্তায় চলাচলে সরাসরি জনগণকেই অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। এলজিইডি সূত্র জানায়, সংস্থাটির অধীনে বিদ্যমান সড়ক ও সড়ক অবকাঠামোর বর্তমান সম্পদ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গুরুত্বপূর্ণ এসব জাতীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে ন্যূনতম ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে প্রতিবছর কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ফলে সঠিক সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত সকল সড়ক ও স্থাপনা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পল্লী অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ মাধ্যম নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে সড়কে চলাচলকারী পরিবহনের ভার বহন ক্ষমতা নির্ণয়কারী যন্ত্র রয়েছে মাত্র দুটি। সরকার নিয়মিত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কথা বললেও এ জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম প্রদান করছে না। বর্তমান সরঞ্জামাদি দিয়ে সারা দেশের সকল ক্ষতিগ্রস্ত নতুন-পুরাতন সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ফলে বছরের পর বছর অনেক সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকলেও সেগুলো মেরামত করা যাচ্ছে না। আবার কোন কোন সড়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অনায়াসে একাধিকবার মেরামত করা হচ্ছে, যদিও তা কিছুদিন পরই পুরনো অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এ ধরনের মানহীন রক্ষণাবেক্ষণের কারণে সরকারের বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে। এলজিইডি সূত্র জানায়, সংস্থাটির বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে মাটি পরীক্ষার জন্য ২০০৪ সালে প্রায় ১ কোটি টাকা দিয়ে একটি কোন পেনিট্রেশন টেস্ট (সিপিটি) যন্ত্র কেনা হয়। হাইওয়েসহ সব ধরনের সড়ক, সেতু ও অবকাঠামো নির্মাণে যন্ত্রটি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের মতে, যন্ত্রটির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চারজন সহযোগীসহ অন্তত একজন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। এ যন্ত্রটি ২০১০ সাল থেকে কিছু বড় অবকাঠামো নির্মাণে যন্ত্রটির ব্যবহারও করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ বছরেও শুধু বিশেষজ্ঞের অভাবে এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা আজও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এলজিইডিকে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ করতে হচ্ছে। মেশিনটি সম্পর্কে জানা গেছে, নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান জিইও মিল এই যন্ত্রটি কেনা হয়। নিয়মানুযায়ী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যন্ত্রটির ব্যবহারসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করার কথা। কিন্তু এত বছরেও কেউ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। তবে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়াই বরিশাল, সিলেট ও টাঙ্গাইলের কিছু বড় সেতু এবং রূপগঞ্জ পাওয়ার প্লান্টের মতো কয়েকটি বড় প্রকল্পে যন্ত্রটির আংশিক ব্যবহার করেছে এলজিইডি।
×