ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুদ্রানীতি দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়বে না

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৩০ জুলাই ২০১৭

মুদ্রানীতি দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়বে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি। পাশাপাশি যে কোনো উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতাও স্পষ্ট। সব মিলিয়ে অতি সতর্ক মুদ্রানীতি এটি। ঘোষিত মুদ্রানীতি সম্পর্কে মূল্যায়নে এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রধান উদ্দেশ্যই হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত ও সংযত মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন এ মুদ্রানীতিতে সার্বিকভাবে কতগুলো টার্গেট কমিয়ে দিয়েছে। বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়া, রিজার্ভ মানির টার্গেট কমানো ইত্যাদি। তাদের মূল টার্গেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা পরস্পর সাংঘর্ষিক। বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে কীভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ অর্জিত হবে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। গবর্নর নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে বলেছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান কীভাবে বাড়বে? আপনার ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ) যদি কমে যায় কর্মসংস্থান বাড়ার কোন লক্ষণ তো দেখা যাবে না। আর মুদ্রানীতি যখনই অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন ছোট উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়। বড় গ্রাহকদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয় না। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত মুদ্রানীতির দিকে যাচ্ছে। তাদের দেখাদেখি বাংলাদেশ ব্যাংকও একই পথে হাঁটার চেষ্টা করছে বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের মডেল দিয়ে আমাদের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করলে চলবে না। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরেকটু সাহসী হতে হবে। কিন্তু নতুন মুদ্রানীতিতে গতানুগতিক ধারাই প্রতিফলিত হয়েছে। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য দুটি ঝুঁকির কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। একটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফা। আর একটি হচ্ছে রেমিটেন্স কমে যাওয়া। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি কোন ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছি না ঘোষিত এ মুদ্রানীতিতে। কারণ এ মুদ্রানীতি এত বেশি সতর্কভাবে দেয়া হয়েছে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে অর্থনৈতিক যে ঝুঁকি আমার মনে হচ্ছে তা হলো- রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য এবারের মুদ্রানীতি খুব বেশি সহায়ক হবে না। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় এর সুদহার কমিয়ে আনার জন্য মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, গবর্নর বলছেন সঞ্চয়পত্রের সুদহারের কারণে ক্যাপিটাল মার্কেটে সমস্যা হচ্ছে। এটা আসলে সত্যি নয়। সঞ্চয়পত্র সাধারণ মানুষের সুবিধা দেয়ার জন্য করা হয়েছে। এ জিনিসটা তারা বার বার ভুলে যাচ্ছে। সুদের হার কমিয়ে দিলে ভাল হবে এগুলো মোটেও ঠিক না। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ধরায় মুদ্রা সরবরাহ, সুদের হার তথা অর্থনীতিতে কোন প্রভাব পড়বে কি না? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ড. মোঃ হেলাল বলেন, ঋণের চাহিদা কম থাকায় বেশি প্রবৃদ্ধির সুযোগ নেই। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে যৌক্তিক করার চেষ্টা করেছে বলে আমি মনে করছি। আর ঘোষিত মুদ্রানীতি গতানুগতিক। কোন খাতেই এর বড় কোন প্রভাব পড়বে না। তিনি আরও বলেন, আগের মুদ্রানীতিগুলোতে ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশ কম। ঋণের চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এবার লক্ষ্যমাত্রা সমন্বয় করেছে। মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণপ্রবাহ ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হলেও নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণের প্রবাহ কমানোয় বড় কোন সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, মুদ্রানীতি বড় ইস্যু হিসেবে ৬ মাসের জন্য করা হয়েছে। যেহেতু বাজেটে এটা করা হয়নি। এক্ষেত্রে কম বা বেশি থাকলে আমাদের এক্সপার্টদের সঙ্গে নিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যা কল্যাণকর হয় তা করা হবে। এছাড়া খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আমরা কিন্তু দেখেছি। হাওড়াঞ্চল কৃষি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। বন্যার সমস্যার কারণে আরবান এলাকা ও লোকাল এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। তবে এ বিষয় নিয়েও মুদ্রানীতিতে আলোচনা করেছেন গবর্নর। প্রসঙ্গত, মুদ্রানীতিতে সামগ্রিক ঋণ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারী-উভয় খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয়েছে। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে এটি কমিয়ে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৭ সময়ের জন্য সরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি-জুন, ২০১৭ সময়ের মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশের বিপরীতে মে, ২০১৭ পর্যন্ত বাস্তব প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারী খাতে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরা হলেও গত মে মাস পর্যন্ত সময়ে প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ শতাংশ।
×