ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তিলতার সব সম্পত্তি দখল করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ আজ তিনি আশ্রয়হীন

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৯ জুলাই ২০১৭

শান্তিলতার সব সম্পত্তি দখল করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ আজ তিনি আশ্রয়হীন

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ অভয়নগরের মাগুরা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যিনি ২২ বিঘা জমি দান করেছেন, তার এখন কোন জমি নেই। থাকেন পরের জমিতে। স্কুলের পাশে একটি জায়গায় মাটির ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সম্প্রতি সেই মাটির ঘরে সাপ পাওয়া যাওয়ায় তা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এখন তাকে থাকতে হচ্ছে পরের জায়গায়। তবে অভয়নগরের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা মনদীপ ঘরাই জমিদাতা শান্তিলতাকে থাকার জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জানা গেছে, অভয়নগরের মাগুরা গ্রামে বাস করতেন মঙ্গল বিশ্বাস নামে এক বিত্তশালী হিন্দু। শান্তিলতাকে বিয়ে দেয়া হয় বিদ্যুৎ ঘোষ নামে এক যুবকের সঙ্গে। ১৯৬৫ সালে মাগুরা গ্রামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় মঙ্গল বিশ্বাস স্কুলটির জন্য ৩৩ শতক জমি দান করেন। শান্তিলতা ছাড়া মঙ্গল বিশ্বাসের আর কোন সন্তান না থাকায় তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার সব সম্পত্তির মালিক হন শান্তিলতা। এদিকে শান্তিলতার কোন সন্তান না হওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বাবার ভিটায় ফিরে আসেন। এ অবস্থায় বাবা ও স্বামীহারা শান্তিলতা দারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন। এ সুযোগে এলাকার এক শ্রেণীর পরসম্পদলোভী মানুষ শান্তিলতার জমিজমা জবরদখল করে নিতে থাকে। এভাবে তারা প্রায় সব সম্পত্তি দখল করে নেয়। তার এ অসহায়ত্বের সুযোগে মাগুরা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সব সম্পত্তি কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে এক ফন্দি আঁটে। তারা শান্তিলতাকে এ মর্মে ভুল বোঝায় যে, আরও কিছু জমি না হলে স্কুলটি থাকবে না। মহৎপ্রাণ শান্তিলতা স্বামীর দেয়া জমির ওপরের স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে মানতে না পেরে স্কুলের নামে আরও ১১ বিঘা জমি দান করতে সম্মত হন। অমানবিক বিষয় হলো- নিরক্ষর, নিরীহ ও সরলপ্রাণ এ মহিলাকে রেজেস্ট্রি অফিসে নিয়ে ফাঁকি দিয়ে ১১ বিঘার জায়গায় ২২ বিঘা সম্পত্তির সবটুকু লিখে নেয়। এদিকে, যারা শান্তিলতার সম্পত্তি জবরদখল করে রেখেছিল তাদের স্কুল কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করে স্কুলের দখলে নিয়ে নেয়। এই যখন অবস্থা তখন শান্তিলতা স্কুল কর্তৃপক্ষের কারচুপির কথা জানতে পারেন। তিনি বাকি জমি ফেরত পেতে আদালতের শরণাপন্ন হন। তিনি জানান, গৌতম কুমার দে নামে তার এক পালিত পুত্র আছে। নিঃসন্তান শান্তিলতা গৌতমকে ২১ দিন বয়সে দত্তক নেন। সেই থেকে নিজের সন্তানের মতো তাকে মানুষ করেছেন। তাকে বিয়ে দিয়েছেন। তার দুটি সন্তানও হয়েছে। মা হিসেবে তাদের ভবিষ্যতের জন্য বাকি জমি তিনি গৌতমকে দিয়ে যাবেন। এটি তার নৈতিক দায়িত্ব। এজন্য তিনি আইনের আশ্রয় নিয়েছেন।প্রায় এক যুগ ধরে মামলাটি চলছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে মারও খেয়েছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা এ নারী। স্কুল কম্পাউন্ডে প্রবেশ করায় স্কুল থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার ঘটনা দাগ কেটে রয়েছে তার মনে। গত বছরপাঁচেক আগে স্থানীয় কতিপয় মানবিকগুণসম্পন্ন মানুষের চাপের মুখে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শান্তিলতার আমৃত্যু দেখভালের দায়িত্ব নেয়ার অঙ্গীকার করে। এজন্য তাকে প্রতি মাসে ৫০ কেজি চাল, বছরে দুটি শাড়ি, নগদ কিছু টাকা ও তেল-সাবান দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ সাত-আট মাস এ অঙ্গীকার রক্ষা করলেও পরে তা মানেনি। গত প্রায় চার বছর শান্তিলতাকে কিছুই দেয়া হচ্ছে না। উল্টো তাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। এ অভিযোগ করেছেন শান্তিলতা। স্কুল কম্পাউন্ডের এক কোণে ঝোপঝাড়ের মধ্যে শান্তিলতার একটি কুঁড়েঘর ছিল। ওই ছোট্ট খুপড়িঘরে পালিত পুত্র গৌতম, ওই পুত্রের স্ত্রী ও তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছিলেন অসহায় এ বৃদ্ধা। কিন্তু সে আবাসটিও এখন নেই। তা ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে। গত ১৪ জুলাই তার ঘরে সাপের সন্ধান পাওয়া যায়। ওঝা এনে ঘরটি থেকে পাওয়া যায় পাঁচটি গোখরা সাপ ও ২৪ ডিম। আর এ কারণে শান্তিলতার ঘর ভেঙ্গে ফেলে মাটি কেটে সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয় শান্তিলতার। যিনি নিজের সর্বস্ব দান করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করেছেন, তাকে এখন থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। তিনি আজ নিঃস্ব-রিক্ত। আইডি কার্ডের হিসাব অনুযায়ী শান্তিলতার বয়স ৭৭। তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তার চলার শক্তিটুকুও নেই। নেই চোখের জ্যোতিও। শান্তিলতার ঘরে সাপের ঘটনাটি এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না। রাতে সাপের ভয়ে অন্যের বাড়িতে ঘুমালেও স্কুলের একটি রুমে ঠাঁই হয়নি তার। ওই অঞ্চলের কারও দয়া হয়নি শান্তিলতার ঘরটি তৈরি করে দেয়ার ব্যবস্থা করার। শান্তিলতার জমির ওপর অনেক দোকান আছে, যার ভাড়ার টাকা স্কুল কর্তৃপক্ষ পায়। ওই দোকানগুলোর মধ্যে কয়েকটি দোকানের ভাড়ার টাকা শান্তিলতাকে দিলেও সমস্যা সহজে মিটে যায়। কিন্তু অবাধ লুটপাটের কারণে কোনটাই করা হচ্ছে না। শান্তিলতার এ করুণ অবস্থার কথা জেনে অভয়নগর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা মনদীপ ঘরাই টানা বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছিলেন তার ভাঙ্গা কুটিরে।শান্তিলতা তখন খোলা আকাশের নিচে বসেছিলেন।
×