ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণী ধর্ষণ ও নির্যাতন ॥ ১১ আসামি গ্রেফতার, মেয়াদী রিমান্ড মঞ্জুর

বগুড়ায় তুফানের কিলার বাহিনী, অল্পদিনে বিত্তবৈভব

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১ আগস্ট ২০১৭

বগুড়ায় তুফানের কিলার বাহিনী, অল্পদিনে বিত্তবৈভব

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বগুড়ায় তরুণী ধর্ষণ ও তার মাকে নির্যাতনের পর তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার নারকীয় ঘটনায় অপহরণ ও ধর্ষণের দায়ে দুটি মামলা দায়েরের পর সোমবার এজাহারভুক্ত অভিযুক্ত ৯ আসামি, নাপিত এবং সন্দেহভাজন একজনসহ মোট ১১ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। রবিবার রাতে মামলায় অভিযুক্ত বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি ও তার মা রুমি খাতুনকে পাবনা সদর হাসপাতালের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিন গভীর রাতে এজাহারভুক্ত তিন অভিযুক্ত তুফান সরকারের স্ত্রী আশা আক্তার, গাড়ির ড্রাইভার জিতু ও তুফানের সহযোগী মুন্নাকে ঢাকার সাভার থেকে গ্রেফতার করা হয়। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয় নারী কাউন্সিলর রুমকির বাবা রুনু মিয়াকে। সবশেষে গাবতলী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে নাপিত ক্ষৌরকার (নাপিত) জীবনকে। এই তুফান গং এতটাই ভয়াবহ যে অল্পদিনের ব্যবধানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তুফান সরকার ও তার সাত ভাইয়েরা ভয়াবহভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমনকি তুফান সরকারের আছে নিজস্ব কিলার বাহিনী। বাহিনীর সদস্যরাই তুফান সরকারের নির্দেশে বিভিন্নস্থানে চাঁদাবাজি, নির্যাতন ও হত্যাকা- চালায়। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতারের পর সোমবার আসামিদের সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামি মর্জিনা হাসান রুমকিকে ৪ দিনের, রুমি খাতুন, আশা, মুন্না, জিতু, রুনু ও নাপিত জীবন প্রত্যেককে দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর আগে পুলিশ তুফান সরকার ও তিন সহযোগী আতিক দীপু ও রূপমকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তারা পুলিশের হেফাজতে তিন দিনের রিমান্ডে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তুফান সরকারের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছে। দুদকের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, এই বিষয়ে দুদক তৎপর। এদিকে বগুড়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। এ ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর সারাদেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। বইছে নিন্দার ঝড়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বগুড়া, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে মানববন্ধন ও সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার বগুড়ায় বাংলাাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র মানববন্ধন সমাবেশ করেছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঘটনার বিচার চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। সোমবার শজিমেক হাসপাতালে ধর্ষিতা তরুণীর ফরেনসিক সোয়াপ ও বয়স নির্ধারণী পরীক্ষা হয়েছে। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ এ কে এম সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম এই পরীক্ষা করে। বিভাগীয় প্রধান সাইফুল ইসলাম জানান, আইনগত সকল পরীক্ষা করা হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ধর্ষিতার মায়ের বক্তব্য ॥ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ধর্ষিতার মা জানান, যে রাতে তুফান সরকারকে গ্রেফতার করা হয় সেই দিনই তুফান সরকারের লোকজন হাসপাতালে গিয়ে তুফান সরকারের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তারা বলে, তুফান সরকার মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে। মামলা যেন না করা হয়। মেয়ের মা তখন বলেছেন যারা তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে তাকে নির্যাতন করে মাথা মু-ন করে দিয়েছে এই নরপিচাশদের শাস্তি তিনি চান। শাস্তি ছাড়া তিনি কিছুই মানবেন না। তুফানসহ সাত ভাইয়ের কুকীর্তি ॥ তরুণী ধর্ষণ ও তার মাকে নির্যাতনের ঘটনার পর ধর্ষক তুফান সরকারসহ সাত ভাইয়ের কুকীর্তির সকল ঘটনা একে একে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে পূর্বের হত্যা, জুয়া, মাদক, দখলসহ নানা অপরাধের দায়ের করা মামলার নথি খুঁজে বের করছে। পুলিশের সূত্র জানায় কেন্দ্রীয়ভাবে ডাটা সংগ্রহ কেন্দ্র ঢাকায় বগুড়ার তুফান সরকার ও তার ভাইদের যে মামলা কম্পিউটারে সংরক্ষিত আছে তা খুঁজে বের করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এসব মামলা পর্যালোচনা করা হবে। বিভিন্ন সূত্র জানায় তুফান সরকারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৮ সালের ১৮ জুন রসুল হত্যা মামলা। রসুল ছিলেন তুফান সরকারের বন্ধু। এরপর উজ্জ্বল হত্যা মামলা। প্রায় চার বছর আগে শহরতলির মাটিডালিতে বাণিজ্যমেলায় শফিক চৌধুরী ওরফে পাগলা শফিক হত্যা মামলা। প্রায় দুই বছর আগে শহরের নামাজগড় এলাকায় ইমরান হত্যা মামলা। ২০১২ সালের একটি হত্যা চেষ্টা মামলা। একই বছর ইয়াবা মাদক চোরাই মালামাল বিষয়ক মামলা। দুই বছর আগে বিপুল ইয়াবা ফেনসিডিল ও মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় তুফান সরকারকে। ওই সময় শ্রমিক লীগ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো শ্রমিক লীগসহ অন্য সংগঠনগুলো তাকে নানাভাবে সমর্থন দিয়েছে। এক পর্যায়ে তুফান সরকার ছাড়া পেয়ে যায়। ওই সময় ক্ষমতাসীন দল তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তুফান সরকার ও তার সাত ভাই ভয়াবহ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তুফান সরকারের আছে নিজস্ব কিলার বাহিনী। তারাই তুফান সরকারের নির্দেশে হত্যাকা- চালায়। তুফান সরকার, মতিন সরকার, জাহাঙ্গীর, পুতু, সোহাগ, ঝুমু ও ওমর এই সাত ভাই গত ক’বছরে বগুড়া শহরে মাদক জুয়া দখলবাজিসহ এমন অপরাধ নেই তারা করেনি। ২০০৪ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় তুফানের বড় ভাই মতিন সরকারকে। তার গ্রামের বাড়িতে অনেক অস্ত্র পাওয়া যায়। এই মামলায় মতিন সরকারের ২৭ বছর সশ্রম কারাদা-াদেশ হয়। পরে সে ছাড়া পায়। তুফান সরকার ও তার সাত ভাই বগুড়াকে কেন্দ্র করে জুয়া দখল অপরাধ ও মাদক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকায় তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গত প্রায় ৬ বছরে তারা বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যায়। তুফান সরকারসহ সাত ভাইয়ের প্রত্যেকের বিলাসবহুল বহুতল বাড়ি আছে। তুফান সরকারের দুইটি, মতিন সরকারের দুইটি, পুতুর দুটি এবং বাকিদের একটি করে মোট দশটি বিলাস বহুল দামী গাড়ি আছে। তাদের প্রত্যেক ভাইয়ের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও মাদকের মামলা আছে। তুফান সরকার অবৈধভাবে রেলের জলাশয় ভরাট করে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছে। এতকাল তাদের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। তুফান সরকারসহ সাত ভাই কেউই লেখাপড়া করেনি। শহরের চকসুত্রাপুর কসাইপট্টিতে তারা বড় হয়েছে। বাবা মজিবর রহমান ও বড় ভাই জাহাঙ্গীর ছিলেন কসাই। কসাইয়ের বংশ হওয়ায় প্রত্যেকেই মাংস বিক্রির ব্যবসা করত। তাদের পৈত্রিক কোন ভাল ব্যবসা ছিল না। টিনের ঝুপরি ঘরে তারা থাকত। গত কয়েক বছরে তুফান সরকার ও তার সকল ভাই এতটাই বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে যে তারা কাউকে পরোয়া করে না। তাদের মাদক ব্যবসা দখলবাজি জুয়ার ব্যবসার খবর শহরের লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে জানত। তারা ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় লোকজন নীরবই থাকত। জনগণের প্রত্যাশা ॥ তুফান সরকার ও তার ক্যাডারদের কুকীর্তির খবরা-খবর মিডিয়াতে প্রকাশ হওয়ার পর বগুড়ার লোকজনের মধ্যে সাংবাদিক ও পুলিশ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যায়। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না তার বড় প্রমাণ তুফান সরকার। বলাবলি হয় এত বড় এক দুর্বৃত্ত ও তার সহযোগীরা বগুড়াকে কলঙ্কিত করেছে। তুফান সরকারের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় যাতে আর কোন তুফান সরকার গজিয়ে ওঠার সাহস না পায়। শজিমেকে সংসদ সদস্য ॥ এদিকে সোমবার দুপুরে বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ আব্দুল মান্নান শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ধর্ষিতা তরুণী ও তার নির্যাতিতা মাকে দেখতে যান। তিনি খোঁজ খবর নেন। চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে এক্সিম ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক মেয়ে ও মাকে দেন। এদিন বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেয়ে ও মাকে চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ২০ হাজার টাকার চেক তুলে দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুফিয়া নাজিম।
×