ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক;###;মূল : হারিস খালিক

পাকিস্তানে ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৩০ জুলাই ২০১৭

পাকিস্তানে ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে

রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ধ্যান-ধারণা বা মতাদর্শের ভিত্তিতে দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে এমন ঐতিহ্য পাকিস্তানের নেই। প্রতি কয়েক বছর পরপর সামরিক বাহিনীর প্রাধান্যপুষ্ট স্থায়ী কায়েমি স্বার্থের মদদে নতুন এক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা হয় দক্ষিণপন্থী। ঘুরে ফিরে আসা এক সেট ভোল পাল্টানো এবং অন্যান্য দল থেকে নতুন কিছু দলছুট কায়েমি স্বার্থের আশীর্বাদ ধন্য এই নতুন দলে তড়িঘড়ি যোগ দেয় এবং সেই নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দলটির বিরুদ্ধে এই নতুন দলকে হিংস্রভাবে লেলিয়ে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ২০১৩ সালে সর্বাধিকসংখ্যক ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খান ও তার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টি বাহ্যত কায়েমি স্বার্থের আশীর্বাদপুষ্ট দলের ভূমিকা পালন করছে এবং পানামা পেপার্সে শরীফ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ঘুষ ও মানি লন্ডানিংয়ের যেসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে। পরবর্তীকালে আদালতের নির্দেশে তদন্ত অনুষ্ঠিত হয় যার মধ্যে পাকিস্তানের সর্ব শক্তিধর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্তকারীরাও ছিলেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি শরীফ পরিবারের জন্য অত্যন্ত হানিকর হয়েছে। পঙ্কিল পথে পাকিস্তানে কিভাবে ধনী হওয়া যায় এখানে তার বিবরণ আইনকে নিজ স্বার্থে সুকৌশলে কাজে লাগান, ব্যাংক ঋণ মওকুফ করিয়ে নিন, হিসাব রক্ষণে নিয়মবহির্ভূত রীতির আশ্রয় নিন, শুল্ক ও কর ফাঁকি দিন এবং শ্রমিক শোষণ করুন। জনাব শরীফ ও তার পরিবার অন্য যারা কুপথে ধনী হয়েছেন তাদের থেকে ভিন্ন কিছু নন। এই ধনীদের কেউ কেউ আবার ইমরান খানের পিটিআই দলেও যোগ দিয়েছেন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন এবং একটি আদালত ইমরান খানের বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে। নিজ দলের জন্য বিদেশী অর্থায়নের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আছে সে ধরনের অর্থায়ন পাকিস্তানের আইনে নিষিদ্ধ। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর প্রতি নমনীয় ভূমিকা প্রদর্শনের জন্য ইমরান খানের হয়ত লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়া উচিত। তবে পাকিস্তানে কুপথে যারা ধনী বনে গেছে তিনি তাদের সঙ্গে নেই এবং বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতির কুখ্যাতিও তার নেই। তারপরও নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে তার প্রচারাভিযানের উদ্দেশ্য ও পরিণতি নিয়ে সংশয় আছে এবং ক্রমবর্ধমান এই আশঙ্কাও আছে যে ইমরান খানের পিটিআই হচ্ছে কায়েমি স্বার্থের আশীর্বাদপুষ্ট দলের সর্বশেষ সংস্করণ। এ ধরনের সংশয় সন্দেহ আশঙ্কা দেখা দেয়ার কারণ অতীতের পরিচিত ধারা ছিন্ন করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার দৃশ্যমান কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইমরান ১৯৯৬ সালে পিটিআই প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটা তার প্রতি নিখাঁদ আন্তরিকতায় অনুপ্রাণিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পেশাজীবীদের একসঙ্গে পরিণত হয়। গত ৬ বছরে এই অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে। ইমরানের প্রতিপক্ষরা প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর দল আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমর্থন লাভ করেছে। বর্তমানে দক্ষিণপন্থী ঝোঁকসম্পন্ন পিটিআইবিত্তশালী শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। অন্য দলগুলো থেকে ভোল পাল্টিয়ে আসা ও দলত্যাগী লোকজনকে এই দলটি সাদরে গ্রহণ করেছে। অথচ এই লোকজনের অনেকেরই দুর্নীতি ও অপকর্মের ইতিহাস আছে। গত কয়েক বছর ধরে দলটি নির্বাচনবহির্ভূত পন্থায় নওয়াজ শরীফের অপসারণের জন্য আন্দোলন করে আসছে। পানামা পেপার্সে সেসব তথ্য ফাঁস হয়েছে তাতে দলটির এই দাবি জোরদার হয়েছে মাত্র। পাকিস্তানে কায়েমি স্বার্থের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নৈরাশ্যজনক ইতিহাসের শুরু ১৯৫৫ সালে রিপাবলিকান পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান তখন ভারতের পূর্বাংশে ও পশ্চিমাংশে দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। সে সময় আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব ও আর্থিক বরাদ্দের দিক দিয়ে অধিক জনবহুল পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে অন্যায় সংখ্যা সাম্যের দাবি জানাতে আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর