ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দালালচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে ॥ রিয়াজুল

সাগরপথে অবৈধভাবে ৯৩ হাজার বাংলাদেশী ইউরোপে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩০ জুলাই ২০১৭

সাগরপথে অবৈধভাবে ৯৩ হাজার বাংলাদেশী ইউরোপে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দালাল চক্রের মাধ্যমে সাগরপথে অবৈধভাবে বাংলাদেশের ৯৩ হাজারের বেশি লোক ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তুলনায় এ তালিকা অনেক বড়। অবৈধদের ফেরত আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। অবৈধদের ফেরত না হলে ভিসার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইইউ। অবৈধ অভিবাসী সমস্যা নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে তারা। ইইউর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শুধু ভূমধ্যসাগর পথ পাড়ি দিয়ে (সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট) দিয়েই সাত হাজার ৮৯৯ জন বাংলাদেশী ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এ দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক পরামর্শ সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। পরামর্শ সভায় বলা হয়, আজ রবিরার আন্তর্জাতিক মানবপাচারবিরোধী দিবস উপলক্ষে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক এ সভার আয়োজন করে। ব্র্যাকের স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশনস এ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট কর্মসূচীর ঊর্ধতন পরিচালক আসিফ সালেহ্র সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রামরুর সমন্বয়ক সি আর আবরার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ শাহ আলমসহ আন্তর্জাতিক ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচীর প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান। নানা বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইউরোপে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশী আছেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে গত এপ্রিলে ঢাকা সফরকারী ইইউ প্রতিনিধি দল ইউরোপে ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-২০১৫ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশী ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এ বছরের ছয় মাস ধরলে এ সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এটা সত্যি যে ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধে আমাদের চমৎকার আইন হয়েছে। একই সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। কিন্তু এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ আমরা কতটা করতে পেরেছি তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মানবপাচারের সাড়ে ৩ হাজার মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ জনের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছে। এটা সে রকম বড় শাস্তি হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করে তিনি বলেন, অনেক সময় পুলিশ প্রতিবেদন সঠিকভাবে আসে না। সে ক্ষেত্রে আদালতের কিছুই করার থাকে না। ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন মনে রাখতে হবে মানবাধিকার রক্ষা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এখানে রাষ্ট্রকেই মূল দায়িত্ব নিতে হবে। আর ছোট অপরাধীদের পরিবর্তে প্রয়োজনে ২৫ জনের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করে গড ফাদারদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ড. সি আর আবরার বলেন, মনে রাখতে হবে মানবপাচারে দেশে-বিদেশে বড় স্বার্থগোষ্ঠী অনেক ক্ষমতাধর। এ জন্য আমাদের টার্গেট করে মূলহোতাদের খুঁজে বের করা উচিত এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ অতিরিক্ত টাকা খরচ করে কেউ গেলে সেই টাকা তুলতে গিয়ে কর্মীরা অনিয়মত হয়ে যান। পাশাপাশি তিনি মানবপাচার রোধে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, বিমানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাজের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, মানবপাচার একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ। কাজেই মূলহোতাদের চিহ্নিত করা জরুরী। আসিফ সালেহ সভার সুপারিশসমূহ তুলে ধরে বলেন, মানবপাচার রোধে আমাদের মূলত চারটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এগুলো হচ্ছেÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি আনয়ন, সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা, মামলা হলে সেটার সঠিক আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সমন্বয় সাধন। অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান কে এম আলী রেজা, উন্নয়ন কর্মী আসিফ মুনীর, পুলিশের মানবপাচারের সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুরা বেগম, র‌্যাবের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল মারুফসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বলা হয়, জুলাই মাসের শুরুতে অবৈধপথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় তুরস্কে গিয়ে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশী আটকা পড়েছেন। ইউরোপের এ চিত্রের পাশাপাশি সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়া এবং সেখানকার গণকবরের কথা চিন্তা করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। মালয়েশিয়াও সম্প্রতি অবৈধ বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। অভিযানের প্রস্তুতি চলছে সৌদি আরবেও। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশী বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এ বছর মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এ প্রতিবেদনে দেশগুলোকে তিনটি স্তর বা টায়ারে ভাগ করা হয়। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশকে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে (টায়ার-টু)। এবার এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্তরের ‘নজরদারিতে থাকা দেশের তালিকায় (টায়ার-টু ওয়াচ লিস্ট)’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও হংকংসহ ৪৫টি দেশ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তখন এ চিত্র উদ্বেগজনক। বক্তারা আন্তর্জাতিক উদ্বাস্থ সংস্থার তথ্য তুলে ধরে বলেন, গত চার বছরে প্রায় দেড় লাখ লোক বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানবপাচারের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত দেড় হাজার মানুষ সাগরেই মারা গেছেন। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই শতাধিক মরদেহ, যার মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশী। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে মানবপাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব মামলার অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি।
×