ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সংবর্ধনা সভায় সিনহা

বিচার বিভাগকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে, এটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩০ জুলাই ২০১৭

বিচার বিভাগকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে, এটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচার বিভাগকে আস্তে আস্তে স্কুইজ করে একেবারে জিরোতে নেয়া হচ্ছে। বিচারবিভাগকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। এটা জাতি এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আইনমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি আশা করব, আপনার মাধ্যমে আমি সরকারকে বলছি, এটা যদি সরকার মনে করে প্রধান বিচারপতি রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, তাহলে আমি বলব হ্যাঁ, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বার্থে রাজনৈতিক বক্তব্য দিবেন, বিচারকদের অবস্থা, বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য প্রধান বিচারপতি প্রয়োজবোধে আরও বলবেন। এ ব্যাপারে আমি দ্বিধান্বিত হব না। শনিবার প্রথম নারী বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) নাজমুন আরা সুলতানার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা জানান। তিনি আইনমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, মাননীয় মন্ত্রী আপনাকে বলছি, ‘সুপ্রীমকোর্টের মূল ভবন ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। আমি যে চেয়ারে বসি সেখানে বৃষ্টির পানি পড়ে। বর্তমান মূল ভবন মনে হয় আর ৫/৬ বছরের বেশি টিকবে না। নতুন একটা এনেক্স ভবন না করলে মাঠে বসে বিচার কাজ করতে হবে। মাননীয় মন্ত্রী বিচার বিভাগ কিভাবে চলবে? এ সময় প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন সেক্টরে দেশ উন্নত হলেও মানের দিক থেকে বিচার বিভাগকে শূন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। ২০তলা নতুন ভবনের প্রস্তাবটি একনেকেই ঘোরাঘুরি করছে। অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা দেশ এবং বিচার বিভাগের ইতিহাসের অংশ। তিনি এদেশের বিচার বিভাগের অহঙ্কার। তাকে অনুসরণ করে অনেক নারী এ পেশায় এসেছেন। আজ তাই দেশে ২৪ শতাংশ নারী বিচারক রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারক, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি। এই অবস্থান তৈরি করতে তাকে পার করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি। তবে সবকিছু জয় করে তিনি এখন দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসের অংশ। আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে আজীবন সম্মাননা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, নন ডেভেলপমেন্ট খাতে জাতীয় সংসদের জন্য বাজেটে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬.৮১ শতাংশ। জুডিশিয়ারির জন্য এক শতাংশ বরাদ্দ পাইনি। অভার অল জুডিশিয়ারির জন্য (নিম্ন আদালতের বিচারক এবং সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের জন্য) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ০.৩৯ শতাংশ। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে মাননীয় আইনমন্ত্রী এ বিচার বিভাগ চলবে কিরকম? দেশ উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, সব সেক্টরে আমরা ডেভেলপ করছি। কিন্তু বিচার বিভাগকে আস্তে আস্তে স্কুইজ করে একেবারে জিরোতে নেয়া হচ্ছে। এটা জাতি এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমি আশা করব, আপনার মাধ্যমে আমি সরকারকে বলছি, এটা যদি সরকার মনে করে প্রধান বিচারপতি রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, তাহলে আমি বলব হ্যাঁ, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বার্থে রাজনৈতিক বক্তব্য দিবেন, বিচারকদের অবস্থা, বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য প্রধান বিচারপতি প্রয়োজবোধে আরও বলবেন। এ ব্যাপারে আমি দ্বিধান্বিত হব না। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি আগামী বছর জানুয়ারি মাসে চলে যাব। ওই বছর বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়াও অবসরে যাবেন। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে ৮৪ কি ৮৩ জন বিচারপতি আছেন। আগামী বছর আরও কয়েকজন বিচারপতি অবসরে যাবেন। এভাবে বিচারকশূন্য হলে উচ্চ আদালত চলবে কীভাবে?’