ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ বদরুল আহসান

এরশাদ, তাঁর সামরিক অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসন নিয়ে নানা কথা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৩০ জুলাই ২০১৭

এরশাদ, তাঁর সামরিক অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসন নিয়ে নানা কথা

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি জাতির উদ্দেশে বললেন, তাঁর সে সময় ক্ষমতা দখলের কোন ইচ্ছেই ছিল না। দেশের গণতন্ত্র সঠিক পথে চলুক তিনি তাই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আর সেই সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারই তাঁকে এ জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করতে বলেছিলেন। এরশাদ আরও বলেন যে, সেই সময় রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সরকার ছিল একটি দুর্নীতিবাজ সরকার। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ওই সরকারের তখনকার সব মন্ত্রীই ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্রপতি সাত্তার একটা পরিবর্তন চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের তৈরি এই শোচনীয় অবস্থা সামলাতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন সাত্তার। আর ঠিক সেই সময় দেশকে এক সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্যই এরশাদ এগিয়ে এসেছিলেন। এরশাদ সংসদ সদস্যদের সামনে বললেন, ওই সময় ক্ষমতা গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং পরে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ফিরে যাওয়া। আর সেই সময় অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াত কেউই একটি নতুন নির্বাচন করতে তাঁকে সহায়তা করেনি। সেজন্য তিনি জাতীয় পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৬ সালে নতুন নির্বাচন দেন। তাঁর কথায়, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানের পুরো দায়ই ছিল রাষ্ট্রপতি সাত্তার এবং বিএনপির। এখানে তাঁর কোন দায় ছিল না। এরশাদের এসব কথা যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে নয় বছর ধরে শাসনের যে জগদ্দল পাথর তিনি এ জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার দায় পড়ে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া বা অন্য রাজনীতিকদের ওপর, যারা কিনা দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনতে এরশাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়াননি। এরশাদের এ ধরনের কথায় কেউ কী বিস্মিত হলেন? আজকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এক সময় অভিন্ন ভারতের অংশ ছিল। দুটি দেশেরই সামরিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এখানে প্রতিনিয়ত এবং খুবই কদর্যভাবে দুর্বল হলেও গণতন্ত্রকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়ার ঘটনা দেখা গেছে। এসব উর্দিপরা সামরিক শাসকই তাদের উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে এই কাজ করেছেন বিভিন্ন সময়। তাই তাদের আসল মনোভাব বোঝা মোটেও শক্ত না। আপনারা পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল আইয়ুব খানের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। যিনি নিজেকে ফিল্ড মার্শাল ঘোষণা করতে একটুও দ্বিধা করেননি। এই আইয়ুব খানই ১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মতলব আঁটেন। এক নগ্ন প্রক্রিয়া ছিল এটি। সে সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, আইয়ুবের ক্ষমতা দখল ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পুরো পাকিস্তানকে লজ্জায় ডুবিয়ে জেনারেল আইয়ুব এবং ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করলেন। এর মাত্র ২০ দিন পর আইয়ুবের কনুইয়ের গুঁতোয় ইস্কান্দার মির্জা ধরাশায়ী হলেন। মির্জা এবং তাঁর ইরানী স্ত্রী নাহিদকে লল্ডনগামী উড়োজাহাজে পাঠিয়ে দেন। আর এভাবেই আইয়ুব হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রাজনীতিকদের প্রতি আইয়ুব খানের শ্রদ্ধা একেবারে ছিল না বললেই চলে। গণতন্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ঘৃণা। এতকিছুর পরও তিনি পাকিস্তানে এমন গণতন্ত্র উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন যা নিয়ে কিনা গর্ব করা যেতে পারে! ক্রমান্বয়ে তাঁর দেয়া সেই গণতন্ত্রের স্বরূপ প্রকাশিত হতে থাকল। আইয়ুব মার্কা গণতন্ত্রের নমুনা হিসেবে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী বানানো হলো। এঁদেরকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়া হলো। দুটি অংশে বিভক্ত কয়েক কোটি মানুষের এ দেশটিতে মাত্র ৮০ হাজার মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা পেল। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই আইয়ুবের এ শাসন টিকল না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সালে ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন শুরু হয়। আর এ আন্দোলনে পরাভূত হলো আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। আইয়ুব বিদায় নিলেন, সেইসঙ্গে নিশ্চিহ্ন হলো আইয়ুবমার্কা গণতন্ত্র। আইয়ুব খান ও জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন এই অজুহাতে যে, তাঁরা রাজনীতিবিদদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি দেখেছিলেন। তবে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিমুক্ত করতে তারা সামান্যই চেষ্টা করেছেন। তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে জায়েজ করার জন্য এসব রাজনীতিকের অনেককেই তারা তাদের কাছে নিয়েছেন। তবে এভাবে সামরিক শাসকের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কিন্তু এসব রাজনীতিক বরং নিজেদের জন্য বিপর্যয়ই ডেকে এনেছেন। কী পাকিস্তানে, কী বাংলাদেশে আইয়ুব বা এরশাদের মতো সামরিক শাসকের সঙ্গী যেসব রাজনীতিক হয়েছেন তারা কখনওই মানুষের কাছে সম্মানিত হননি। আপনারা পাকিস্তানে মঞ্জুর কাদের, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সৈয়দ শরিফুদ্দিন পীরজাদা, মুশাহিদ হুসেন এবং এস এম জাফরের কথা বিবেচনা করুন, কিংবা বাংলাদেশে যদি ধরি কোরবান আলী, আবদুল হালিম চোধুরী, একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, মওদুদ আহমদ, মীজানুর রহমান চৌধুরীসহ অনেক রাজনীতিকের কথাই বলতে পারি। এঁদের প্রথম জীবনে যে সুখ্যাতি ছিল তা সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে থাকার পর নষ্ট হয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সামরিক শাসনের ঐতিহ্য শুধু সামরিক একনায়কদের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্যই সবসময় বিপর্যয় বয়ে এনেছে। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে জেনারেল আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানকে আইয়ুব খানের স্থলাভিষিক্ত হতে অনুমতি দেননি তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের স্পীকার আবদুল জব্বার খান। তবে ইয়াহিয়া খানের উচ্চাভিলাষ শেষতক পূরণ হয় এবং আইয়ুব খান তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এখানে এটি মনে রাখার বিষয় যে, ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে বিদেশে যেতে বাধ্য করেছিলেন। এ কাজে সে সময় আইয়ুবের সহযোগী ছিলেন ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে তাঁর দেয়া প্রথম ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিছু ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করেছিলেন। তবে যখন নির্বাচনের জনরায় আওয়ামী লীগের পক্ষে গেল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসার পরিস্থিতি তৈরি হলো, তখন ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বা জুলফিকার আলী ভুট্টো (সাংবিধানিকভাবে তখন তাঁর বিরোধী দলের নেতা হওয়ার কথা ছিল) কেউই তাতে খুশি হতে পারেননি। তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত সরকারপ্রধান হতে দিতে চাননি। আর এর ফল হলো ভয়াবহ। ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নতুন নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। সামরিক শাসন একটি জাতির চেতনাকে ধ্বংস করে ফেলে। এটি মানুষ, তার সমাজ এবং একটি জাতিকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এ শাসন রাজনীতিকে বিভক্ত করে মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। এটি রাজনীতিকে অসম্মানিত করে রাজনীতিবিদদের ছিদ্রান্বেষণের চেষ্টায় থাকে সদা ব্যস্ত। আর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে সমাজে। আইয়ুব খান রাজনীতিবিদদের খাটো করেছেন, ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ফলাফল না মেনে একটি অসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দিয়েছেন। জিয়াউর রহমান আমাদের পুরো জাতিকেই কলঙ্কিত করেছেন তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। প্রথমত জিয়া রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। আবার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো একটি কলঙ্কিত আইন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছেন। আবার পাকিস্তানে যা কিছু সুন্দর ছিল তার সবকিছু নষ্ট করেছেন জেনারেল জিয়াউল হক। জেনারেল পারভেজ মোশারফ ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে এক অদ্ভুত আঁধারের দিকে ধাবিত করেছেন। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছেন। তাঁর নয় বছরের শাসনে পুরো জাতিকে অন্ধকারের দিকে নিক্ষেপ করেছেন। প্রতিটি ঘটনায় স্বৈরাচারী সামরিক শাসকরা ক্ষমতাপট থেকে বিদায় নেয়ার পর রাজনৈতিক শক্তিকেই এসব সংবিধান বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিতে হয়। একটি বিষয় আমাদের কখনও ভুললে চলবে না, কোন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকই কখনও কোন সেনাশক্তিকে ‘দেশরক্ষার’ জন্য ডেকে আনেন না। লেখক : কলামিস্ট
×