ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার দাবিতে মানববন্ধন-সমাবেশ

করতোয়ার একাল সেকাল

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৯ জুলাই ২০১৭

করতোয়ার একাল সেকাল

দেশের প্রাচীনতম করতোয়া নদীর টুঁটি চেপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হচ্ছে। সেদিনের করতোয়া ছিল বিশালাকায় স্র্রোতস্বিনী আজ তা কঙ্কালসার। নদী অস্তিত্ব হারিয়ে মরা গাঙে পরিণত। দেখে মনে হবে কোন এক খাল। নদী এখন আর প্রকৃতির অলঙ্কার নয়। নদী এখন প্রকৃতিকে সাজাতে পারে না। করতোয়ার সেই সৌন্দর্য আজ কালের গর্ভে বিলীন। কেমন ছিল করতোয়া! ইতিহাস প্রমাণ দেয় : হাজার বছরের প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতে করতোয়ার কথা উল্লেখ আছে। করতোয়া নদী ছিল গঙ্গা নদীর তিনগুণ। ১১১৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গদেশ অভিযানের সময় রচিত একটি গ্রন্থে করতোয়া যে গঙ্গার চেয়ে কতগুণ বড় ছিল তার বর্ণনা দেয়া আছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে করতোয়া নদী পবিত্র। পুরাণে আছে, দেবতা শিব পার্বতীর বিয়ের সময় শিবের কররেখা থেকে এই নদীর জলধারার উৎপত্তি। ব্রিটিশ শাসনামলে রেনেলস জরিপের মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাতে উল্লেখ আছে, করতোয়ার তীরে গড়ে ওঠে এক প্রসিদ্ধ নগরী। যার রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে পুন্ড্রনগরী খ্যাত মহাস্থানগড়ে প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ সেই সভ্যতাকেন্দ্রিক ইতিহাস ধারণ করে আছে। করতোয়া নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের পশ্চিবঙ্গের (বর্তমানে বাংলা) উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকণ্ঠপুরের অরণ্যগর্ভে। ভুটানের সীমান্ত বেয়ে দার্জিলিং জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর অঞ্চল ছুঁয়ে করতোয়ার জলধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দূর অতীতের এই বিশালাকায় নদীর পরিচিতি ছিল একক। ১৮৮৭ সালে এক ভয়াবহ ভূকম্পনে তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে করতোয়ার বিপর্যয় নেমে আসে। করতোয়ার গতিপথের পরিবর্তন হয়ে খ- বিখ- হয়ে যায়। নদী বিশেষজ্ঞগণ বলছেন ওই সময়ই করতোয়া চারটি অংশে বিভক্ত হয়। পঞ্চগড়ের করতোয়া, রংপুরের করতোয়া, বগুড়ার করতোয়া ও পাবনার করতোয়া। পঞ্চগড় হয়ে করতোয়া দিনাজপুর ও রংপুরের মধ্য দিয়ে বগুড়া জেলায় প্রবেশ করেছে। যা নীলফামারী ও গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালীর মধ্য দিয়ে বাঙালী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বাঙালী নদীর একটি স্্েরাতধারা বগুড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যা বগুড়ার করতোয়া নামে পরিচিতি। এই নদী চান্দাইকোনা অতিক্রম করে দক্ষিণে নলকায় ইছামতি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে হুরাসাগর নামে পাবনার বেড়ার কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই খ-িত করতোয়াকে দিনে দিনে হত্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বগুড়ার করতোয়া নদীর দুই ধারে নদী ভূমি দখল করে যেটুকু প্রবাহ ছিল তাও রুদ্ধ করা হয়েছে। এঁকেবেঁকে চলা নদীর এই সর্পিল গতি মানব সৃষ্ট দুর্যোগের কবলে পড়েছে। নদী কোথাও শীর্ণকায় এক খাল। কোথাও সামান্য পানি তাও দূষণে কালো হয়ে গেছে। কোথাও নদীর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে চাষের ভূমি। কোথাও নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবকাঠামো। নদীর কিছুটা ভিতরে ও নদীর মুখে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের বহুতল ভবন। নদীর ভিতরে নগরীর বর্জ্য আবর্জনা ফেলে বড় ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। পচা গন্ধে এই পথ ধরে হাঁটা যায় না। বর্ষায় যারপর নাই দুর্ভোগ নেমে আসে নদী ও জনজীবনের ওপর। প্রতিটি নদীর ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে। নদীর শুকিয়ে গেলেও সেই সীমারেখা বজায় থাকে। বগুড়ার করতোয়া নদী দেখে মনেই হবে না ‘একদা এখানে নদী ছিল’। প্রবীনরা বলেন কত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই নদী ছিল যা না দেখে বলা যাবে না। নিকট অতীতে করতোয়া তীরে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় শুধু জলরাশি। আজ আর সেই করতোয়া নেই। বগুড়া সদরের করতোয়া তীরবর্তী উত্তর ও দক্ষিণে নদীর ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। নদীর ভিতরে বাড়িঘর, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বগুড়া নগরীর নবাববাড়ী সড়কের ধারের একটি মার্কেটে নদী দখল করে মার্কেট সম্প্রসারিত করেছে। নগরীর রেলব্রিজ সংলগ্ন নদী ভূমি দেখে মনে হবে বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। করতোয়া দখলের কারণে মাটি ও পরিবেশ দূষণ, নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল, মাছের ক্ষতি জেলেদের পেশা বদল, স্থানীয় পদ্ধতিতে সেচের সঙ্কট, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং সর্বোপরি পানি সম্পদের বড় ক্ষতি হচ্ছে। করতোয়া নদীকে দখল মুক্ত করতে ইতোমধ্যে বগুড়া নগরীতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে করতোয়া নদী পুনরুদ্ধারে মানববন্ধন সমাবেশ করেছে। করতোয়া নদী রক্ষায় সনাকের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। এক সূত্র জানায় ঢাকা কেন্দ্রীয় রেকর্ড রুমে ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ড এবং ১৯৬২ সারের এম আর সংরক্ষিত আছে। প্রশাসন সেই রেকর্ড ধরে মাপজোক করলেই বুঝতে পারবে করতোয়া নদী কিভাবে দখল করা হয়েছে। একদিকে নদী দখল আরেক দিকে নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করে করতোয়াকে হত্যা করা হচ্ছে। পুরাণে ও মহাভারতে যে করতোয়ার উল্লেখ আছে সেই করতোয়া আর রইল না। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×