ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হজফ্লাইট আজ থেকে স্বাভাবিক হয়ে আসবে ॥ মেনন

বলির পাঁঠা বিমানমন্ত্রী! বৈঠকে ধর্মমন্ত্রী ও সচিব অনুপস্থিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ আগস্ট ২০১৭

বলির পাঁঠা বিমানমন্ত্রী! বৈঠকে ধর্মমন্ত্রী ও সচিব অনুপস্থিত

আজাদ সুলায়মান ॥ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন গাফিলতি ও আগাম প্রস্তুতি না নেয়ায় হজ ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। একের পর এক ফ্লাইট বাতিলে বিমানের হজফ্লাইটে চরম বিপর্যয়ের পরও টনক নড়েনি মন্ত্রণালয়ের। হজ সঙ্কট এড়াতে বুধবার ডাকা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও ধর্মমন্ত্রী বা সচিবের অনুপস্থিতি অন্যদের মাঝে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। আর এজন্য গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে। তিনি যদিও সাংবাদিকদের অনেকটা আশ্বস্ত করেছেন, আজ বৃহস্পতিবার থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। এত বেশিসংখ্যক ফ্লাইট আর বাতিল করতে হবে না। এরপরও যদি দু-একটি ফ্লাইট বাতিল হয়, শেষের দিকে অতিরিক্ত শ্লটের মাধ্যমে পুষিয়ে নেয়া হবে যাতে সবাই হজে যেতে পারেন। এ সময় তিনি জানান, কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ সৌদি হজ কর্তৃপক্ষের মোয়াল্লেম ফি বৃদ্ধি, একাধিকবার হজপালনকারীদের জন্য অতিরিক্ত দুই হাজার রিয়াল ফি ধার্য ও ই-হজ সিস্টেমে ধীরগতির কারণে একের পর এক বাতিল করতে হচেছ হজ ফ্লাইট। তবে এসব ব্যর্থতার দায় কার প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী তা এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলেছেন, এখন কাজ করার সময়। কারও দোষ না ধরে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় সেটা নিয়ে সবাই মিলে কাজ করতে হচ্ছে। এজন্যই আজ আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে। উল্লেখ্য, হজ প্যাকেজ ঘোষণার বহু পরে সৌদি কর্তৃপক্ষ যারা ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হজ করেছে- তাদের কাছ থেকে ২ হাজার রিয়েল (৪৪ হাজার টাকা) ধার্য করে। এজন্য ভিসা লজমেন্ট করার সময় অনলাইনে এ রিয়াল পরিশোধ করার অপশন দেয়া হয়। যারা পরিশোধ করতে রাজি তাদেরই ভিসার কাগজপত্রে অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু যারা রাজি নয়, তারা ভিসা পাচ্ছেন না। এজন্য প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার হজযাত্রী ভিসা জটিলতায় পড়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছেÑ কেন এ বিষয়টির নিষ্পত্তি আগে থেকেই করা হয়নি। এটা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল আগে থেকেই এ বিষয়টির নিষ্পত্তি করা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়- এ ধরনের একটা সঙ্কট দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল হজের আইটি পরামর্শক কোম্পানি বিজনেস অটোমেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত বছর ৩ অক্টোবর বিজনেস অটোমেশন থেকে এ চিঠি লিখেন সাবেক হজ পরিচালক অতিরিক্ত সচিব বজলুল হক বিশ্বাস। ধর্ম মন্ত্রণালয় ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তুচ্ছ বিষয় বলে উড়িয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে হাব মহাসচিব বলেন, একাধিকবার হজপালনকারীদের জন্য অতিরিক্ত ২ হাজার রিয়াল ধার্য করার বিষয়টি শুধু বাংলাদেশকে করা হয়নি-এটা গোটা বিশ্বের জন্য জন্য প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশ এ বিষয়টি তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করলেও বাংলাদেশ পারেনি। ধর্ম মন্ত্রণালয় যদি সঠিক সময়ে এ সমস্যার পদক্ষেপ নিতো তাহলে আজকে এ অবস্থা হতো না। এ সব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ধর্ম সচিব আব্দুল জলিল জনকণ্ঠকে বলেন, বিজনেস অটোমেশন আমাদেরকে এমন কোন চিঠি দেয়নি। তারা আমাদের আইটি কনসালট্যান্ট। তারা সৌদির খবর জানবে বা আশঙ্কা প্রকাশ করবে কি করে? ২ হাজার রিয়ালের সমস্যা তো শুধু বাংলাদেশের নয়, সারাবিশ্বের। এটা আমরা মোকাবিলা করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখেছি। তারা জবাব দেবে। সে অপেক্ষায় রয়েছি। আজকের বৈঠকে অনুপস্থিত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি না গেলেও আমার যুগ্ম সচিব গেছেন। এদিকে বুধবারের ডাকা জরুরী বৈঠকে ধর্মমন্ত্রী ও সচিবের কেউ উপস্থিত না থাকায় আরও এসব প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেনি কেউ। যদিও বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সাংবাদিকদের বলেছেন, আজ বৃহস্পতিবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। উন্নতি করতেই হবে। তবে অতিরিক্ত মোয়াল্লেম ফি, ভিসা প্রিন্টে জটিলতাসহ অন্য সমস্যার সমাধান দু-একদিনের মধ্যে না হলে হজ ফ্লাইটে জটিলতা আরও বাড়বে। সচিবালয়ে হজযাত্রী পরিবহন নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে মন্ত্রী বলেন, যাত্রী সঙ্কটে এ পর্যন্ত বিমানের বারোটি ও সৌদি এয়ারলাইন্সের তিনটি হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এতে বিমানের ক্যাপাসিটি লস হয়েছে ৪ হাজার ৩৮০, সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের লস হয়েছে ১ হাজার ২০০। বিমান পরিকল্পনার সময় এই লস হতে পারে ধারণা করে অতিরিক্ত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কিন্তু আজ কালের মধ্যে যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তখন এটা একটা সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রশংসা অর্জন করেছে। আমরা চাই না কোন ধরনের সমস্যা-সঙ্কট সৃষ্টি হোক। কিন্তু এ বছর খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে কতগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। যেগুলো আমাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। যেখানে আমরা প্রতি বছর দেখি প্রথম ১০ দিনে বড় সংখ্যক হজযাত্রী চলে যান। এবার তা সম্ভব হয়নি। এবার ৪৬ হাজার ৭৯২ জনের ভিসা হলেও ইতোমধ্যে সৌদি আরব পৌঁছেছেন ২৯ হাজার ৮৩৯ জন। আরও ৪৭ হাজার ৭৬১ জনকে পরিবহন করতে হবে। ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ বিমান এবং ২৮ আগস্ট সৌদি এয়ারলাইন্স যাত্রী নিয়ে সৌদি আরব যাওয়ার শ্লট নেয়া আছে। বিমানমন্ত্রী বলেন, যেখানে ভিসা হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৯২ জন, সেখানে হাজী গেছেন ২৯ হাজার ৮৩৯ জন। ১৭ হাজার হাজী যাদের যাওয়ার কথা ছিল তারা যেতে পারেননি। এখন জেদ্দায় আমাদের অবশিষ্ট যে হাজী পরিবহন করতে হবে তার সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার ৭৬১ জন। বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স মিলে এই পরিবহন করতে হয়। আমার চাই নির্বিঘেœ এ পরিবহন সম্পন্ন হোক। কারণ ২৬ আগস্ট বিমান ও ২৮ আগস্ট সৌদি এয়ালাইন্স সৌদি আরব যাওয়ার শেষ ফ্লাইট পরিচালনা করবে। তিনি বলেন, হজ প্যাকেজ ঘোষণার বহু পরে সৌদি কর্তৃপক্ষ যারা ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হজ করেছেন তাদের কাছ থেকে ২ হাজার রিয়েল (৪৪ হাজার টাকার কিছু বেশি) বেশি দাবি করেছে। এ ধরনের হজযাত্রীর সংখ্যা ৬ থেকে ৭ হাজারে দাঁড়াবে। শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের জন্য তারা এ ব্যবস্থা করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের হজ কাউন্সিলর ও দূতাবাসের পক্ষ থেকে সৌদি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা আজকে