পরামর্শে পশ্চিম পাকিস্তানে রিপাবলিকান পার্টি গঠন করা হয়েছিল। দেশটির কায়েমি স্বার্থের আনুকূল্যপ্রাপ্ত প্রথম দল রিপাবলিকান পার্টি যে অবিচারের বীজ বপন করেছিল তার চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে বাংলাদেশে পরিণত হয়। রিপাবলিকান পার্টি গঠিত হওয়ার তিন বছর পর ১৯৫৮ সালে জেনারেল আয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে দলটি ভেঙে যায়। কয়েক বছর পর জেনারেল আয়ুব দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের আলখেল্লা ধারণ করার জন্য তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করেন। জেনারেল আয়ুব ক্ষমতা ছাড়ার অল্প কিছুদিনের মাথায় তার রাজনৈতিক দলটিও ভেঙে যায়। এভাবে একটা ধারা গড়ে উঠে। প্রতিটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর নতুন শাসক জেনারেল নতুন দল গঠনে উৎসাহ যোগাতেন এবং তাতে অধিকাংশই রক্ষণশীল রাজনীতিকদের আমন্ত্রণ জানাতেন ও গ্রহণ করতেন। দলটি জেনারেলের শাসনের বৈধতার একটা বাহ্যিক চেহারা এনে দেয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করত। জেনারেল দৃশ্যপট থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলটিও ভেঙে যেত বা বিলুপ্ত হয়ে যেত। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করেন। এরপর শাসক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে ধ্বংস করেন এবং পরে দলটির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলান। জেনারেল একটি দল গঠন করেন। দল পরিচালনার জন্য তিনি যাকে বেছে নিয়েছিলেন তার সঙ্গে মতান্তর ঘটার পর জেনারেল জিয়া ওই দলের মধ্যকার তার নিজস্ব অংশের নেতৃত্ব দিতে দলটির অন্যতম নেতা ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে উৎসাহিত করেন। নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন অংশটি পরে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ)-এ পরিণত হয়। বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর পর ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত এক বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অধ্যায় চলে। বেনজির ভুট্টোর পিপিপি এবং নওয়াজ শরীফের পিএমএলএন পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসে ও ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। ওটা ছিল এমন একটা সময় যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত বেনজিরের সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য নওয়াজ শরীফ সামরিক বাহিনীর ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছিলেন। নওয়াজ তখন বেনজিরের প্রতি যা করেছিলেন ইমরান এখন নওয়াজের প্রতি তাই করছেন। নওয়াজ শরীফ ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৯৯ সালে নওয়াজ তার সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু উল্টো তিনিই এক অত্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন। নওয়াজ শরীফ দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন এবং পরে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ২০০২ সালে জেনারেল মোশাররফ ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট এক নতুন দল গঠনে প্রভাব খাটান। ২০০৮ সালে তাঁর পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সেই দলটিও ভেঙে যায়। গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট দেশে সংঘটিত প্রতিটি সামরিক অভ্যুত্থানকে বৈধ বলে অনুমোদন দিয়েছিল। গুটিকয়েক বিচারপতি যারা এ ধরনের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল তাদের অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচিত সরকারগুলোর অপসারণ অনুমোদন করেছে, একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদ- দিয়েছে এবং আরেকজন প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত প্রতিটি সরকারকে দুর্নীতি ও অযোগ্যতার অভিযোগে অপসারণ করা হয়েছে। নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে বর্তমান মামলাটিকে ন্যায়সঙ্গত বলে গণ্য করা হবে যদি এর পরিণতিতে সিভিল সার্ভিস, সামরিক বাহিনী, বিচারবিভাগ ও বৃহৎ ব্যবসায়ী এমনকি যারা ইমরানের পাশে আছেন তাদেরসহ সকলের জবানদিহিতা নিশ্চিত করা হয়। যদি এর উদ্দেশ্য হয় শুধু নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করা তাহলে আমাদের কলঙ্কিত অতীত থেকে কোন ছেদ ঘটবে না। কয়েক বছর পর হয়ত দেখা যাবে যে ক্ষমতার এক নতুন বাহন এসে হাজির হয়েছে। সেটা টানার জন্য রাজার এত ঘোড়া ছিল সব জুতে দেয়া হয়েছে এবং রাজার আশীর্বাদধন্য লোকজন সবাই তাতে লাফ মেরে চড়ে বসেছে। [নিবন্ধের লেখক হারিস খালিক কবি ও প্রাবন্ধিক এবং ক্রিমসন পেপার্স : রিফ্লেকশনস অন স্ট্রাগল, সাফারিং এ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি ইন পাকিস্তান গ্রন্থের রচয়িতা। তার এই নিবন্ধটি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২৫ জুলাই অভিমত পাতায় প্রকাশিত হয়।]
×