ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ঘটনায় দেশে রেকর্ড মৃত্যু

সড়কে বাইক আতঙ্ক ॥ বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২২:৪০, ১ জুলাই ২০২২

সড়কে বাইক আতঙ্ক ॥ বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা

দুর্ঘটনাকবলিত মোটরসাইকেল

সড়ক-মহাসড়কে এখন আতঙ্কের নাম মোটরসাইকেলগবেষণায় উঠে এসেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তা বিশ্বে সর্বোচ্চদেশে দুচাকার এ যানটির উপাদন বেড়ে যাওয়ায় দাম যেমন কমেছে, সহজে মিলছে নিবন্ধন, তেমনি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও যেন সহজ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশেলোনে, কিস্তিতে বা সামান্য টাকা হলেই মোটরসাইকেল কিনতে পারছেকিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে- সেটা যেন কেউ চিন্তা করছে নাস্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যানবাহন চালুর প্রথম দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় দুচাকার এই যানটি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়- তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তুলেছে

সড়ক পথে বেপরোয়া গতিতে দাবড়িয়ে বেড়ানো মোটরসাইকেলগুলো এখন ভয়াবহ আতঙ্কদেশে অনিরাপদ সড়ক আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পাল্লা দিয়ে মাঠে নামায় এই দুচাকার যানটিফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক ও সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্কট তো রয়েছেইনিরাপদ সড়ক আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিনসারাদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে

সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষজন হতাহত হন, দেশের সকল দুর্ঘটনা মিলেও এত মানুষজন হতাহত হন নাএর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শীর্ষ কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোটরসাইকেলরোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, মার্চে সারাদেশে ৫৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জনএর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন ২২১ জনশতকরা হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩৭ দশমিক ৫২ ভাগই মারা গেছেন  মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর চলাচল শুরুর প্রথম দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর পর সেতুতে এই বাহনটি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছেমোটরসাকেল চালকদের সেতু পারাপার করার নানা কৌশল নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই আলোচনা চলছেকর্মকর্তাদের দাবি, মোটরসাইকেল চালকদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং বেপরোয়া চলাচল এড়াতে তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে দুই মোটরসাইকেল চালকের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সেতুর ওপর পড়ে থাকা, উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুর ঘটনা সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিও সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছেপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরের দিন ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে সকল ধরনের যানবাহনের জন্য খুলে দেয়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুই যুবক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হনআহত অবস্থায় দুই যুবককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার পর চিকিসক তাদের মৃত ঘোষণা করেননিহতরা হলেন- মোঃ আলমগীর হোসেন (২২) ও মোঃ ফজলু (২১)নিহত দুই যুবকের বাড়িই দোহার থানা এলাকায়

গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২০ সালের তুলনায় মাত্র দুবছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশনিহতদের বেশিরভাগের বয়স ৩০ বছরের নিচেবিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয় এমন ১৬টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮ দশমিক ৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চএদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে রীতিমতো গণআন্দোলনের নজির থাকলেও সেই আন্দোলনের কোন সুফল পায়নি দেশের মানুষসড়ক-মহাসড়কে এখনও মৃত্যুর মিছিল চলছেগণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসেনি, অনুমোদনহীন যানবাহন রাস্তায় নামছে প্রতিদিনইসড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণেহেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃেতর সংখ্যা বাড়ছে

হাড়ভাঙ্গা চিকিসায় দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) অর্থা পঙ্গু হাসপাতালহাসপাতালটির জরুরী বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৩৪ জন চিকিসা নেনতাদের ১৬ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকারকেউ চালক, কেউ আরোহী এবং কেউ পথচারীসম্প্রতি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিসা নিয়েছেন এমন ২ হাজার ৪৮২ জনের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ৫৮৫ জনদুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিসা নিতে যাওয়া প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকারসম্প্রতি শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষ আসার সংখ্যাও বাড়ছে বলে পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশশুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতোএর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিতবিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়

গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এআরআই ও নিসচানিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাএর মধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনাবুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভাল মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশআর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশবড় শহরের বাইরে হেলমেট না পরার প্রবণতার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হেলমেট না পরার কারণে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছেপাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে

বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করেএতে উঠে আসে ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেনএকই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেনমাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোহীদের ফুলফেসহেলমেট দেয়া হয়এআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চালকদের প্রতিযোগিতা ও ফাঁক গলে আগে যাওয়ার প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ

রাইড শেয়ারিং এ্যাপের বাহনগুলোর দুর্ঘটনার সংখ্যা কত তা জানা নেই উবার কর্তৃপক্ষেরতবে তারা বলেছেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য ২ লাখ টাকা ও হাসপাতালে ভর্তি হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা বীমাসুবিধা দেয়া হয়উবার জানিয়েছে, তারা সেরা মানের হেলমেট ব্যবহারে উসাহ দেয়সহজ ডটকম কর্তৃপক্ষ বলেছেন, রাইড শেয়ারিং এ্যাপে ব্যবহার করা চালকদের দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমন তথ্য তাদের কাছে নেই

মোটরসাইকেল বিপণনকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানির পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর একটি হলো ওভারটেকিংএ ছাড়া ক্লান্তি নিয়ে চালানো এবং তাড়াহুড়া করাও অন্যতম কারণবাস, ট্রাক, লেগুনা ও প্রাইভেট কারের বেপরোয়া চালনা ও হঠা লেন পরিবর্তন, অযান্ত্রিক যানবাহনের হুটহাট মোড় ঘোরানো ও লেন পরিবর্তন, রাস্তায় হঠা গর্ত, ম্যানহোলের উঁচু অথবা নিচু ঢাকনা ও গতিরোধকে চিহ্ন না থাকা, পথচারীদের অসতর্কতা এবং হঠা করে কুকুর, গরু-ছাগল রাস্তায় চলে আসাও দুর্ঘটনার বড় কারণ