। রাজনৈতিকভাবে বিচারক নিয়োগের সমালোচনা করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটা রেওয়াজ আছে, পলিটিক্যাল সরকার ক্ষমতায় এসে হাইকোর্ট বিভাগে ইচ্ছামতো বিচারপতি নিয়োগ দেয়। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতিদের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা থাকতে হবে।’ ‘জাটি বিল্ডিংটি সম্প্রসারণে জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, চিঠিও দিয়েছি কিন্তু অজ্ঞাতকারণে সেটিও আটকে আছে। আমি জুডিশিয়াল ইনস্টিটিউশন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জায়গা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলেছিলাম, তিনি বলেছেন, ঢাকায় জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। আমি বলেছি, সাভারে অথবা কেরানীগঞ্জে একটু জায়গা দেন। সেটিও এখনও হয়নি।’ বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, একটা সময় ছিল, যখন নারীরা পুরুষ শাসিত সমাজে শিক্ষার সুযোগ পেত না বলেই দেশের কল্যাণে কাজ করার মতো সুযোগ তাদের ছিল না বললেই চলে। সমাজের দুর্ভেদ্য নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হতো তাদের। নারীদের কর্ম বলতে বোঝানো হতো ঘর-সংসারের কাজকর্মকে। সময়ের দুর্বার স্রোতে অতীতের সেসব নিয়ম-নীতি অনেকটাই ভেসে গেছে। বর্তমান সমাজটাকে আর পুরুষশাসিত সমাজ বলার যৌক্তিকতা নেই। কারণ ’৯০-এর পর থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নারীরা নিজেদের মর্যাদা উর্ধে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। দক্ষ হাতে পার্লামেন্টে স্পীকারের দায়িত্ব পালন করছেন নারী। এছাড়া সরকারের মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, সচিবসহ প্রশাসন ক্যাডারের বাইরেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় সমান তালে এগিয়ে চলেছে আমাদের নারী সমাজ। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে শতভাগ পুরুষের দ্বারা পরিচালিত দফতর, বিচারালয় কিংবা অন্য যেকোন পেশায় যে নারী কর্মজীবনে প্রথম প্রবেশ করেন, তাকে স্মরণ করতে হয় বিনম্র শ্রদ্ধায়। বাংলাদেশের বিচারালয়ে এমন এক দৃষ্টান্ত রেখেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আরও বলেন, তিনি অধঃস্তন আদালতের বিচারক হিসেবে যেমন সুনাম ও একনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতি হিসেবে কর্মরত থেকে তার স্বকীয়তা, মেধা ও তীক্ষè বিচারবুদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বিচার কর্মে নিয়োজিত নারী বিচারকগণের পেশাগত দক্ষতাবৃদ্ধি এবং কর্মক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং দিক নির্দেশনায় ১৯৯০ সনে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি আন্তর্জাতিক মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আন্তর্জাতিক মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠাতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং মহাসচিব ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যা তার কর্মকুশলতা ও সাহসী নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এদেশের বিচার বিভাগের অহঙ্কার। তিনি প্রথম নারী যিনি ১৯৭৫ সনে প্রথমবারের মতো পুরুষ বিচারকের পাশাপাশি যোগদান করেছিলেন বিচার বিভাগে। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার উজ্জ্বল পথচলায় সমৃদ্ধ হয়েছে বিচার বিভাগ। তাকে অনুসরণ করে অনেক নারীর পদার্পণ ঘটেছে আমাদের বিচার বিভাগে। ফলস্বরূপ আজ বাংলাদেশের মোট বিচারকের প্রায় ২৪ ভাগই হলেন নারী। প্রতিবেশী সকল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নারী বিচারকের এই হার অনেক বেশি। এমনকি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের চেয়েও এই হার উৎসাহব্যঞ্জক। আর সেই নারী বিচারকের অগ্রদূত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমি আমার বিচারিক জীবনে ন্যায়বিচার করে গেছি। কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা অবহেলায় ভুল বিচার করিনি।’ ‘বিচারকের জীবন মানেই ন্যায় বিচারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া। আর এই দায়িত্ব পালন করা খুব কঠিন ও পরিশ্রমের।’ বাংলাদেশ মহিলা জজ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তানজীনা ইসমাইলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি আবদুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, সংবর্ধিত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বক্তৃতা করেন।
×