বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ শহর থেকে গ্রাম সবখানেই মিলছে সহজলভ্য মাদক ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা ফেনসিডিল! শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে গেলে মাদক বিক্রেতারা শহরতলিসহ প্রত্যন্ত এলাকার স্পটগুলোতে তাদের কারবার জমজমাট করে তোলে। শহরতলির শম্ভুগঞ্জ বাজারের আশপাশ, চুরখাই বাজারের আশপাশ, খাকডহর ঘুন্টি ও রহমতপুরের আশপাশ এলাকার স্পটগুলোতে হোন্ডারোহী অচেনা যুবকদের আনাগোনাই বলে দেয় তাদের চাহিদার কথা। আর শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে স্কুলের পাঠদানের সময়ে ইউনিফর্ম পরা ছাত্রদের আনাগোনা থেকেও কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না স্কুলের সময়ে কিসের জন্য তারা গলির ভেতরে যাচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন অভিভাবক মহল। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী সভা-সমাবেশ করছেন। আশির দশকে এরশাদ সরকার আমলে শহরের কৃষ্টপুর এলাকার হাতকাটা নাজিম, হনুফা ও মোড়ল ছিল মাদক সম্রাট! বাসায় কাউন্টার খুলে গাঁজা, ঘুমের বড়ি ও ফেনসিডিল ব্যবসা করেই নাম ফাটায় নাজিম। একই সময়ে পুরোহিতপাড়ার নুরেছা, হেলেনা, আলালসহ অনেকে এই ব্যবসায় জড়িয়ে মাদক সম্রাজ্ঞী ও মাদক সম্রাটের শিরোপা পায়। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মেয়াদে কৃষ্টপুর ও পুরোহিতপাড়া থেকে মাদক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। নুরেছা, হেলেনা, আলাল, কুইন্ন্যা হনুফা, মোড়ল, নাজিম হয়ে ওঠে মাদকের পাইকারি বিক্রেতা। এ সময়ে আলালের ভাই ইয়াকুব মাদক আনতে গিয়ে সীমান্ত এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। আরেক ভাই জালাল পায়খানার রাস্তায় হেরোইন বহনের সময় মারা যায় অকালে। মাদকের ব্যবসা করে আলাল শহরে চারতলা বাড়ি ও ট্রাকের মালিকসহ কোটিপতি বনেছে। নুরেছাও পুরোহিতপাড়ায় খোদেজা মহলের মালিকসহ কোটিপতি! তবে আলাল জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেলেও পুরোহিতপাড়ার অনেক মাদক সম্রাট বর্তমানে জেলহাজতে। বিএনপি-জামায়াত মেয়াদে পুরোহিতপাড়ায় পুলিশী অভিযানের সময় মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। তৎকালীন বিতর্কিত পুলিশ সুপার কোহিনূর মিয়া এ সময় নিজে গুলি চালিয়ে আটক করেন মাদকের মদদদাতা বিএনপির সুলতান ও দারাকে। ওই সময় শহরে মাদক ব্যবসা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরে আগের চেহারায় ফিরে আসে। পুরোহিতপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রমণ হামলার শিকার হয়ে এলাকা ছাড়ে বাচ্চু। তলে তলে এখনে পুরোহিতপাড়ার মাদক কারবার জমজমাট রেখেছে আলালের স্ত্রী, আবুল এবং পাশের রাজস্ব বাড়ির শাওন ও পারভেজ, সুলেমান পয়গম্বর, মুন্না, বিল্লাল, সনি, ইদ্রিস, পলাশ, মানিক ও আবুসহ অনেকে। কৃষ্টপুর বাগানবাড়ির হনুফা, পুত্র রনি ও জনি, বোন ফতেহ ও রুনু, কাজল, আরিফ, রাজা, শাকিল, হারুন, আখি ও ঢাকাইয়া মামুন, কেওয়াটখালিতে হীরা বেটি, পুত্র সোহেল ও জুয়েল, বাঘমারা মেডিক্যাল গেট এলাকায় রহিম ও চরপাড়া এলাকায় ডাইল বিপ্লব, কালিবাড়ি এলাকার টুটুল, গাফফার, তুহিন, আটানি পুকুরপাড় এলাকার জহির, মহারাজা রোডের সহোদর সুমন ও বাবু, রমেশ সেন রোডের গাঁজা সম্রাট বেনু, শহরের সানকিপাড়া সেনানিবাস সিনেমা হলের পেছনে কমলা, রেহানা, চওরা, চেকপোস্টের সামনে কাঠগোলার ভেতরে টুটুল, আরশাদের পুত্র রকি, রায়হান, সানকিপাড়া শেষ মোড় এলাকার শরীফুল, রফিকুলসহ শহরের আকুয়া দরবার শরীফ রোড, আমজাদ ব্যাপারী রোড, এসকে হাসপাতালের পেছনে, সানকিপাড়ার আবদুল্লাহ গলি, রহমতপুর বাইপাস, শশীলজ, আলেকজান্দ্রার ক্যাসেল, ৩৬ বাড়ি কলোনি, বাঁশবাড়ি কলোনি, পাটগুদাম নিউ কলোনি, রেলওয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজ ও পরিত্যক্ত ওয়াগ্যান এবং সানকিপাড়া লেভেল ক্রসিং থেকে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি মোড় লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত দুই পাশের চা পানের টং দোকানগুলোতে সন্ধ্যার পর প্রতিদিন মাদক সেবন ও বেচাবিক্রির হাট বসছে। মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে শহরের সানকিপাড়া লেভেল ক্রসিং, সেনবাড়ি