ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বনানী থেকে নিখোঁজ ৪ তরুণের একজনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে নতুন জঙ্গী গ্রুপের সন্ধান

হলি আর্টিজানে হামলার আগে থেকেই তৎপর ‘রিটার্ন টু ইসলাম’

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২ আগস্ট ২০১৭

হলি আর্টিজানে হামলার আগে থেকেই তৎপর ‘রিটার্ন টু ইসলাম’

শংকর কুমার দে ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ‘রিটার্ন টু ইসলাম’ (আরটিআই) নামের এক নতুন জঙ্গী সংগঠন জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। মামুনুর রশিদ ওরফে কাজল ওরফে ইবনে আজিজুর রহমান নামের একজন এ সংগঠনের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জিহাদের জন্য সকলকে ইসলামের পতাকা তলে একত্রিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে এ জঙ্গী সংগঠন। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার আগে থেকেই এ জঙ্গী সংগঠনটি নব্য জেএমবি অর্থাৎ সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সঙ্গে একত্রিত হয়ে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ হওয়া চার তরুণের একজন একুশ বছর বয়সী কামাল ওরফে বিপ্লব হোসেন কামাল ওরফে সুন্নাহ কামাল ওরফে মাওলানা কামাল হোসেন বিপ্লবকে গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন এ জঙ্গী সংগঠনটির বিষয়ে তথ্য পেয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের দাবি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিটার্ন টু ইসলাম নামের জঙ্গী সংগঠনটি গঠিত হয় ২০১২ সালে। সিলেট এলাকায় সংগঠিত হয়ে সংগঠনটি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তৎপর হয়। জিহাদের জন্য সকলকে ইসলামের পতাকা তলে একত্রিত করার উদ্দেশে এ জঙ্গী সংগঠনের সৃষ্টি হয়। মামুনুর রশিদ ওরফে কাজল ওরফে ইবনে আজিজুর রহমান নামের একজন এ সংগঠনের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সিলেটে শাহজালাল উপশহর এলাকায় মুশফিকুল হকের সহযোগিতায় এ সংগঠনটি যাত্রা শুরু করলেও ক্রমেই তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। জঙ্গী সংগঠনের পক্ষে কর্মী সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ, জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকরণ ও হিজরতের পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পর্বসমূহ সম্পন্ন করার কাজ শুরু করা হয়। সদস্যদের মধ্যে জঙ্গী সংশ্লিষ্ট ভিডিও ও বিভিন্ন আর্টিকেলের পিডিএফ কপি আদান-প্রদান শুরু করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে লক্ষাধিক টাকা এ সংগঠনের ফান্ডে জমা করা হয়। রাজধানীর ফার্মগেটের একটি ভাড়া বাসায় সংগঠনটির নিয়মিত গোপন বৈঠক শুরু হয় বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গত ২৬ জুলাই রাজধানীর বাড্ডার আফতাব নগর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গোপন বৈঠক করার প্রস্তুতিকালে মুশফিকুল হক (২৪), বিপ্লব হোসেন কামাল ওরফে সুন্নাহ কামাল ওরফে মাওলানা কামাল হোসেন বিপ্লবী (২৬) ও মামুনুর রশিদ ওরফে আবু ইউশাকে (২৬) গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর মধ্যে কামাল হচ্ছেÑ রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ ৪ তরুণের একজন। কামালের সঙ্গে নিখোঁজ চারজনের মধ্যে অপর ৩ জন হলোÑ ইমাম হোসেন (২৭) ও হাসান মাহমুদ (২৬) এবং তাওহীদুর রহমান। গত সপ্তাহে রাজধানীর বাড্ডা থেকে র‌্যাবের হাতে কামাল গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া জবানবন্দীতে এ ধরনের তথ্য দিয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ তরুণদের অর্থের যোগানদাতা র‌্যাবের হাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হওয়া গার্মেন্টস মালিক ইমরান আহমেদও অনুরূপ জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে তারা বলেছে, নিখোঁজ তরুণরা গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার অনেকে আগে থেকেই জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবিতে যোগ দিয়েছে। নব্য জেএমবির আত্মঘাতী সেলের সদস্য হয়েছেন তারা। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালের প্রথমদিকে এ সংগঠনটির সঙ্গে নব্য জেএমবির সারোয়ার জাহান মানিক ও কানাডা প্রবাসী তামিম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আরটিআইর সাজিদ হাসান, জাইদুল হক জিহান, তৌহিদ ও তপুকে মহাখালীতে একটি অনুবাদ কেন্দ্রে চাকরি দেয় সারোয়ার জাহান মানিক। এ সময়ের পর থেকে আরটিআইর যোগাযোগ হয় জেএমবির সঙ্গে। এদের মধ্যে ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবরে গাজীপুরের পাতারটেকে র‌্যাবের অভিযানে অপুসহ ২ জন নিহত হয়। ৪ এপ্রিল ঢাকা থেকে র‌্যাবের হাতে জাইদুল হক জিহান গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিপ্লব হোসেন কামাল গত ৩ জুন বনানীর সি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৬৭/এ, মোস্তফা ম্যানসনের ৫ম তলায় ইন্টারকম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও টেলেক্স লিমিটেড নামে একই মালিকের দুইটি প্রতিষ্ঠান থেকে নিখোঁজ হন। একইদিনে আরও তিন যুবক নিখোঁজ হয়। এরা হলেনÑ ইমাম হোসেন (২৭), তাওহীদুর রহমান (২৬) ও হাসান মাহমুদ (২৬)। কামাল হোসেন নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করে বনানীর ওই প্রতিষ্ঠানে বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করত। হাসান মাহমুদ ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। আর ইমাম হোসেন ওই প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। নিখোঁজ তাওহীদুর রহমানের বাসা মহাখালীতে। তাওহীদুর মহাখালীতে একটি অনুবাদ কেন্দ্র পরিচালনা করত। নিখোঁজের ঘটনায় ৩ জুন রাতে কামাল হোসেনের মামা রশিদ আলম বনানী থানায় একটি জিডি করেন। পরদিন ইমাম হোসেনের বাবা বিল্লাল হোসেন বনানী থানায় আরও একটি জিডি করেন। নিখোঁজ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তারা জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সক্রিয় সদস্য বলে জানিয়েছে। গ্রেফতারকৃত মুশফিকুল মহাখালীতে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় আসলে ইমাম মেহেদী, বিপ্লব হোসেন কামাল ওরফে সুন্নাহ কামাল ওরফে মাওলানা কামাল হোসেন বিপ্লবী, তাওহীদসহ কয়েকজন তাকে মহাখালী কেন্দ্রিক সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সক্রিয় সদস্য হিসেবে প্রথমে অনুবাদক হিসেবে নিয়োজিত করে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া মামুনুর রশিদ ওরফে আবু ইউশা জানায়, সে ইমাম মেহেদী এবং তাওহিদের মাধ্যমে জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে জঙ্গীবাদী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। আরবি ভাষায় দক্ষতা থাকায় তিনি সাংকেতিক বার্তা সংশ্লিষ্ট এ্যাপস টেলিগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী সংশ্লিষ্ট আর্টিকেল সংগ্রহ করে অনুবাদের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও জঙ্গী সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার করার জন্য ইমাম মেহেদীকে বেশকিছু ভুয়া রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম প্রদান করেন। ইন্টারনেট হতে জঙ্গী সংশ্লিষ্ট ভিডিও সংগ্রহ ও সরবরাহ করত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শাহাদত আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ, জামায়াতুল মুজাহিদীন অব বাংলাদেশ, জাগ্রত মুসলিম জনতা, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলাম নামের ৭টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে আছে আরও ৩৩টি সংগঠন। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তবে এ ৩৩টি সংগঠনের নামের তালিকায় রিটার্ন টু ইসলাম নামের কোন জঙ্গী সংগঠনটির নাম নেই। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ বলেছেন, বিপ্লব হোসেন কামাল জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানান, গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার আগে থেকেই জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সদস্য হিসেবে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকরণ ও অংশগ্রহণের জন্য কর্মী সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিল। একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী সংশ্লিষ্ট ভিডিও, আর্টিকেল ইন্টারনেট হতে সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। গ্রেফতারকৃতরা পূর্বে রিটার্ন টু ইসলাম নামে একটি জঙ্গী সংগঠন করলেও পরবর্তী সময়ে তারা জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপ যোগ দেয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, রিটার্ন টুু ইসলাম সংগঠনটি জঙ্গী প্রচারণায় যুক্ত থেকে সুবিধা করতে না পেরে হয়তো জেএমবির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তবে এ সংগঠনটির সদস্য সংখ্যাসহ সার্বিক তৎপরতার সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছে কোন ধারণা নেই। রিটার্ন টু ইসলাম নামের জঙ্গী সংগঠনটি সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করছে।
×