ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদা ভাট্টি

সুশীল হওয়ার আসল তরিকা

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২ আগস্ট ২০১৭

সুশীল হওয়ার আসল তরিকা

বাংলাদেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আসলে কটি? এই প্রশ্নে প্রথমে আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় স্থানে বিএনপি, তৃতীয় স্থানে জাতীয় পার্টি বা জামায়াত, তারপরে একে একে বাম দলগুলোসহ অন্যান্য ছোট ছোট দলের নাম করবেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর বাইরেও যে একটি প্রকাশ্য ও প্রচ- ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তি এদেশে রয়েছে, সেটি যে কোন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই জানেন। মিডিয়ায় তাদেরকে সুশীল সমাজ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু একটু চোখকান খোলা রেখে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, তারা আসলে আওয়ামী লীগ, বিএনপির চেয়েও কখনও কখনও শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষ হয়ে ওঠে। যদিও তারা নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া থাকে সব সময়। একটু গোড়ার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে তার শাসনকাজের খুঁত খুঁজে বের করার জন্য যারা কলম ধরেছিলেন তারা মূলত তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই। বিশেষ করে চৈনিক ভাবধারায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্বই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে শুধু কলম ধরেছিলেন বলে ভুল হবে বরং তাদেরকে কখনও কখনও অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দেখা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে, তখন এই বঙ্গবন্ধু-বিদ্বেষীকূল রাতারাতি জেনারেল জিয়ার প্রশংসাকারী হয়ে যান। জেনারেল এরশাদের জামানাতেও তারা তাদের চরিত্র বদল করেনি। বোঝাই যেত যে, তারা আসলে কলম ধরেন বঙ্গবন্ধু ও তার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। না হলে কেন দুই সেনাশাসক ও তাদের আমলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি কিংবা সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে কোন গবেষণা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখল না? দুঃখজনক সত্য হলো, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও দেশের দুই সেনা শাসনকাল সম্পর্কে কোন শ্বেতপত্র প্রকাশ করেনি। আমরা স্মরণ করতে পারি শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের কার্যভার গ্রহণ করেন তখনকার কথা। আওয়ামী লীগ থেকেই বেরিয়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা রাতারাতি সুশীল বনে গিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না তা নয়, কিন্তু সেটা যখন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলা হয় তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, কতটা অসুয়া নিয়ে এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার আন্দোলনে যখন দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়, তখন রাতারাতি আমরা কিছু নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর চেহারা দেখতে পাই। রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে দেন শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলন করে। কথায় বলে, শেয়ালকে নাকি ভাঙা বেড়া দেখাতে হয় না। ক্ষমতার স্বাদ যে অপূর্ব, সেটি এই নিরপেক্ষ সুশীল শ্রেণী প্রমাণ করে দেন। দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো শুরু করে এবং এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি সুশীল-সেনা সম্মিলিত সরকার গঠন করেন। এর আগে তো বটেই কিন্তু ঠিক এই সময়টিতেই আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরেও একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষ রয়েছে, যারা মূলত নিরপেক্ষ কিন্তু সুযোগ পেলে তারাও সরকার গঠনে আগ্রহী একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে এবং প্রয়োজনে তারা সেনা তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক দল খুলতেও দ্বিধান্বিত নন। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে সরাসরি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। তাই কোন দিনই এদেশে যথার্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা সম্ভব নয় কারণ রাজনৈতিক জন্মদাগ মুছে ফেলে ওই দুটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কোন দিনই প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা করা সম্ভব নয়। আপনি যদি রাজনৈতিকভাবে সামান্য সচেতন হন তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, এই যে সুশীল রাজনৈতিক পক্ষটির কথা এতোক্ষণ বলেছি, তাদের মূল ও প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা বিরোধিতা। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা আরও লক্ষ্য করি যে, কোন ব্যক্তি অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেও যদি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন, তাহলে তাকে বা তাদেরকে আর সুশীল হিসেবে গণ্য করা হয় না। অথচ যারা অত্যন্ত কদর্যভাবে বেগম জিয়া ও বিএনপির ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রতি সমর্থনই কেবল নয়, একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ হাসিনার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করলেও তাদের সুশীলত্ব খারিজ হয় না। উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি না, নাম বলারও প্রয়োজন নেই, কারণ এদের সকলকেই আপনারা চেনেন এবং জানেন। যদি না চিনে থাকেন আসুন আবার তাদেরকে চিনিয়ে দেয়া যাক। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে যাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আলোচনার জন্য, তাদের নামের তালিকাটি একবার দেখুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন যে, এই সুশীল আসলে কারা? এবং কিভাবে তারা এদেশে সুশীল হয়ে উঠেছেন। প্রথমতঃ এদেশে সুশীল হতে হলে আপনাকে কোন না কোন এনজিওর সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো আপনাকে দুটি নির্দিষ্ট সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কলাম লিখতে হবে। এসব কলামে আপনি দুই হাতে খালেদা জিয়া বন্দনা করুন তাতে কোনই অসুবিধে নেই, আপনার সুশীলত্ব তাতে খারিজ হবে না। কিন্তু আগেই বলেছি, আপনি কোথাও যদি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রশংসায় এক লাইনও যদি লিখে থাকেন, তাহলে আপনি আর এদেশে সুশীল হবার যোগ্য নন। আরও মজার ব্যাপার হলো, আপনাকে সুশীল হতে হলে অবশ্যই দেশের রাজনীতির সমালোচনা করতে হবে এবং অ-রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার করে দিতে আপনাকে হয় সঙ্গ দিতে হবে এবং না হয় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করতে হবে। লক্ষ্য করে দেখুন একবার, এই যে যারা গিয়ে নির্বাচন কমিশনে আলোচনা করে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন সম্পর্কে মতামত দিয়ে এলেন, ১/১১ সরকারে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা কী ছিল? দেশকে বিরাজনীতিকরণে এদের বক্তব্য ও অবস্থান কী? এদের ক’জনের লেখায় আপনি দেশের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে দুটি ইতিবাচক তথ্য পাবেন? পাবেন না, কারণ এসব হয়েছে শেখ হাসিনার হাত ধরে। কোন আন্তর্জাতিক সেমিনারে এরা বাংলাদেশ বিষয়ে দুটি ইতিবাচক কথা বলেছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর থেকে ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সাফল্য বিষয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই। তাদের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি না ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে ধর্মাশ্রয়ী সন্ত্রাসের জন্ম ও বেড়ে ওঠার কথাও। এদের কেউই কোনদিন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে একটি বাক্য ব্যয় করেননি। অথচ এত বড় একটি ঘটনা, যে ঘটনা বাংলাদেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারত এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিঃশ্চিহ্ন করে দেয়ার এরকম নজির যে ইতিহাসে বিরল, সেকথা এদের কেউই যে তাদের জ্ঞানভা-ারে ধারণ করেন না, তার পক্ষে নতুন করে প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি না। নির্বাচন কমিশন তাদের তৎপরতা শুরু করেছে এবং এর ফলে দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। যদিও দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় প্রধান আবারও নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অধিকার সকল রাজনৈতিক দলের রয়েছে এবং সেটা যে কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে বহুবিধ কারণে হতে পারে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের ন্যায্য অধিকার প্রয়োগকে প্রতিহত করার চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ এবং এর চরম শাস্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। জাতীয় সংসদে অবিলম্বে নির্বাচন প্রতিহতের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণীত হওয়া উচিত বলেও বিশ্বাস করি। নির্বাচন কমিশনে গিয়ে আলোচনায় এই সুশীল রাজনৈতিক শক্তিটি বহুবিধ পরামর্শ দিয়ে এলেন, কিন্তু একথা কি একবারও বলেছেন যে, নির্বাচন বর্জন করা কোন রাজনৈতিক দলের নিজস্ব বিষয় হলেও নির্বাচন প্রতিহতের জন্য দেশের ভেতর মানুষ পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে আরো কঠোর হতে হবে? না, তারা সেটি বলবেন না। কারণ তারা আসলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সুশীল দল। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে সহিংসতা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে, তাকে তারা কোনভাবেই অপরাধ মনে করেন না হয়ত। যদি মনে করতেন তাহলে সেনা মোতায়েনের কথা বলার আগে নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারা কিংবা ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অন্তত একটি কি দুটি বাক্য ব্যয় করতেন। আমি প্রতিটি কাগজ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পেলাম না যে, তারা এরকম কিছু নির্বাচন কমিশনকে বলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, নির্বাচন কমিশনের মূল কাজ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তাতে কে এলো আর কে এলো না তা দেখার দায় ও দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। সংবিধান মেনে তফসিল ঘোষণা করে নির্দিষ্ট দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মধ্য দিয়েই তাদের দায় ও দায়িত্ব শেষ হওয়ার কথা। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে ডেকে আনা তাদের কাজ হতে পারে না। তবে নির্বাচন প্রতিহত করার কথা যারা বলবেন বা যারা তা করার চেষ্টা করবেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনেরই। একটু আগেই বলেছি যে, এমন কথা কেউ বললে তিনি তো আর সুশীল থাকতে পারবেন না। তাকে আওয়ামী লীগের ‘দালাল’ আখ্যা দিতে এক মিনিটও সময় লাগবে না। অতএব, এদেশে সুশীল হওয়া কোনদিনই যে আমার বা আমার মতো যারা বলবেন তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এ নিয়ে খেদ নেই। আমি এক্ষেত্রে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার একটি বাক্যকে বেদবাক্য মনে করি। তিনি এক সময় বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। বয়স হয়েছে, তাই শিশু সাজতে চাই না, আর পাগল? না বাবা, পাগল হওয়ারও সাধ নেই। আর এত সুশীলের ভিড়ে জায়গায়ই বা কোথায় নতুন সুশীল হওয়ার? [email protected]
×