ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সদ্য সমাপ্ত বোরো মৌসুমে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ ইউরিয়া সাশ্রয় ;###;ফলন বেড়েছে ৬ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত

ধান চাষে স্প্রে প্রযুক্তিতে সার প্রয়োগে যুগান্তকারী সাফল্য

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩০ জুলাই ২০১৭

ধান চাষে স্প্রে প্রযুক্তিতে সার প্রয়োগে যুগান্তকারী সাফল্য

কাওসার রহমান ॥ ধান চাষে ¯েপ্র করে সার প্রয়োগে সদ্য সমাপ্ত বোরো মৌসুমে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ইউরিয়া সার সাশ্রয় হয়েছে। এতে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের এগ্রোনমি এবং এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের মাঠ পর্যায়ের এক গবেষণাতে এ ফল উঠে এসেছে। এতে ধান চাষে ইউরিয়া সাশ্রয়ী স্প্রে প্রযুক্তি সঠিক বলে মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে প্রমাণিত হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খামারের গবেষণা মাঠে সদ্য সমাপ্ত বোরো মৌসুমে ব্রিধান-২৮ এর ওপরে এমএস স্টুডেন্ট সেরাজাম মুনিরা তার থিসিসের আওতায় গবেষণাটি করেন। গবেষণার সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর ড. আমিনুল হক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পাদিত এ পরীক্ষায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, ধান গাছে পাতার মাধ্যমে নাইট্রোজেন প্রদান একটি কার্যকর এবং বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে। এ তথ্যটি দেশের ধান চাষীদের জানিয়ে দিতে পারলে তারা সঙ্কটকালীন তথা সাময়িক খরা বা জলাবদ্ধতা বা কৃত্রিম ইউরিয়া সার সঙ্কটের সময়ে অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার পাতার মাধ্যমে প্রয়োগ করে ভালভাবে ফসল ফলাতে পারবেন এবং তাদের ফসলকে ফলন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পাদিত বিজ্ঞানভিত্তিক এ পরীক্ষায় মোট ৮টি ট্রিটমেন্টে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি ট্রিটমেন্টে ২০ শতাংশ থেকে ধাপে ধাপে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ইউরিয়া সার সাশ্রয় করার চেষ্টা করা হয়। ধানের চারারোপণ করা হয়েছিল ৪৭ দিন বয়সের এবং প্রতি গোছায় ২ থেকে ৩টি চারা ছিল। রোপণ দূরত্ব রাখা হয় লাইন থেকে লাইন ২০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার। পরীক্ষার প্লটের আকার ছিল ৫ বর্গমিটার। বীজতলা থেকে চারা তোলার আগের দিন বিকেলে প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০ গ্রাম এমওপি, ২ গ্রাম থিওভিট, ০.৫০ গ্রাম চিলেটেড দস্তা এবং ০.৫০ গ্রাম লিবারেল বোরণ এবং একটি কীটনাশক একসঙ্গে মিশিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ৫০ মিলি হিসেবে স্প্রে করা হয়। ইউরিয়া বাদে অন্য সকল সার শেষ চাষে প্রয়োগ করে ধান রোপণ করা হয়। ধান রোপণের ৯ দিন পর সকল ট্রিটমেন্টের প্লটে ৩৩ শতাংশ ইউরিয়া সার প্রদান করা হয় এবং এর ১৫ দিন পর ইউরিয়া সাশ্রয় সংক্রান্ত ট্রিটমেন্টের প্লটগুলোতে অবশিষ্ট পরিমাণ ইউরিয়া সার প্রদান করা হয়। একই সময়ে ট্রাডিশনাল ট্রিটমেন্টের (ট্রিটমেন্ট নং-৭) প্লটে ৩৪ শতাংশ ইউরিয়া প্রদান করা হয় এবং অবশিষ্ট ৩৩ শতাংশ ইউরিয়া চারারোপণের ৪০ দিন বয়সের সময় প্রদান করা হয়। ইউরিয়া সাশ্রয় সংক্রান্ত ট্রিটমেন্ট ১, ২ এবং ৩ এর ক্ষেত্রে মাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া সার কীটনাশকের সঙ্গে মিশিয়ে প্রথমবার স্প্রে করা হয় চারারোপণের ৩১ দিন বয়সের সময়, দ্বিতীয়বার স্প্রে করা হয় চারারোপণের ৪১ দিন বয়সের সময় এবং শেষবার মাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া সার ছত্রাকনাশকের সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করা হয় চারারোপণের ৫১ দিন বয়সের সময়। ট্রিটমেন্ট ৪, ৫ এবং ৬ এর ক্ষেত্রে মাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া সার কীটনাশকের সঙ্গে মিশিয়ে প্রথমবার স্প্রে করা হয় চারারোপণের ৩৫ দিন বয়সের সময়, দ্বিতীয়বার স্প্রে করা হয় চারারোপণের ৪৫ দিন বয়সের সময় এবং শেষবার মাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া সার ছত্রাক নাশকের সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করা হয় চারা রোপণের ৫৫ দিন বয়সের সময়। এ পরীক্ষার যে ট্রিটমেন্টে (ট্রিটমেন্ট নং-৩) মাটিতে দুইবারে ৫০ শতাংশ ইউরিয়া প্রদান করে পাতায় তিনবারে ২৫ শতাংশ ইউরিয়া এবং এর সঙ্গে ১.