ও সানকিপাড়া এমপি চেক পোস্টের সামনে প্রায়ই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ হামলার ঘটনায় এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন। মাদকের স্পটগুলোতে অধস্তন পুলিশী অভিযান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রচার রয়েছে, মাদক বিক্রেতা আলালকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় ময়মনসিংহ গোয়েন্দা পুলিশ ও কোতোয়ালি মডেল থানার সাবেক দুই কর্মকর্তা। শহরের ১ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির বাবু পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশের আবু সামা, দালাল ভুট্টো, সিরাজ, মন্টু, মজিবুর, আকাশ ও রুবেল মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাসোহারা তুলে নানা মহলে পৌঁছে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
রমেশ সেন রোডে মদ বিক্রি প্রকাশ্যে
শহরের প্রাণকেন্দ্র রমেশ সেন রোডের ওপর প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন শত শত গ্যালন মদ। কথিত পারমিটধারীদের নামে বেচা বিক্রি হওয়া এই ভেজাল মদ খেয়ে যে কোন সময় ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই আশঙ্কা সচেতন শহরবাসীর। মদের সঙ্গে যৌনপল্লীর প্রতিটি দোকানে প্রকাশ্যে সেবন ও বিক্রি হচ্ছে গাঁজা। মদ, গাঁজা সেবন ও বিক্রিকে কেন্দ্র করে শহরে মাতালদের উৎপাতসহ খুন-খারাবি ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে দাবি উঠেছে রমেশ সেন রোড থেকে মদের দোকানটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জমিদারি আমলে শহরের রমেশ সেন রোডে গড়ে ওঠা যৌনপল্লীর সঙ্গে গজিয়ে ওঠে আলোচিত মদের দোকানটি। প্রচলিত নিয়মমাফিক তালিকাভুক্ত অবাঙালী ও হিন্দু মাইনরিটি পারমিটধারীদের নামে নির্ধারিত পারমিটের টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে জমা দিয়ে সপ্তাহের দুইদিন লাইসেন্সি মদ উত্তোলন করে থাকেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের স্থানীয় উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে পারমিট ইস্যু করার পর শহরের পাটগুদামের মদের ডিপো থেকে ক্যারো কোম্পানির সরকার নির্ধারিত মাত্রার মদ সরবরাহ পেয়ে থাকেন লাইসেন্সি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষীয় সূত্র জানায়, সরবরাহ করা মদ ৪০ শক্তিমাত্রায় থাকে। অর্থাৎ এই মদে ৬০ ভাগ এ্যালকোহল ও ৪০ ভাগ পানি থাকে। সরকার নির্ধারিত এই স্বাস্থ্যসম্মত মাত্রা ঠিক রেখে নির্দ্দিষ্ট ওজনে সিলগালাযুক্ত বোতলে লাইসেন্সিরা মদ বিক্রির কথা। অভিযোগ রয়েছে, কথিত তালিকাভুক্ত অবাঙালী মাইনরিটি পারমিটধারীদের বিপরীতে যৌনপল্লীর ভেতর এই মদ বেচা-বিক্রি চলছে ফ্রি-স্টাইলে।৪০ শক্তিমাত্রার মদে ২-৩ গুণ পানি মিশিয়ে ভেজাল করে কম ওজনের বোতলে, পলিপ্যাকে, পলিথিনে, প্লাস্টিকের কোমল পানীয়র বোতলে সিলগালা ছাড়াই বিক্রি করা হচ্ছে দিনরাত। সন্ধ্যার পর রমেশ সেন রোড থেকে বের হয়ে উশৃঙ্খল যুবকরা শহরের ওল্ড পুলিশ ক্লাব রোড, স্বদেশী বাজার ও গাঙিনাপাড় সড়কের মতো ব্যস্ত ও বাণিজ্যিক এলাকায় মাতলামি করছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিয়মিত লাইসেন্সির বেচা-বিক্রি পরিদর্শন ও মনিটরিং করার কথা।
মদ কী মাত্রায় বিক্রি হচ্ছে, লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন হচ্ছে কিনাÑসেটি দেখার কোন উদাহরণ নেই! মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তার দাবি, পারমিটধারীদের দুই-তৃতীয়াংশই ভুয়া। এদিকে শহরের এই মদের কারবারকে ঘিরে প্রায়ই উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত হচ্ছে ময়মনসিংহ শহর। শহরের নতুন বাজার এলাকায় সন্ত্রাসীদের হাতে সাগর নামে এক যুবক খুন হওয়ার পেছনে ছিল যৌনপল্লীর ভেতর মাদকের ব্যবসা। এর আগেও যৌনপল্লীর ভেতর মাদক ব্যবসার জের ধরে শহরের ওল্ড পুলিশ ক্লাব রোডে সাফু, পলিটেকনিকের সামনে বিপ্লব ও যৌনপল্লীর নৈশপ্রহরী পিন্টুসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকা- ঘটে। মাতলামি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। আর এসব ঘটনা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ আর শঙ্কায় দিন কাটায় যৌনকর্মীরা।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: