ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্প্রসারিত হয়নি চট্টগ্রাম বন্দর

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩০ জুলাই ২০১৭

অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্প্রসারিত হয়নি চট্টগ্রাম বন্দর

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্প্রসারিত হয়নি চট্টগ্রাম বন্দর। দিন যতই যাচ্ছে সঙ্কট ততই প্রকট আকারে প্রতিভাত হচ্ছে। যে গতিতে শিল্পায়ন হচ্ছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে এ বন্দর তার বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে কতটা সেবা দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং এবং ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে রয়েছে বেশকিছু বৃহৎ প্রকল্প। কিন্তু এসব ঝুলে আছে নানা দীর্ঘসূত্রতায়। ব্যবসায়ী মহলের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব বে-টার্মিনালসহ প্রস্তাবিত নতুন নতুন টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ করা হোক। প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতিতে তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর হতাশা। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন চট্টগ্রাম বন্দর বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিং করছে তার চেয়ে খুব বেশি আশা করা যায় না। কেননা, প্রয়োজন বিবেচনায় বন্দরকে সেভাবে সম্প্রসারণ করা হয়নি। যে পরিমাণ জেটি থাকা উচিত সে পরিমাণ নির্মিত হয়নি। বড় বড় প্রকল্প থাকলেও এগুলোর কাজ মাঠে গড়ায়নি। সবই রয়ে গেছে আলোচনার মধ্যেই। এ ধীরগতি চলতে থাকলে কোন একদিন দেশের অর্থনীতির চাকা থমকে যাবার সমূহ আশঙ্কা। তখন হয়ত সামাল দেয়ার কোন পথই খোলা থাকবে না। চট্টগ্রাম বন্দর গত অর্থবছরে হ্যান্ডলিং করেছে প্রায় ২৩ লাখ টিইইউএস কন্টেনার। আমদানি-রফতানিকারকরা বলছেন, বিদ্যমান জেটি সুবিধা এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে যে পরিমাণ কন্টেনার এবং কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে তা মোটেও কম নয়। সে হিসেবে বন্দরকে অদক্ষ বলা যাবে না। কিন্তু সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ বন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধা এতদিনে যে পর্যায়ে উন্নীত হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। বন্দরের নিজস্ব তহবিল যেমন রয়েছে তেমনিভাবে বন্দরে বিনিয়োগ করার জন্য দেশী-বিদেশী আগ্রহী বিনিয়োগকারীর অভাবও নেই। কিন্তু তারপরও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের কাজটি হচ্ছে না। বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে যদি প্রকল্পগুলো দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে অচিরেই অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এমএ লতিফ বন্দরের বর্তমান সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেন, বিদ্যমান বাস্তবতায় আমি বন্দরকে অদক্ষ বলতে চাই না। তবে বর্তমানে দেশের আমদানি-রফতানি যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্দরকে সে পর্যায়ে নেয়া যায়নি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর বাংলাদেশ এখন আর শুধু আমদানিনির্ভর দেশ নয়। আমাদের রফতানি ক্রমেই বাড়ছে। তাছাড়া সরকার দেশে ১শ’টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। এরমধ্যে কয়েক বছরের মধ্যেই কয়েকটি ইকোনমিক জোনে শিল্পায়ন এবং উৎপাদন দৃশ্যমান হবে। নতুন শিল্প কারখানাগুলোর জন্য কাঁচামাল যেমন আমদানি করতে হবে তেমনিভাবে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি হবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে সম্প্রসারণ করতে হবে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকা- যেভাবে বেড়েছে তাতে স্বাধীনতার পর এতদিনে নতুন করে আরও ১শ’টি জেটি হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জেটি বেড়েছে মাত্র সাতটি। দ্রুততার সঙ্গে বে-টার্মিনাল, কর্ণফুলী কন্টেনার টার্মিনাল (কেসিটি), পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনার (পিসিটি) এবং লালদিয়ারচর টার্মিনালসহ গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে রূপদান প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কিছু বড় প্রকল্প থাকলেও ব্যবসায়ী মহল বড়ই আশা করে তাকিয়ে আছে বে-টার্মিনালের দিকে। এ টার্মিনালকে দেখা হচ্ছে আগামীর বন্দর হিসেবে। সাগর তীরে ৯০৭ একর এলাকাজুড়ে বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে সঙ্কট অনেকটাই কেটে যাবে। টার্মিনালটি চালু করা গেলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বে-টার্মিনালকে অনেকেই দেখছেন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি উত্তম বিকল্প হিসেবে। তুলনামূলক সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমান বন্দরে ভিড়তে পারে একসঙ্গে ১৯টি জাহাজ। আর বে-টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ৩০ থেকে ৩৫টি জাহাজ। বর্তমান বন্দরের অপারেশনাল এরিয়া যেখানে ৩৩০ একর, বে-টার্মিনালের সেই এরিয়া হবে ৯০৭ একর। সমুদ্রের উজানে বর্তমান বন্দরের জাহাজ প্রবেশে ও নিমর্গনের জন্য জোয়ার-ভাটার অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু বে-টার্মিনাল জোয়ার-ভাটানির্ভর বন্দর হবে না। শুধু তাই নয়, সেখানে নাইট নেভিগেশনসহ দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জাহাজ আসা-যাওয়া সম্ভব হবে। ড্রাফট কম (৯ দশমিক ৫০ মিটার) হওয়ায় বিদ্যমান বন্দরে সর্বোচ্চ ১৮৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়তে পারে। কিন্তু ১০ থেকে ১২ মিটার ড্রাফটের বে-টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজও। বর্তমানে যেখানে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮শ’ টিইইউএস কন্টেনার ভেড়ানো সম্ভব হচ্ছে, সেখানে ৫ হাজার টিইইউএস কন্টেনারের জাহাজও ভেড়ানো যাবে নতুন এ টার্মিনালে। কিন্তু সম্ভাবনার এই বে-টার্মিনাল নির্মাণের অগ্রগতি যতটুকু দৃশ্যমান হওয়া উচিত ছিল ততটুকু নয় বলে মনে করছেন ট্রেডবডি নেতৃবৃন্দ। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের অর্থনীতি যে পর্যায়ে এসেছে এবং যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে বন্দরের সম্প্রসারণ এখন আর আলোচনার বিষয় না হওয়াই উচিত। প্রয়োজন প্রস্তাবিত ও গৃহীত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা। বন্দর ব্যবহারকারীরা এখন চান ‘টাইম ফ্রেম।’ কবে নাগাদ কতটুকু কাজ শেষ করা হবে তা ঠিক করে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা এবং রফতানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া। যদি তা করতে হয় তাহলে শিল্পায়ন এবং উৎপাদন বাড়াতে হবে। এতে আমদানি ও রফতানি দুটিই বাড়বে। কিন্তু এই বর্ধিত আমদানি-রফতানি কিভাবে এবং কোন্ পথে হবে তা ঠিক করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরকে যদি আরও সম্প্রসারিত এবং দক্ষ করা না হয় তাহলে নিকট ভবিষ্যতে বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দরের বেশকিছু প্রকল্প নিয়ে আলোচনা ক’বছর ধরে। নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মাণের কাজ ২০০৮ সালে শেষ হয়েছে। অথচ, প্রায় ৯ বছরেও গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে টার্মিনালটিকে সজ্জিত করা যায়নি। এনসিটি তার পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করতে পারছে না। আবার এরই মধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিবেশী ভারতের সাত রাজ্যসহ নেপাল ও ভুটানকে বন্দরসেবা প্রদানের। কিন্তু সক্ষমতা না বাড়ালে প্রতিবেশী দেশগুলোকে সহযোগিতা দূরের কথা, নিজ দেশের আমদানি-রফতানির সেবা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
×