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর হার দিন দিন বাড়ছেমোটরসাইকেল যারা চালান, তাদের বড় একটি অংশ কিশোর-তরুণএরা বেপরোয়া, ট্রাফিক আইন জানে না বা মানে নাঅনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাইযাদের আছে, তারাও যোগ্য নয়তারা নিজেরা যেমন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, তেমনি অন্যরা তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছেমোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ১৪ থেকে ৪০ বছর বয়সীযানজটের কারণে মোটরসাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছেগ্রামগঞ্জে এটা চালাতে লাইসেন্স লাগে না, হেলমেট লাগে নাঅন্যান্য দেশে মোটরসাইকেল নিরুসাহিত করা হয়আর আমাদের এখানে উসাহিত করা হয়কিস্তিতেও মোটরসাইকেল পাওয়া যায়কিন্তু এটা অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ

নিরাপদ সড়ক চাইআন্দোলনের প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন গণমাধ্যমে বলেছেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মোটরসাইকেল আরোহী যে ছাত্রীটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় মারা গেলেন, তার পরিবারও তাকে মোটরসাইকেল (স্কুটি) চালাতে নিষেধ করেছিলকিন্তু গণপরিবহনের সঙ্কট ও ট্রাফিক জ্যামের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল চালাতে বাধ্য হচ্ছেবিআরটিএর উচিত, যারা চালাতে পারে তাদের লাইসেন্স দেয়া।  আসলে আমরা যতই বলি, কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না, মনিটরিং ব্যবস্থা নেইফলে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে নাসড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেইকোন একটা স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটলে তখন আমরা হইচই করি২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে একটি জরিপ করা হয়তাতে দেখা যায়, ৩৩ ভাগ বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই

বিআরটিএর রোড সেফটি বিভগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে যে যানবাহন চলাচল করে তার শতকরা ৫০ ভাগের কোন নিবন্ধন ও ফিটনেস নাইআর সমপরিমাণ চালকের হাতে লাইসেন্স নাইযে ৫০ ভাগের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, তারা যে সবাই যোগ্য তা নয়তারা নানা অবৈধ উপায়ে লাইসেন্স জোগাড় করেছেফলে দুই দিক দিয়েই সড়ক-মহাসড়ক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছেচালকদের অধিকাংশই শারীরিকভাবে গাড়ি চালানোর যোগ্য নয়আর ফিটনেস পাওয়া যানবাহনের বড় একটি অংশের বাস্তবে ফিটনেস নাইঅনেক গণপরিবহন, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান নক্সার বাইরে গিয়ে বড় করা হয়েছেঅনেক গাড়ি আছে, কাগজপত্র ছাড়া চলাচল করেঅনেক থ্রি-হুইলার আছে, যার কোন কাগজপত্র নাইআর দেশে লাইসেন্সধারী চালক কত আছে, তার হিসাব থাকলেও লাইসেন্সবিহীন কত আছে, তার হিসাব আমাদের কাছে নাই

গত রমজান মাস শেষে ঈদের সময়ে চলাচল করা যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দুই চাকার বাহন মোটরসাইকেলদূরের যাত্রায় পথে নেমেছিল লাখ লাখ মোটরসাইকেলগত ঈদের ছুটির চারদিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেবল ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালেই মারা গেছেন ৬০ জনআর চিকিসা নিয়েছেন আটশজনেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ত্রিশের নিচেসেই সঙ্গে ভর্তি হওয়া রোগীদের একটি বড় সংখ্যাই মোটরবাইক চালক, না হয় আরোহী। 

রোজার ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় গেছেনআর এই সময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণ গেছে বলে উঠে এসেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক জরিপেঈদ ঘিরে ১৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে বলেছে, এবার ঈদযাত্রায় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি

বিষয়টিকে উদ্বেগজনকহিসেবে বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ১৪ দিনে দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজারএর মধ্যে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছেএই হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরসাইকেলেরআর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘটেছে এই দুই চাকার বাহনের দুর্ঘটনায়প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা থেকে কমবেশি ৯০ লাখ মানুষ অন্য জেলায় গেছেনদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৩ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেনবাড়ি ফিরতে এবার অন্য বছরের তুলনায় মোটরসাইকেলের ব্যবহারই ছিল বেশি

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই (৫১.৪২%) ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যেকিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনার কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরও বিপদে ফেলছে বলে পর্যবেক্ষণ দিচ্ছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনপ্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল উপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছেএটা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তবছরে ৫ হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেলের ব্যবসা করতে গিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার জনসম্পদ নষ্ট হচ্ছে

যাত্রীকল্যাণ সমিতির দাবি, সরকারের উচিত- গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে এবং রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল নিরুসাহিত করাঅপ্রাপ্ত বয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সে জন্য কঠোর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করাপ্রতিবেদনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১ দশমিক ৯৫ শতাংশ, অন্য যানবাহনের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে ধাক্কা/চাপায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯ দশমিক ০৪ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ঘটেছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ

ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের ঈদ-উল-ফিতরের সময়ের চেয়ে এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশগত বছরের ঈদ-উল-ফিতরের সময় ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিলপ্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ বেশিঝুঁকিপূর্ণতাই মোটরসাইকেল দূরের যাত্রায় কোনভাবেই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে নাঈদযাত্রায় যে সব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেনি, সেগুলো অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসেনি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর কারণে দুর্ঘটনায় আহতের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে নাপ্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনারোধে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছেএর মধ্যে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা করা, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুসাহিত করা, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে

×