ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী- সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২ আগস্ট ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী- সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ

আরাফাত মুন্না ॥ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগে দায়িত্বপালনকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধানের পরিপন্থী হিসেবে মত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয় হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপীল বিভাগের দেয়া রায়ে এমন মতামত দেন তিনি। ওই মামলায় সাত বিচারপতির মধ্যে প্রধান বিচারপতি তার রায়ের অংশে এ মতামত দেন। এ মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। তবে প্রধান বিচারপতির এ মতের সঙ্গে একমত হতে ‘অক্ষমতা’ প্রকাশ করেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ মামলার বিষয়বস্তু না হওয়ায় ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলছেন এখানে অন্য ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ এ মামলায় ইস্যু না হওয়ায় রায়ে আলোচনা থেকে বিরত থেকেছেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। এদিকে রায় প্রকাশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় অনুচ্ছেদ ১১৬ সম্পর্কে বলেছেন, এটা সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন সেখানে এটা পেলাম না। তিনি বলেন, রায়ের ভিতরে যাই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে কি বলা আছে সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট কোনটা, সেখানে কিন্তু ১১৬ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি বলব এটা একজন জাজের অভিমত হতে পারে। কিন্তু রায়ের শেষাংশে, যেটাকে অর্ডার অব দ্য কোর্ট আমরা বলি, সেখানে ১১৬ সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে ১১৬ বাতিল হয়েছে বলে ধরা যায় না’। অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় পড়েই মন্তব্য করবেন বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সাংবাদিকরা আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শুনেছি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। রায় পড়েই আমি মন্তব্য করব। গত ০৩ জুলাই আপীল বিভাগের দেয়া এ রায়ে পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি মঙ্গলবার প্রকাশ করে সুপ্রীমকোর্ট। সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে বিষয়ে সাত বিচারপতি একমত হলেও ছয় জন বিচারপতিই আলাদা আলাদা রায় দিয়েছেন। শুধু মাত্র বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, চতুর্থ সংশোধনীতে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রীমকোর্ট’ এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতাকে হত, সঙ্কুচিত, কুঠারের নিচে ফেলা হয়েছে। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন এবং ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দ প্রতিস্থাপন সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’ রায়ের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কনসেপ্টটি (ধারণা) হলো সেনাশাসক, পাকিস্তানের ও জিয়াউর রহমানের। কাজেই এটি পুনঃস্থাপনে আমি ব্যথিত।’ তিনি বলেন, সার্বিক কমেন্টস করতে হলে পুরো রায়টা পড়ে কমেন্টস করতে হবে। তবে আমার একটি দুঃখ রয়ে গেছে। সেই দুঃখ হলো সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে। টোটাল (পুরো) বিষয়টি দাঁড়ালো যে, সেনা শাসকদের আমলে সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হয়েছিল সেটিকে পুনঃস্থাপন করা হলো। তিনি বলেন, এ রায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সবাই ঐকমত্য হয়েছেন। রায়ের শেষ অংশে যেটা বলা হয়েছে, সেটা হলো সর্বসম্মতিক্রমে আপীলটিকে ডিসমিস। সংবিধানের ৯৬-এর (২) থেকে (৭) অনুচ্ছেদ পর্যন্ত পুনঃস্থাপন করেছেন। রায়ে বিচারপতিদের কোড অব কনডাক্ট সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে তার সঙ্গেও তারা একমত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলেছেন, এটি সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন সেখানে এটি পেলাম না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রায়ের ভেতরে যাই বলা থাকুক না কেন রায়ের সমাপনীতে কী বলা আছে সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট কোনটা, সেখানে কিন্তু ১১৬ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি বলব এটি একজন জাজের অভিমত হতে পারে কিন্তু যেহেতু রায়ের শেষাংশে যেটাকে অর্ডার অব দ্য কোর্ট আমরা বলি সেখানে ১১৬ সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে ১১৬ বাতিল হয়েছে বলে ধরা যায় না। ১১৬ ধারাকে যদি বাতিল করতে হতো তাহলে সকলকেই সেখানে সই করতে হতো। অর্ডার অব দ্য কোর্ড তাই হতো।’ তিনি বলেন, এখন ওনারা রেস্টর করেছেন। কিন্তু আমার বক্তব্য হলো সংবিধানের যে কোন ধারা, যেটা সংশোধন করা, বাদ দেয়া সবটাই সংসদের ব্যাপার। কোর্ট যদি নিজেই রেস্টর (পুনঃস্থাপন) করে দেন তাহলে সংসদের থাকার কোন দরকার হয় না। তাই না? আমার কথা হলো যে কোন সংশোধনকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু সংবিধানের কোন ধারা পুনঃস্থাপন বা রেস্টর করা আমার বিবেচনায় এটি সংসদের কাজ। সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর করতে এখন আইন করতে হবে কি-না, বা আইন না করলে এটি কার্যকর হবে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বলা কঠিন ব্যাপার। এটি নিয়ে এ মুহূর্তে কোন কমেন্টস আমি করব না। এ রায়ের রিভিউ করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরের আগে নাকি পরে রায়ে স্বাক্ষর করেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আমি বলতে পারব না। প্রধান বিচারপতি বলতে পারবেন। অবসরের পর স্বাক্ষরের বিষয়টি আমাদের বহুদিনের ট্র্যাডিশন। অবসরের পর সই করতে পারবেন না, এই মর্মে বর্তমান প্রধান বিচারপতিই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তাই তিনি কি ভাবে রায়ে স্বাক্ষর নিয়েছেন সেটা তিনিই জানেন। রায়ে বিচারপতিরা যা বললেন ॥ রায়ে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি অপসারণের জন্য আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বিচারক অপসারণের বিষয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বর্ণিত সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা সম্বলিত ৯৬ অনুচ্ছেদের (২) (৩), (৪), (৫), (৬) এবং (৭) পুনর্বহালের জন্য রায়ে বলা হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংবিধান সংক্রান্ত আলোচিত মামলার উদাহারণ টেনে ৩৯৪ পৃষ্ঠার রায় লেখেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রীমকোর্ট’ এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে নিম্স আদালতের স্বাধীনতাকে হত্যা, সঙ্কুচিত, কুঠারের নিচে ফেলা হয়েছে। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন এবং ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন সংবিধানের পরিপন্থী। এর আগে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়েও অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রীমকোর্টের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছিল। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, সংবিধারনের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাইকোর্টের ওপর ন্যস্ত। ফলে সংবিধানের ১১৬ ও ১০৯ অনুচ্ছেদ এক সঙ্গে মিলিয়ে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন অংশে যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলঙ্কা, উগান্ডা, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, বলেভিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউক্রেন, ভেনিজুয়েলা, আরব আমিরাত, ফিজিসহ বিভিন্ন দেশের আলোচিত মামলা ও সংবিধানের বিধি-বিধান তুলে ধরা হয়েছে। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রায়ে বলেন, সংবিধানের ৯৫ (২) (গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। এই পদ্ধতি যদি অনুসরণ করা হয় তাহলে বিচারক নিয়োগ, অপসারণসহ এ সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের মতবিরোধ দেখা দেবে না বলেও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন তিনি। ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি লেখা রায়ে যে ফাইন্ডিংস ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তার সঙ্গে একমত পোষণ করতে আমি অক্ষম। আদালত ও সংসদের মধ্যে পারস্পরিক সংহতি থাকা উচিত ॥ গত ৩ জুলাই রায় ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, আপত্তি তোলা কিছু শব্দ এক্সপাঞ্চ করা হবে। সে অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের যেসব শব্দ নিয়ে আদালতের বন্ধু আইনজীবীরা আপত্তি তুলেছিলেন সেগুলো এক্সপাঞ্চ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট থেকে দেয়া পর্যবেক্ষণের অংশ তুলে ধরে তা কেন এক্সপাঞ্চ করা হয়েছে, তা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে পরস্পরের মধ্যে কী ধরনের অবস্থান থাকা উচিত, সেটি বিবরণীতে রয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, আদালত বা বিচারকরা সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করতে পারেন না। আদালত ও পার্লামেন্টের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সংহতি থাকা উচিত। পাশাপাশি সংসদেরও সুপ্রীমকোর্টের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করা উচিত নয়, যা পার্লামেন্টের কার্যক্রম সম্পর্কিত সাংবিধানিক ধারা ৭৮(২) এবং ২৭০ এবং ২৭১ নম্বর রুলসে নিষিদ্ধ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেয়ার পর আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। পাশাপাশি এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের ১০ আইনজীবীর বক্তব্যও শোনে আপীল বিভাগ, যাদের মধ্যে একজন বাদে অন্য সবার কথায় হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ পায়। হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল, সংসদে হয়েছিল ওয়াকআউট। অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি আবার হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান জানায়। সংবিধান প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটির আপীল শুনানি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে করার জন্য এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের চাপাচাপিতে আদালতেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার উত্তপ্ত বাগ্বিত-াও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। আপীলে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৯৬ ধারাটি সংবিধান প্রণেতারা প্রথম থেকেই রেখেছেন। মাঝখানে মার্শাল ল’ অথরিটি বেআইনীভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রীম জুডিশিয়াল প্রভিশন ঢুকিয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বরং আমরা সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গেছি।’ এই সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের মূল কাঠামোয় কোন পরিবর্তন হয়নি দাবি করে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘হাইকোর্ট ডিভিশন একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছেন।’ অন্যদিকে শুনানিতে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সংবিধান তৈরির সময় বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল। পরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, তাতে পরিবর্তন আনেন। বিচারক অপসারণে অস্ট্রেলিয়া, নামিবিয়া, পাকিস্তান, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকার তথ্য তুলে ধরেন মনজিল মোরসেদ। তিনি যুক্তি দেখান, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার অধিকার সংরক্ষিত না থাকায় বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আইনসভার হাতে থাকলে তার রাজনৈতিক ব্যবহারের আশঙ্কা থাকবে। হাইকোর্টের রায় ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছিল, ‘বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোন কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (এ্যাবসলিউট) ঘোষণা করা হলো। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো।’ বিচারক অপসারণ : বার বার ক্ষমতা বদল ॥ বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোন পরিবর্তন আসেনি।
×