ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শূটার অন্তরার অন্তরের কিছু কথা...

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২ আগস্ট ২০১৭

শূটার অন্তরার অন্তরের কিছু কথা...

হতে পারতেন এক আর্টিস্টিক জিমন্যাস্ট। এতটাই ভাল খেলতেন যে এই খেলায় জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন দু’বার। অনেক পদকও আছে তার। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় জিমন্যাস্ট নন, তিনি হয়ে গেলেন শূটার! জেলা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গত দশ বছরে এ পর্যন্ত পদক জিতেছেন ১৯টি। যার কথা বলছি, তিনি অন্তরা ইসলাম। ১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া জাতীয় এই শুটার এখন তার ক্যারিয়ারের ক্রান্তিকাল পার করছেন। জটিল এক সীমারেখার মাঝ বরাবর দোদুল্যমান তার শূটিং ক্যারিয়ার। চোট, ফর্মহীনতা, আত্মবিশ^াসের ঘাটতি ও নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত অন্তরা এই প্রথম জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে বাদ পড়েছেন। সব মিলিয়ে টালমাটাল অবস্থায় তার ক্যারিয়ার। দু’ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় সুদর্শনা অন্তরা। জিমন্যাস্ট হিসেবে ২০০১ সালে ভর্তি হন সাভারের বিকেএসপিতে। একসময় বড় ধরনের ব্যাক প্রবলেমের কারণে ২০০৭ সালে বিকেএসপির ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নজীব হাসানের অনুমতি নিয়ে শূটিং খেলা শুরু করেন। সেখানকার চিকিৎসক ড. দেবাশিষও (এখন বিসিবিতে) অন্তরাকে একই পরামর্শ দেন। অন্তরার বাবা নজরুল ইসলামের (ইমপোর্টার, মাল্টিমিডিয়া ইলেকট্রনিক্স) এবং মা কিসমত আরার-ও (গৃহবধূ) খুব শখ ছিল তাদের মেয়ে যেন খেলোয়াড়ই হয়। এভাবেই শূটিংয়ে আসা। ২০০৮-১৬ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের খেলায় প্রতিবছরই তিনি মেডেল পেয়েছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল ২০১৬। ওই বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পর থেকেই তার জীবনের দুঃসময় শুরু। ঢাকার পরীবাগে অবস্থিত নিজেদের বাসায় বসে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জানা গেল অন্তরার অন্তরের কিছু কথা। ‘আমি তো সিনিয়র পিস্তল শূটার’... ২০১০ সালে বিকেএসপি থেকে বের হয়ে ঢাকা রাইফেল ক্লাবে জয়েন করা অন্তরা শুরুটা করেন এভাবে। ‘ফেডারেশনে নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর অবশ্য কয়েকবারই ক্যাম্পে গিয়েছি। তবে ধীরে ধীরে দেখলাম তারা আমাকে এখন আর সেভাবে ডাকছে না। তাদের পরিকল্পনা ছিল সিনিয়রদের রেখে ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে নতুন প্রতিভাবান শূটারদেরও ক্যাম্পে নিয়ে আসা হবে। আমরা এই উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। কিন্তু পরে দেখা গেল কিছু সমস্যার কারণে (সেটা হতে পারে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ে, যেটা সম্পর্কে আমরা অবগত না) এরকম হয়েছে। ফেডারেশনের আমাদের সেভাবে আগের মতো সহযোগিতা না করার সঙ্গে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে নিজের পারফরম্যান্সের অবনমন নিয়েও একরাশ হতাশা।’ একটু দম নিয়ে আক্ষেপের স্বরে অন্তরা বলেন, ‘ফেডারেশনের নতুন শূটারদের প্রাধান্যের বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তাই বলে নতুন কিছু খুঁজতে গিয়ে যদি পুরনোকে অবহেলা করা হয়, তাহলে পুরনোর আবেদন-গ্রহণযোগ্যতা-গুরুত্ব কিন্তু কমে হয়ে যায়। এটা চিরন্তন সত্য।’ গত বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পরেই অক্টোবরে ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। যদিও জাতীয় ওই আসরে তার রেজাল্ট আশানুরূপ ছিল না। ‘আমার শূটিং ক্যারিয়ারে এই প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে কোন পদক জিততে পারিনি।’ অন্তরা এখনও যেন বিশ^াস করতে পারছেন না ব্যাপারটা। কিন্তু তারপরও ফেডারেশন তাকে ডেকেছিল ন্যাশনাল লেভেলের একটা নিয়মের জন্য। সেটা হলোÑ কোন প্রতিযোগিতা শেষ হলে তাতে বিভিন্ন ইভেন্টে যাদের অবস্থান প্রথম থেকে ষষ্ঠ থাকবে, তাদের সবাইকেই ন্যাশনাল টিমের প্লেয়ার হিসেবে গণ্য হবে। এই নিয়মেই অন্তরা ক্যাম্পে ডাক পান (২৫ মিটার পিস্তল ইভেন্টে চতুর্থ এবং ১০ মিটার পিস্তল ইভেন্টে চতুর্থ/পঞ্চম হন... স্থানটা পুরোপুরি মনে নেই)। যাহোক, ক্যাম্পে যোগ দিয়ে অন্তরা পান দুই নতুন বিদেশী কোচ সার্বিয়ার মার্কো সকিক (অলিম্পিক লেভেলের শূটারদের কোচ) এবং ডেনমার্কের ক্লাউসকে। এরা দুজন মিলে টিম ভাগ করে দুই মাসের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করেন। এ নিয়ে অন্তরার ভাষ্য, ‘তবে আমাদের প্রথমে ওভাবে ব্রিফ করা হয়নি ওখানে দুই মাস থাকতে পারব কি না। মোট কথা, তারা যে প্ল্যানিংটা করেছেন, সেটা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করা খুব দরকার ছিল। করলে আমরা নিশ্চয়ই সেভাবে মেন্টালি নিজেদের প্রিপেয়ার্ড করতাম।’ অন্তরাদের বলা হয়, একমাস ট্রেনিংয়ের পর একটা সিলেকশন হবে। এ, বি, সি ... তিনটা দল হবে। এই দলগুলো থেকে অলিম্পিক দল তৈরি করা হবে। এই দলের বিপরীতে একটি ‘এ’ টিমও থাকবে। তবে কোচ মার্ক এই বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে যে কৌশল বা কর্মপন্থা প্রয়োগ করেন শূটারদের ওপর, তা ছিল শূটারদের জন্য একেবারেই নতুন ও ভিন্ন। যদিও কোচ বলেছিলেন তার ওপর আস্থ্ ারাখতে। অন্তরা ফিরে তাকান সেই সময়টায়, ‘আমিও আমার শূটিং পদ্ধতি পুরোপুরি পাল্টে ফেলে কোচের কথা বিশ^াস করি। এবং এখানেই সমস্যাটা হয়। একজন স্ট্যান্ডার্ড শূটার যখন তার লেভেল-পজিশন সবকিছু চেঞ্জ করে ফেলে, তখন নতুন কিছুতে অভ্যস্ত হওয়াতে কিছু সময় নেয়। আমারও নিয়েছে। নতুন বা উঠতি শূটারদের এই সমস্যা হয়নি। কেননা তারা তো আগে কোন পদ্ধতিই অনুসরণ করেনি, তাই নতুন পদ্ধতি শিখতে তাদের সময় লাগবে কম। তারপরও তখন আমার টেকনিকের এতটাই উন্নতি ঘটেছিল, গোটা ক্যারিয়ারেও তা ঘটেনি। অথচ ওই ক্যাম্প থেকে আমাকেসহ আরও কয়েকজনকে বাদ দেয়া হয়! কারণ হিসেবে বলা হয়, যে সময়টা বেঁধে দেয়া হয়েছিল, সে সময়ের মধ্যে ইমপ্রুভ করতে না পারা। এও বলা হয়, এখন আপাতত বাদ দেয়া হলেও পরে আবার ডাকা হবে। কিন্তু এখনও সেই ডাক পাইনি।’ ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে যে মানসিক ধাক্কা খেয়েছিলেন, তার নেতিবাচক প্রভাবে এরপর এ বছর জাতীয় এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েও সেখানেও কোন রেজাল্ট করতে পারেননি তিনি (নতুন আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারাটাও ছিল অন্যতম কারণ, হয়েছিলেন চতুর্থ)। ক্যাম্প থেকে একজন শূটার দূরে থাকলে একজন শূটারের জন্য মনোসংযোগ করা খুবই কঠিন। ‘কেননা শূটিং যতটা না শারীরিক খেলা, তারচেয়েও বেশি মানসিক খেলা। তাছাড়া শূটিং অনেক ব্যয়বহুল খেলা। আমার এতটা সামর্থ্য নেই যে নিজের খরচে একটা শূটিং রেঞ্জ তৈরি করে সেখানে অনুশীলন করার। ফেডারেশন অবশ্য আমাদের অনুশীলনের জন্য একটা রেঞ্জ দিয়েছে (১০ মিটার পিস্তল ইভেন্টের জন্য) শূটিং কমপ্লেক্সের পাশেই। কিন্তু ওটা এত ছোট এবং নন-স্ট্যান্ডার্ড যে, এতে অনুশীলন করে লাভ হচ্ছে না। তাছাড়া এই রেঞ্জে ২৫ মিটার পিস্তল ইভেন্টের অনুশীলন করা যায় না।’ গোদের ওপর বিষফোঁড়া। এর মধ্যেই আবার ডান হাতের কব্জিতে চোট পান অন্তরা। ক্যাম্পে না থাকায় নিজেকে ফিজিক্যালি ফিটও রাখতে পারছেন না। মেডিটেশন কোর্সও করা হচ্ছে না। ‘বাসায় থেকে এসব হয় না। যাহোক, এরপর থেকে বলতে পারেন স্ট্রাগল করে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত (বিবাহিত জীবন) এবং পড়াশোনা (ধানম-ির ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ থেকে ইংরেজীতে বিএ অনার্স) এই দুটো বিষয়ও চালাতে গিয়ে শূটিং ক্যারিয়ারটা এখন অনেকটাই টালমাটাল অবস্থায়। আত্মবিশ^াসের মাত্রাও কমে গেছে অনেকখানি।’ এই অবস্থা থেকে একজন শূটারকে একমাত্র কোচ এবং ফেডারেশনই পারে টেনে তুলতে। এটাই বললেন অন্তরা, ‘তাদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ থাকবে, এখন যারা ক্যাম্পে আছে, তাদের যেন আমার মতো সমস্যায় পড়তে না হয়। তাদের যেন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়। তারা যেন ছিটকে না যায়। ক্যাম্পের পরবর্তী ট্রেনিং সেশন বা কার্যক্রমগুলো আগেই যেন অবহিত করা হয়।’ সব মিলিয়ে পুরো জুলাই মাসটা অন্তরা ছিলেন শূটিংয়ের বাইরে। অথচ জুলাইয়ের শুরুতেই জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্যাম্পের বেশ কজন শূটার চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ায় তা আপাতত হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে অন্তরার ভাষ্য, ‘শুনেছি এটা সেপ্টেম্বরে হবে। একদিক দিয়ে আমার জন্য ভালই হলো। এই সময়ের মধ্যেই চেষ্টা করব চোটমুক্ত হয়ে, ফিট হয়ে এবং যতটা সম্ভব অনুশীলন করে নিজেকে প্রস্তুত করতে। আবারও প্রস্তুতি ভাল না হলে অংশ না-ও নিতে পারি। ফিফটি-ফিফটি চান্স। অংশ নিলেও কোন মেডেল পাওয়ার টার্গেট নেব না। টার্গেট থাকবে নিজের আগের রেজাল্টকে ছাপিয়ে যাওয়ার এবং হারানো আত্মবিশ^াস ফিরিয়ে আনার। সেটা পারলে পদক এমনিতেই আসবে। আসলে সবকিছুই নির্ভর করবে সময় এবং পরিস্থিতির ওপর।’ যারা ভাল প্লেয়ার, স্পন্সররা কেবল তাদের পেছনেই দৌড়াবে, এই নিয়মের ঘোর বিরোধী অন্তরা। এ ব্যাপারে তার যুক্তি, ‘যারা সম্ভাবনাময় ও নবীন, যারা খারাপ সময়ে, বিপদে বা সমস্যায় থাকে, তাদেরকেই বেশি স্পন্সর করা উচিত। তা না হলে তারা ওপরে উঠবে কিভাবে? স্পন্সরের বিনিয়োগ তারা অবশ্যই রিটার্ন দেবে।’ শূটিং নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা? ‘এখন যেভাবে চলছে, যদি সেভাবেই চলতে থাকে, তাহলে বুঝতেই পারছেন উত্তরটা হবে নেতিবাচক। যদি কোন ইউটার্ন আসে, যদি এটার কোন ভাল ভবিষ্যত অপেক্ষা করে থাকে, খারাপ সময়টা কাটিয়ে উঠে ভাল রেজাল্ট করতে পারি, তাহলে ইচ্ছা আছে শূটিংটা চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া স্পোর্টস সায়েন্স নিয়ে মাস্টার্স করার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করবো।’ শূটিংয়ে স্মরণীয় কোন ঘটনা? ‘হ্যাঁ আছে। ২০০৭ সাল। তিন মাসের জন্য নবীন শূটারদের নিয়ে একটি ঘরোয়া একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তাতে অংশ নিই ২৫ মিটার স্পোর্টস পিস্তল ইভেন্টে। এই পিস্তল দিয়ে এর আগে কখনই ফায়ার করা হয়নি। এটা ফায়ার করতে হয় পয়েন্ট টু-টু বুলেট দিয়ে। তখন ক্যাম্পে ছিলেন ইউ য়ি নামের চাইনিজ এক মহিলা কোচ। তিনি যখন আমাকে দিয়ে প্রথম ফায়ার করান, তখন ফায়ারের শব্দের তীব্রতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোন ধারণা ছিল না। মূল প্রতিযোগিতার সময় যখন পিস্তল দিয়ে একসঙ্গে পাঁচ-ছয়জন ফায়ার করে তখন তা গ্রেনেডের শব্দের মতোই শোনা যায়। ওই প্রতিযোগিতার মিল্ক-ব্রেকের সময় কয়েকজনকে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো ফায়ার করানো হয়। তখন ছিল বৃষ্টির মৌসুম। আমি চেয়ারে বসে খাচ্ছিলাম। ফায়ারের শব্দের চোটে-ভয়ে চেয়ার থেকে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে চিৎপটাং! হা হা হা!’ অন্তরার প্রিয় পিস্তল শূটার গ্রিসের আন্না কোরাকাকি। ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই বিয়ে করেছেন। স্বামী হাবিবুর রহমান। তিনিও ছিলেন বিকেএসপির ক্রিকেটার (এখন ব্যবসায়ী)। ‘আমাদের বিয়েটা হয় পারিবারিকভাবেই, যদিও পরিচয়টা ছিল আরও কয়েক বছর আগে থেকেই। মজার ব্যাপার আমার গ্রামের বাড়ি এবং শ^শুরবাড়ি একই জেলায়, চাঁদপুরে! স্বামীরটা বিশনদী ও আমারটা ফরিদগঞ্জে। এই কো-ইনসিডেন্স আমরা দুজনেই কেউই আসলে জানতাম না, পরে জেনেছি।’ চোট, ফর্মহীনতা, আত্মবিশ^াস ফিরে পেয়ে অন্তরা কি আসন্ন জাতীয় শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে আবারও পদকজয়ের উল্লাসে মেতে উঠতে পারবেন? সেটা বলে দেবে সময়ই।
×