ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

না দিলেও অসুবিধা নেই, আমাদের হাতে অনেক তথ্য প্রমাণ আছে ॥ মনিরুল

রাশেদ স্বীকারোক্তি দিলেই হলি আর্টিজান মামলার চার্জশীট

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩০ জুলাই ২০১৭

রাশেদ স্বীকারোক্তি দিলেই হলি আর্টিজান মামলার চার্জশীট

শংকর কুমার দে/গাফফার খান চৌধুরী ॥ গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করে জঙ্গীরা দুই পুলিশ কর্মকর্তা, নয় ইতালীয়, সাত জাপানী, এক ভারতীয় এবং বাংলাদেশী ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর ও ইশরাত আখান্দসহ ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়। হত্যার দায় স্বীকার করে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এরপর থেকেই জঙ্গীদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানে নিহত হয়েছে গুলশান হামলার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত কয়েজনসহ ২৯। গ্রেফতার হয়েছে অন্তত শতাধিক জঙ্গী। অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত ২৮ জুলাই ভোরে পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি (লফুল ইন্টারসেপশন) শাখা, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, বগুড়া ও নাটোর জেলা পুলিশ সম্মিলিতভাবে অভিযান চালিয়ে নাটোর জেলার সিংড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আসলাম হোসাইন ওরফে মোহন ওরফে মোহন রানা ওরফে রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররাকে (২৪) গ্রেফতার করে। পরে তাকে ঢাকায় আনা হয়। শনিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, রাশেদের বাবা আব্দুস সালাম। বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামে। রাশেদ ও তার বাবা আব্দুস সালাম গত বছরের জুনে নিখোঁজ হয়। কয়েক বছর আগে স্ত্রী নাসিমা বেগম, ছেলে আসলাম ওরফে মোহন ও মেয়ে জেসমিন আক্তারকে নিয়ে রাজশাহীর নওহাটা এলাকার মথুরা নওদাপাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে বসবাস শুরু করে রাশেদের বাবা। সে পিতামাতার একমাত্র পুত্র। রাশেদ রাজশাহীর নওহাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। পরে রাজশাহী নিউ মডেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করা অবস্থায়ই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। সে অনলাইনে জঙ্গীবাদবিষয়ক ভিডিও দেখতে দেখতেই এ পথে আসে। ২০১৫ সালের শেষদিকে কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়ে নিখোঁজ হয়। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী নব্য জেএমবির নেতা শরীফুল ইসলাম খালেদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয় ফরহাদ নামে এক জঙ্গী। খালেদের হাতে হাত রেখে জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত হয় রাশেদ। তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়েও অনেক পারদর্শী রাশেদ সংগঠনের কর্মীদের এ্যাপসের মাধ্যমে আইডি খুলে দিত। গুলশান হামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রাশেদ এই হামলার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। তামিম চৌধুরীসহ মারজান, চকলেট, রাজীব গান্ধীসহ সবার সঙ্গে একসঙ্গে চলাফেরা করত। গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিষয়ে সব ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল রাশেদ। তার সঙ্গে গুলশান হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ হামলাকারীর সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ ছিল। পাঁচ হামলাকারীর প্রশিক্ষণের আয়োজনও করেছিল এই রাশেদ। মনিরুল ইসলাম জানান, রাশেদকে গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে প্রকৃতপক্ষে গুলশান হামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষেই গুলশান হামলা মামলার চার্জশীট দাখিলের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এক্ষেত্রে রাশেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী না দিলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ হামলায় রাশেদের জড়িত থাকার বহু তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। রাশেদ ইচ্ছে করলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে পারে, আবার নাও পারে। এটি রাশেদের ওপর নির্ভর করছে। রাশেদের জবানবন্দী তদন্তে বা চার্জশীট দাখিলের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না। তবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে তা চার্জশীট দাখিলের ক্ষেত্রে বাড়তি সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। না দিলেও কোন অসুবিধা হবে না। কারণ রাশেদের জড়িত থাকার বিষয়টি ইতোপূর্বে কল্যাণপুর থেকে গ্রেফতার রিগ্যান ও আজিমপুর থেকে গ্রেফতার তাহরীম কাদেরীর দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে প্রকাশ পেয়েছে। নব্য জেএমবির নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গী সংগঠনটির অধিকাংশ সদস্যই ছাত্র শিবিরের সদস্য বলে রাশেদ দাবি করেছে। জঙ্গী খালেদের মাধ্যমে রাশেদ নব্য জেএমবিতে জড়িত হয়। পরবর্তীতে তার সঙ্গে তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। পরে রাশেদ নব্য জেএমবিকে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিল। কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। জঙ্গী শামীম ওয়াসি ও রোহান ইমতিয়াজকে মিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় পৌঁছে দিয়েছিল রাশেদ। রাশেদ জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিত। সে বুড়িগঙ্গা নদীতে নিয়ে জঙ্গীদের গ্রেনেড ছোড়ার কৌশল শিখিয়েছিল। গ্রেনেড ছোড়ার সময় রোহান ইবনে ইমতিয়াজের পায়ে স্পিøন্টার লেগেছিল। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল রাশেদ। মনিরুল ইসলাম জানান, গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে রাশেদ প্রথমে ঢাকার কল্যাণপুরের আস্তানায় রাখে। এরপর সেখান থেকে শেওড়াপাড়ার বাসায় নিয়ে যায়। পরে এখান থেকেই অস্ত্র, গোলাবারুদ বাসারুজ্জামান চকলেট বসুন্ধরার বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। অস্ত্র সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া হাতকাটা মাহফুজ, ছোট মিজান ও হাদিসুর রহমান সাগরও জড়িত। মাহফুজ অস্ত্রের চালান ছোট মিজান অপর তিন জনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। রাশেদের সংগ্রহ করা অস্ত্রের মধ্যে চারটি নাইন এমএম পিস্তল ও গ্রেনেড ছিল। রাশেদ আজিমপুর ও শেওড়াপাড়ার জঙ্গী আস্তানা ভাড়া এবং বসুন্ধরার জঙ্গী আস্তানার আসবাবপত্র কিনেছিল। তার সঙ্গে ছিল আকিফুজ্জামান। নারায়ণগঞ্জে আগেই একটি জঙ্গী আস্তানা ছিল তাদের। গুলশান হামলার পর তামিম চৌধুরীর জন্য সেখানে আরেকটি বাসা নেয় তারা। পরিস্থিতি খারাপ দেখে রাশেদ গাজীপুরে অবস্থান নেয়। এরপর সে উত্তরবঙ্গে চলে যায়। ইতোমধ্যেই হলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নব্য জেএমবির ২১ জনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। এরমধ্যে ১৫ জন গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে। ৪ জন কারাগারে রয়েছে। আর হাদিসুর রহমান সাগর নামের একজন পলাতক। মনিরুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান আর গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে একের পর এক জঙ্গীরা গ্রেফতার হচ্ছে। এর ফলে নব্য জেএমবি ও পুরনো জেএমবি সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দলের অনেককেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে শনাক্ত করে তাদের হত্যা করছে দলের সদস্যরাই। জঙ্গী সংগঠন দুটির সদস্যদের ধারণা, তাদের মধ্যে অন্য কেউ অনুপ্রবেশ করেছে। তবে বিদেশে থাকা অনেকেই জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের দেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ইতোমধ্যেই সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তারা দেশে প্রবেশ করতে পারলে বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটা বিচিত্র নয়। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় নিহত তানভীর কাদেরীর ছেলে তাহরীম কাদেরীর (১৪) ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দী থেকে জানা যায়, গুলশান হামলার আগে র‌্যাশ অর্থাৎ রাশেদ, তামিম চৌধুরী ও সিলেটের আতিয়া মহলের অভিযানে নিহত মূসা কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে বসুন্ধরার ওই বাসায় রাখে। ওই ব্যাগে অস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল। গুলশান হামলার দিন বিকেলে সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বের হয়। তারা বের হওয়ার সময় তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলে, ‘জান্নাতে গিয়ে দেখা হবে ইনশাল্লাহ’। এরা বের হওয়ার পর তামিম আর বাসারুজ্জামান চকলেট বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় চকলেট তার পিতা তানভীর কাদেরীকে দ্রুত বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। পরে তারা বাসা ছেড়ে পল্লবী চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর জানতে পারি হলি আর্টিজানে গোলাগুলি হচ্ছে। তখন বুঝতে পারি, হলি আর্টিজানে অপারেশন হচ্ছে। সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহতদের ছবি প্রকাশের পর দেখি, সাদ হচ্ছে মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলাম, মামুন হচ্ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, উমরের আসল নাম খায়রুল ইসলাম পায়েল বাঁধন, আলিফের প্রকৃত নাম শফিউল ইসলাম উজ্জ্বল ও শুভর মূল নাম স্কলাসটিকার ছাত্র মীর সালেহ মোবাশ্বের। এর কয়েক দিন পর র‌্যাশ জানায়, চকলেটকে পাওয়া যাচ্ছে না। র‌্যাশ দ্রুত তাদের বাসা পরিবর্তনের কথা বলে। তারা রূপনগরে ও আজিমপুরে দুটি বাসায় থাকা শুরু করে। তাহরীম কাদেরীর জবানবন্দীতে প্রকাশ পাওয়া হলি আর্টিজানের র‌্যাশই হচ্ছে রাশেদ। যাকে বহুদিন ধরেই গ্রেফতারের চেষ্টা করছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
×