২৫ শতাংশ এমওপি, সালফার বোরণ ও জিঙ্ক মিশিয়ে (তৃতীয় স্পের সময় সালফার বোরণ এবং জিঙ্ক ব্যবহার করা হয়নি) তিনবার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়েছে সেই ট্রিটমেন্টে সর্বাধিক বেশি সাফল্য পাওয়া গেছে। মূল জমিতেও প্রতি বর্গ মিটারে ৫০ মিলি স্প্রে দ্রবণ প্রয়োগ করা হয়। সকল স্প্রে করা হয়েছে বিকেল ৫টার পর পর। প্রতি প্লটের মাঝের ২ বর্গমিটার জমির ৫০টি গুছি কেটে ফলাফল হিসাব করা হয়েছে। এ পরীক্ষায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ১০-২৫ শতাংশ ইউরিয়া সার পাতায় তিনবার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করে ধান গাছের শেষ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ৪০-৫০ শতাংশ নাইট্রোজেনের যোগান সুন্দরভাবে দেয়া সম্ভব। এ গবেষণার সুপারভাইজার প্রফেসর ড. আমিনুল হক বলেন, গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলটি দেশে ধান চাষে ইউরিয়া সারের ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এছাড়া ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলের মাধ্যমে ধান গাছে নাইট্রোজেনের যোগানের বিষয়টি খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকার চাষীসহ দেশের সকল এলাকার চাষীদের ধান চাষে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমন মৌসুমে বৃষ্টির অভাবে চাষীরা যখন তাদের জমিতে সময়মতো ইউরিয়া দিতে পারবে না তখন পাতার মাধ্যমে খুব সহজেই তারা ইউরিয়া সারের দ্রবণ স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করে ধান গাছের নাইট্রোজেনে চাহিদা তাৎক্ষণিকভাবে মিটিয়ে দিতে পারবেন। আর যেহেতু এ প্রযুক্তিটির মাধ্যমে মাটিতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ইউরিয়া সার কম প্রদান করা হচ্ছে, তাতে দেশের মাটি, পানি এবং পরিবেশও অধিক সুরক্ষিত থাকবে।’ জানা যায়, এ প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ আরিফ হোসেন খান। ২০১২ সালে প্রযুক্তিটি উদ্ভাবনের পরে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৭৫ জন চাষী এবং কর্মকর্তার মাধ্যমে ৬ হাজার ২০০ বিঘা জমিতে প্রযুক্তিটি বাস্তবায়ন করে মাঠ পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া যায়। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু ধান চাষে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে দেয়া সম্ভব হতে পারে। এ কারণে সরকারের ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আর বার্ষিক অতিরিক্ত ধান উৎপাদন হতে পারে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে প্রযুক্তি উদ্ভাবক কৃষিবিদ আরিফ হোসেন খান বলেন, স্প্রে প্রযুক্তির মাধ্যমে ধান চাষের সাফল্যের এ তথ্যটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য ধান উৎপাদনকারী দেশের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে। কারণ স্প্রে প্রযুক্তির মাধ্যমে ধান চাষের এমনতর সাফল্য দেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্জিত হয়নি। এ কারণে সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ধান চাষ বিষয়ে প্রযুক্তিটি একটি মডেল হতে পারে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ হতে পারে পাইওনিয়ার। তিনি বলেন, ‘মাটিতে ইউরিয়া প্রয়োগ করলে যেখানে গাছ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে, সেখানে পাতায় প্রয়োগ করলে শতকরা ৯০ ভাগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারে বলে উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা গেছে। আমেরিকার মিসিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে আরও জানা যায়, এক একক নাইট্রোজেন পাতায় প্রদান করলে তা ৪ একক থেকে ১৫ একক পর্যন্ত মাটির প্রদানকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। পাতায় যখন ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়, তখন প্রয়োগকৃত ইউরিয়ার ৫০ শতাংশ ৩০ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টা সময়ে গাছের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে।’
×