ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

তত্ত্বাবধায়ক থেকে সহায়ক সরকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৩০ জুলাই ২০১৭

তত্ত্বাবধায়ক থেকে সহায়ক সরকার

নির্বাচন এলো বলে। সবাই বলছে নির্বাচন এলো বলে। সংবাদমাধ্যমও ঘটা করে বলছে এ কথা। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপও বলছে সে কথা। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির পদক্ষেপ হিসেবে তারা দলকে ঢেলে সাজাচ্ছে। সাজ সাজ রব বোধহয় এখনও ওঠেনি। তবে নেত্রীর অনুসারীরা বলছে, তিনি বিলাত থেকে ফিরে এলেই সাজ সাজ রব শুরু হবে। কিন্তু সাজ সাজ রব কিসের জন্য? এখানেই তো মজা। সাজ সাজ রব নির্বাচনের জন্য নয়। সাজ সাজ রব নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে বা হতে হয়েছে নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির জন্য। যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ’৯৬ সালে সে সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় না বিরোধীদল এমন কথা জানিয়েছিল জোরের সঙ্গে। নির্বাচনে ভোট চুরি হয়েছিল নির্লজ্জভাবে এ কথা প্রমাণিত হয়েছিল নিঃসন্দেহে। এমন ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে ঘটেছিল কি? আমরা শুনিনি। তবে পৃথিবীর খোঁজখবর রাখেন এমন কিছু মানুষ বললেন, ‘হ্যাঁ এমন ঘটনা ঘটেছিল।’ তাঁরা দু’একটি দেশের নামও বলেছিলেন। কেউ সেগুলো যাচাই করে দেখেছিলেন বলে শুনিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলেছিল। ওই জাতীয় সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করার জন্য। নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালিত হয়েছিল কি? কে জানে! তবে পরাজিতপক্ষ প্রতিবার বলেছে, নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি। এই যদি অবস্থা হয় তবে মনে প্রশ্ন জাগে, ‘তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কি লাভ হলো? এরও চেয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। কে হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান? তখনকার দিনের সংবিধান পড়লেই সমস্যাটা বোঝা যেত। ইনি সরকারপ্রধান হতে না চাইলে উনি হবেন। এই রকম ছিল ব্যাপার-স্যাপার। এই রকম হতে হতে এক সময় এমন পরিস্থিতি দেখা দিত, যে কেউ সরকারপ্রধান হতে পারতেন। অবিশ্বাস্য তাই না? কিন্তু এভাবেই ফকরুদ্দীন সরকারপ্রধান হয়েছিলেন। আর একটি বড় সমস্যা ছিল। কতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে? কিছুই লেখা ছিল না সংবিধানে। মুখে মুখে রটেছিল যে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কোথায় লেখা ছিল এ কথা? লেখা থাকলে ফকরুদ্দীন সরকার প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় থাকে কি করে? দেশে রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের একধরনের অবিশ্বাস রয়েছে। এই অবিশ্বাসের অংশ হিসেবে রাজনীতিবিদদের প্রতি রাজনীতিবিদেরও অবিশ্বাস রয়েছে। এ জন্যই একটি দল ক্ষমতায় থাকলে অন্য দল মনে করে যে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে কারচুপি করবে। সমস্যা হচ্ছে এই যে নির্বাচনে কারচুপি বন্ধ করতে গিয়ে দেশ তুলে দেয়া হচ্ছিল অনির্বাচিত সরকারের হাতে। আর একটি প্রশ্ন মনে জাগে এবং সেটি হচ্ছে এই যে রাজনীতিবিদদের প্রতি যদি আমাদের অবিশ্বাস থাকে তবে বিশ্বাস আছে কার উপরে? সেনাবাহিনী যেমন রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেয় রাজনীতিবিদরা তো সে রকম করতে পারে না। অন্য দেশগুলো যদি নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারে তবে আমরা পারি না কেন? আমাদের বিশ্বাস, যদি প্রচলিত প্রক্রিয়াগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় নির্বাচনে পুকুরচুরি হবে না। এই প্রক্রিয়া জানতে হবে। আসলে আমাদের নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে আমাদের আরও সজাগ হতে হবে। শুধু অন্যের দোষ ধরে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যাবে না। এখন দেখা যাক, কি হয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর! ২০০৮ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ যথাসময়ে নির্বাচন দিল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিল। বিরোধী বিএনপি জোট এটা ভালভাবে নিল না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ২০০৬ সালে বলেনি যে তত্ত্বাধায়ক সরকার প্রথা চিরদিনের জন্য চলবে। পরবর্তীকালেও একটি রায়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান সেনাপতি বলেন, পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রক্রিয়ায় করতে পারে। গণপরিষদ তেমন ইচ্ছা করেনি। ফলস্বরূপ ২০১৩ সালের নির্বাচন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হবে বলে সরকার ঘোষণা করে। বিরোধীদল এটি গ্রহণ করল না। দুই দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা সফল হলো না। বিরোধীদল আন্দোলনের পথ বেছে নিল। গণতন্ত্রে আন্দোলনের অধিকার সবার রয়েছে। কিন্তু আন্দোলন শুরু“হওয়ার পর রাজপথে যে দৃশ্য দেখা গেল সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। কয়েক শ’ মানুষ প্রাণ হারালেন। এছাড়া ভাঙচুর, অগ্নিকা- চলেছে ব্যাপকহারে। রেলগাড়ি পোড়ানো হয়েছে, রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। ব্যাপকভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানো হয়েছে। নির্বাচনের প্রচলিত পদ্ধতিকে নাকচ করে দিয়ে বিএনপি জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিল এবং তা করতে যেয়ে এতসব কাণ্ড করেছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিন্দা করেছিল। পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য অনেক সময় কৌশল বদলাতে হয়। কিন্তু চিন্তাধারার মধ্যে অবশ্যই সামঞ্জস্য থাকা উচিত। বিএনপি জোটের অবস্থা এখন তাদের সমর্থকদের মধ্যেও নৈরাশ্যের সৃষ্টি করেছে। মনে হয় তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান। মনে হয় নেতাদের মনোভাবও একই। কিন্তু তাদের নেতৃত্বের মধ্যে একশ্রেণীর দোদুল্যমানতা রয়েছে। নেত্রী বলেছেন, হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় না। কিন্তু কথাটা হচ্ছেÑ হাসিনার ক’জন ব্যক্তি মাত্র নন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি জোটের নেতাদের কথা শুনলে মনে হয় তাঁরা সরকার পরিবর্তন করে তারপর নির্বাচন করবেন। অর্থাৎ তাঁরা প্রথমে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন করবেন। মনে হয় অতীত রেকর্ডের জন্য তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করতে লজ্জা পাচ্ছেন। তাই তাঁরা আন্দোলন করবেন ‘সহায়ক’ সরকারের জন্য। এদের কাজে পার্থক্য হবে কি? দাবিদাররা তো কিছুই বলেননি। বিএনপি নেতাদের অতীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, তাঁরা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে পারেননি। এবারে কি পারবেন? অতীতের কথা স্মরণ করে স্থানীয় সরকারের মতো সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াস্ট্রিটের ফেলো
×