ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরকাসেম

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৯ জুলাই ২০১৭

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরকাসেম

মূল ভূখ- থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরকাসেমের মানুষ আকাশের কোণে কালো মেঘ দেখলে আঁতকে ওঠেন। মেঘের গর্জনে হাহাকার করেন। নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়তে দেখলে হাঁড়ি-পাতিল, বাক্সপেটরা গুছিয়ে ভেসে যাওয়ার ভয়ে গুটিয়ে থাকেন। আর বড় ধরনের ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস হলে নিজেদের প্রকৃতির কাছে সপে দেন। প্রকৃতি নির্ভরতার বাইরে তাদের কিছু করার নেই। বর্ষা মৌসুমের চার-পাঁচ মাছ তাদের এভাবেই কাটে। চরের চারপাশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ এবং সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় চরটির বাসিন্দারা এভাবেই বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা দ্বীপচর পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা। ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। গোটা উপজেলার চারপাশে বেষ্টন করে আছে বঙ্গোপসাগর আর আগুনমুখা, রামনাবাদ, বুড়াগৌরাঙ্গসহ কয়েকটি নদ-নদী। যা পুরো উপজেলাকে মূল ভূ-খ- থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এ বিচ্ছিন্ন উপজেলার ততোধিক বিচ্ছিন্ন একটি চরদ্বীপ চরকাসেম। যার তিনদিকে বুড়াগৌরাঙ্গ নদী আর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগরের জলরাশি। চরকাসেমের দক্ষিণে জনবসতি পূর্ণ চরদ্বীপ খুব কমই আছে। জানা গেছে, চরটি আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে বঙ্গোপসাগরের মোহনা ফুড়ে জেগে ওঠে। চরটির আয়তন তিন হাজার একরেরও বেশি। চরটির অবস্থান রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। রাঙ্গাবালী ও গলাচিপাসহ পটুয়াখালী জেলার নানা প্রান্ত থেকে নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন কারণে ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারিয়ে লোকজন গত ৩০-৪০ বছরে চরকাসেমে বসতি গড়ে তুলেছেন। বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল পেরিয়ে পূর্ব দিকে বর্তমানে ৪০-৫০টি পরিবার গোলপাতা ও খড় খুটা দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। অধিকাংশ পরিবারের প্রধান পেশা নদী-সাগরে মাছ ও কাঁকড়া শিকার। চরকাসেমের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে-চরে প্রচুর পরিমাণ সরকারী খাসজমি থাকলেও তা বাসিন্দাদের বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফলে এক টুকরো জমির আশায় যারা এ চরে বসত গড়েছেন, তারা ভুগছেন হতাশায়। তারা চাষাবাদও করতে পারছেন না। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে রাঙ্গাবালী সদর ইউনিয়নের ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা (তহসিলদার) মোঃ আবু জাফর জানান, চরকাসেমে ৩০০ একরের বেশি সরকারী খাসজমি রয়েছে। সংরক্ষিত বন রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার একর। এ চরে এখনও খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। চরকাসেমের পুরনো বাসিন্দা হাফিজুর রহমান (৭০) বলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ছিন্নমূল মানুষদের সরকারী খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার ঘোষণা দেন এবং কার্যক্রম শুরু করেন। গলাচিপা ও রাঙ্গাবালীর শত শত ভূমিহীন পরিবারকে বঙ্গবন্ধু চরের খাসজমি দিয়েছেন। এর পরই জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন এলাকার বসতভিটে হারানো বহু মানুষ চরকাসেমে এসে আশ্রয় নেয়া শুরু করে। কিন্তু তাদের কারও ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। কেউ পায়নি সরকারী খাসজমি। সরেজমিন চরকাসেমে গিয়ে দেখা গেছে, চরটিতে নেই কোন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা সাইক্লোন শেল্টার। নেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ। ফলে সেখানকার লোকজন সর্বদাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বসবাস করছেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমের চার-পাঁচ মাস বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক রকমের যুদ্ধ করে তাদের ঠিকে থাকতে হচ্ছে। অমাবশ্যা-পূর্ণিমার সময়ে নদী-সাগরের পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এ সময় গোটা চর প্লাবিত হয়। জোয়ারে ভেসে যায় চরবাসিন্দাদের বসতঘরসহ সহায় সম্পদ। আকাশে মেঘ কালো হলে ভোগেন ঝড়ের আতঙ্কে। বড় ধরনের ঝড় হলে অসহায়ের মতো প্রকৃতির কাছে সপে দেয়া ছাড়া তাদের কিছু করার থাকে না। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×