সব দেশের সঙ্গে ২ হাজার রিয়েলের বিষয়ে বসবে। এ অর্থ যদি দিতেই হয় তবে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি তারা যেন এটার বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেয়। ই-ভিসার প্রিন্টের ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, কোন গ্রুপে ১০০ থাকলে সেখানে ১৬ জনের ভিসা না হলে পুরো গ্রুপ ক্যান্সেল (ফ্লাইট) হয়ে যায়। এ সময় হজের সামগ্রিক কাজ মনিটরিং শুরু হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি বড় দায়িত্ব। অতীতে এ কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য প্রশংসা পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এবছর কিছু ঘটনা ঘটেছে, ফলে আমাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। বিমানমন্ত্রী বলেন, এবার সবার ই-ভিসা হচ্ছে। ধরা যাক একটা এজেন্সি একশ জনের জন্য আবেদন করেছে। ৮৬ জনের ভিসা প্রিন্ট হয়েছে, ১৪ জনের হয়নি। এই ১৪ জনের জন্য সবার হজযাত্রা আটকে যাবে। এছাড়া সৌদি এয়ারলাইন্সে যারা টিকেট কেটেছেন তারা সরাসরি হাজী ক্যাম্পে না উঠে বিমানবন্দরে যান। ফলে রাস্তার নানা ধরনের জটিলতায় সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেন না। তখন কিছু সময় বিমানটি অপেক্ষা করলেও শেষে তাদের রেখেই চলে যায়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে ১২, সৌদি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে তিনটি। আজকালের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে, যদি না হয় জটিলতা থাকবেই। আমরা সব সমস্যা সমাধান করে হজ যাত্রা নির্বিঘœ করব। যাদের ভিসা হয়নি তাদের ভিসা করতে ও যাদের ভিসা হয়েছে তাদের বিমানের টিকেট কাটার আহ্বান জানিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, এই বার্তা হজযাত্রীদের এসএমএসে জানানোর জন্য বিজনেস অটোমেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর হাবকেও বলা হয়েছে যেন এজেন্সিগুলোকে চাপ দিয়ে সঠিক সময়ে ভিসা ও টিকেট সংগ্রহ করে বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। আর যাতে কোন যাত্রী বিমানবন্দরে যেতে দেরি না করে সেটাও সার্বক্ষণিক নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাবকে। তিনি বলেন, সব কিছুর পরও সৌদি সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে বিমান কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট শ্লটের অতিরিক্ত শ্লটের জন্য আবেদন করেছে। যদি সৌদি সরকার আবেদনে সাড়া না দেয় তবে সরকারের পক্ষ থেকেও এ আবেদন করা হবে। হজযাত্রীরা নির্দিষ্ট হজ ফ্লাইটের বাইরে সিডিউল ফ্লাইটেও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। সবাই চেষ্টা করছি যাতে হজযাত্রা সহজ হয়। বিমান ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে কিনা- প্রশ্নর জবাবে তিনি বলেন, সমন্বয়ের কোন অভাব নেই। বারোটি ফ্লাইট বাতিলে বিমানের কতো ক্ষতির সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মেনন সঠিক উত্তর দেয়ার জন্য বৈঠকে উপস্থিত বিমানের এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদের প্রতি ইঙ্গিত করেন। জবাবে মোসাদ্দিক জানিয়েছেন, হিসাব-নিকাশ না করে এখনই তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে ধর্মমন্ত্রী বা সচিব কেন অনুপস্থিত একজন সাংবাদিক এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, আমাকে বলা হয়েছে মন্ত্রী ও সচিব অসুস্থ। মন্ত্রীর এ জবাব খ-ন করে ওই সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ধর্ম সচিব ওই মুহূর্তে নিজ অফিসের চেয়ারে বসে একটি টেলিভিশনকে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। তাহলে তিনি অসুস্থ হলেন কিভাবে? এ সময় মেনন বিব্রতবোধ করেন।
×