ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাড্ডায় ৪ বছরের শিশুকে ধর্ষণ শেষে হত্যার আসামি শিপন আটক

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১ আগস্ট ২০১৭

বাড্ডায় ৪ বছরের শিশুকে ধর্ষণ শেষে হত্যার আসামি শিপন আটক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর বাড্ডায় চার বছরের শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর হত্যার আলোচিত ঘটনায় সেই নরপিশাচ শিপন গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামি পেশাদার অপরাধী। পেশায় দিনমজুর শিপনের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ও ডাকাতিসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। শিপন পেশাদার অপরাধী। ইতিপূর্বে শিপন ডাকাতি মামলায় পাঁচ বছর জেল খেটেছে। তারপরেও মন থেকে অপরাধ করার প্রবণতা দূর হয়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধ করা একটি মানসিক বিষয়। অনেক অপরাধ পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে ঘটে যায়। কিন্তু ধর্ষণ, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধ পুরোটাই মানসিক বিষয়। সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া সমাজে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা দুরুহ ব্যাপার। মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সচেতন ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাহলেই শুধু ধর্ষণ নয়, যে কোন ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। গত ৩০ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন আদর্শনগর এলাকার ৩৬০ নম্বর মোহাম্মদ মিনহাজের টিনশেড বাড়ির একটি বাথরুম থেকে তানহা (৪) নামে এক শিশুর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ব্যাপারে বাড্ডা থানায় শিপন (৩৫) নামের এক জনকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়। বাড্ডা থানার ওসি এমএ জলিল জানান, তানহার পিতার নাম মেহেদী হাসান। বাড়ি জামালপুর জেলায়। প্রায় নয় বছর আগে মেহেদী বিয়ে করে। বিয়ের পর পরই মেহেদী স্ত্রীকে নিয়ে ওই বাসায় বসবাস শুরু করে। পাঁচ বছর পর তাদের সন্তান আসে। তানহা তাদের একমাত্র সন্তান ছিল। মেহেদী পেশায় চালক। তিনি একজনের গাড়ি চালান। সোমবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানান, শিশুটিকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে রবিবার রাতেই মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তরিত হয়। রবিবার রাত ১২টার দিকে ডিবির উত্তর বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলমের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে ডিবির একটি দল শিপনকে গ্রেফতার করে। শিপনের বাসা থেকে রক্তমাখা তোয়ালেসহ নানা আলামত উদ্ধার হয়। সোমবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন জানান, তানহা ও গ্রেফতারকৃত শিপনের পাশাপাশি বাসায় ভাড়ায় থাকে। শিপনের স্ত্রী রয়েছে। রবিবার তানহাদের পাশের বাসায় জাহেদা আক্তার কলি নামে নতুন একজন ভাড়াটিয়া আসেন। তানহা তার মাকে বলে কলি আন্টির বাসায় যায়। কলিদের বাসায় থেকে ফেরার পথে শিপন ভাত খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে তানহাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। তখন বিকেল পাঁচটার মতো বাজে। ওই ঘরেই তানহাকে ধর্ষণ করে। চিৎকার করার চেষ্টা করলে শিশুটিকে গলাটিপে হত্যা করে শিপন। হত্যার পর পাশের বাথরুমে লাশ ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। ধর্ষণের সময় শিপনের পরনের কাপড় ও বিছানা রক্তাক্ত হয়ে যায়। পরে শিপন কাপড়-চোপড় তার ঘরে বালতিতে ভিজিয়ে রাখে। শিপনকে গ্রেফতারের সময় তার ঘর থেকেই রক্তমাখা তোয়ালেসহ অন্যান্য আলামত জব্দ হয়েছে। শিপন পেশাদার অপরাধী। গত বছর সে রাজধানীর চকবাজার থানার একটি ডাকাতি মামলায় পাঁচ বছর কারাভোগ করে সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়েছে। ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, শিপন এক সময় গার্মেন্টসে চাকরি করত। এখনও মাঝেমধ্যে গার্মেন্টসে চাকরি করে। তার স্ত্রীও গার্মেন্টেসে চাকরি করে। তাদের আট থেকে দশ বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে। শিপন মাদকাসক্ত নয়। তবে সে পেশাদার অপরাধী। তার বিরুদ্ধে নারীদের উত্ত্যক্ত করাসহ বহু অভিযোগ রয়েছে। সুযোগ পেলেই নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করার মতো মানসিকতা রয়েছে শিপনের। ধর্ষণের পর শিশুটিকে হত্যার পরেও শিপনের ভেতরে কোন অনুশোচনা নেই। অনেকটাই ভাবলেশহীন। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম, মোহাম্মদ নুরুন্নবী, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মাসুদুর রহমানসহ উর্ধতন ডিবি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর শ্যামপুর থানাধীন পাইপ রাস্তার কাছের একটি টিনশেড বাড়িতে ১৩ বছর বয়সী এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে পঞ্চাশ বছর বয়সী মীর সেলিম নামে একজন গ্রেফতার করা হয়। পারিবারিক পরিচয়ের সুবাদে সেলিম ওই বাড়িতে যায়। বাড়িতে ওই সময় কেউ না থাকার সুযোগে শিশুটিকে ধর্ষণ করে। গত ১২ জুলাই সৎ মেয়েকে আট বছর ধরে ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার হয়ে পরবর্তীতে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় আরমান হোসেন নামের একজন ধর্ষক। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ, অপহরণের পর আটকে রেখে ধর্ষণসহ বহুভাবে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব বিষয়ে খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোন ধরনের অপরাধের সঙ্গেই মানসিক বিষয়াদি জড়িত। যে অপরাধ করে, সে তার মানসিকতা দিয়েই অপরাধ করার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হয়। তাই প্রতিটি অপরাধই একটি নেতিবাচক মানসিকতার সফল। বিশেষ করে ধর্ষণ বা উত্ত্যক্ত করার ঘটনাটি পুরোটাই নির্ভর করছে বিকৃত মানসিকতার ওপর। ধর্ষণের ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি তেমন প্রভাব বিস্তার করে না। এটি নিতান্তই মানসিক বিষয়। এ জন্য মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। মানসিকভাবে মানুষকে এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনে পাড়া-মহল্লায় সভা-সমাবেশ করে মানুষকে বোঝানো প্রয়োজন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পাঠদানের মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের মানুষদের সচেতনা করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো এসব বিষয়ে সর্তকতামূলক শিক্ষা দেয়া দরকার। পাশাপাশি পিতামাতা ও পরিবারের সদস্যদের শিশু, নারী বা অন্য যারা পরিবারের সদস্য তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তার সন্তানের ওপর আপশাশের কারও কোন কু-নজর আছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সন্তানকে কে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। সন্তান কোন কোন জিনিস বা বিষয়ের প্রতি দুর্বল তা জানতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারকে সন্তানের যেসব চাহিদা সাধ্য মোতাবেক পূরণ করতে হবে। সন্তানদের নানা বিষয়ে সর্তকতামূলক বিষয়াদি শেখাতে হবে। তাহলেই এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। আজ প্রযুক্তির কারণে অনেক খারাপ জিনিস হাতের নাগালে চলে এসেছে। যার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটছে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ যেন নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ভুলে না যায়, তা শেখাতে হবে। ছেলেমেয়েরা যাতে পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা। এতে ছেলেমেয়েদের বিপদগামী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যখন কোন সন্তান তার পরিবারের কাছে তার অভাব বা ব্যক্তিগত বিষয়াদির কথা প্রকাশ করতে না পারে, তখন স্বাভাবিক কারণেই সে বন্ধু বা বান্ধবী বা পরিচিতদের কাছে যায়। আর তখনই তার বিপদগামী বা সর্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধর্ষণের মতো অপরাধগুলোও সংঘটিত হয় এভাবেই। সম্প্রতি আদালত এ ধরনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে ধর্ষণ বা নিপীড়নের মতো অপরাধ দিন দিন কমে যাবে।
×