ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী

এলিয়েন এবং বৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৯ জুলাই ২০১৭

এলিয়েন এবং বৃষ্টি

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়াবার জায়গা ছিল না একটু আগেও। এখন অবশ্য মেহজাবিন ছাড়া আর দু’একজন ছাত্রছাত্রী আছে। বৃষ্টির জন্য সকল ছাত্রছাত্রী বারান্দাতে আটকা ছিল। বৃষ্টি এখনও থামেনি। তবে তুলনামূলক কমেছে। আর এই সুযোগে যারা ছাতা নিয়ে এসেছিল তারা ছাতা নিয়ে, আর যারা ছাতা নিয়ে আসেনি তাদের অনেকে স্কুলব্যাগ পলিথিনের মধ্যে ভরে বৃষ্টিতে ভিজে রওনা দিয়েছে। সেই ক্লাস শুরু থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্কুল ছুটির ঘণ্টা অনেক আগে বাজলেও বৃষ্টির ছুটির ঘণ্টা বাজার সময়ই যেন হচ্ছে না। মেহজাবিনের বৃষ্টি খুব পছন্দ। কিন্তু পছন্দ হয়েও লাভ নেই আজকে। কেননা আম্মুর কড়া নির্দেশ আছে কোনভাবেই বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না। সবে চার দিন আগে জ¦র থেকে সেরে উঠেছে ও। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে আবারও জ¦র আসার সম্ভাবনা থাকবে। অতএব বৃষ্টিকে আজ তার ‘না’। সে জন্যই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেহজাবিন। গত পরশু বাবা ওর জন্য একটা ছাতা নিয়ে এসেছে। লাল রঙের বাহারি ছাতা। অথচ সেই ছাতাটা নিয়ে আসা হয়নি। মেহজাবিন কি আর জানত যে স্কুলে আসার পরই বৃষ্টি শুরু হবে আর থামবে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে মেহজাবিন ওর ক্লাসে ঢুকে বেঞ্চে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঝিম মেরে রইল। দীর্ঘক্ষণ ওভাবে থাকল ও। চোখ তুলে আর বৃষ্টির দিকে তাকাতেই যেন মন চায় না। তবুও মেহজাবিন টেবিল থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। স্যারের টেবিলের পাশে চোখ যেতেই ওর চোখ যেন জ¦লজ¦ল করে উঠল। বাবার নিয়ে আসা লাল রঙের বাহারি ছাতাটা যেন স্যারের টেবিলের পাশ থেকে তারই দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে। ছাতাটা কিভাবে স্কুলের ক্লাসরুমে এলো? ওতো ছাতা নিয়ে আসেনি। তাহলে নিশ্চয় বাবা বৃষ্টি দেখে স্কুলে এসে কোন না কোন স্যারকে ছাতাটা দিয়ে গেছে ওকে দেয়ার জন্য। নইলে ছাতাটা কিভাবে আসবে। কিন্তু কেউ ছাতাটা তার হাতে দিল না কেন! মেহজাবিন বেঞ্চ থেকে উঠে ছাতাটা হাতে নিয়ে বাইরে চলে আসে। হাল্কা বৃষ্টি দেখে বাসার দিকে পা বাড়ায় ও। ঠিক স্কুল গেটের কাছে গিয়ে আবার উল্টো দিকে হয়ে বারান্দার দিকে ছুটতে থাকে। কেননা বৃষ্টি ঝিরিঝিরি থেকে ভারি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এভাবে বৃষ্টি পড়লে এই ছাতায় কাজ হবে না। পুরো শরীর ভিজে যাবে। আর ভিজে গেলেই আবার জ¦রের কবলে। স্কুল বারান্দার পৌঁছানোর পূর্ব মুহূর্তে কে যেন ওপর থেকে বলে উঠল, ‘কী হলো মেহজাবিন, ফিরে আসতেছ কেন?’ এ কথা কানে যেতেই থতমত খায় মেহজাবিন। এদিক-ওদিক তাকায়। নাহ্, ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে কাউকে দেখতে পায় না ও। যেদিকে তাকায় শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সেই আওয়াজ এর কোন তোয়াক্কা না করে ও বারান্দার কাছে চলে আসে। বারন্দার উঠবে এমন সময় বৃষ্টি অবার একবারে হাল্কা হয়ে গেল। থামল না। তবে ঝিরিঝিরিভাবে পড়তে থাকল। মেহজাবিন মুখ ঘুরিয়ে আবার বাসামুখী হলো। এবার কিছুদূর গিয়ে আবার তুমুল বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। থমকে দাঁড়িয়ে যায় ও। কী করবে এখন! ভেবে পায় না। আশপাশে কোন দোকানপাটও নেই যে গিয়ে আশ্রয় নেবে। এই ছাতা দিয়ে তো শুধু মাথা সেভ করা যাবে। ভিজলেই তো আবার অসুস্থ হবে। বৃষ্টি কি আজ ওর সঙ্গে খেলা শুরু করেছে নাকি। নানা ভাবনায় ডুবে থাকে মেহজাবিন। এমন সময় উপর থেকে আবার সেই কণ্ঠ। ‘কী চিন্তা করছো মেহজাবিন? এগিয়ে যাও তোমার কিছুই হবে না।’ ‘কে? কে তুমি? হকচকিয়ে যায় যেন মেহজাবিন। ওপরের কণ্ঠ বলে উঠে, ‘আমি সেই, যে বিপদে এগিয়ে আসে। বিপদে কেউ এগিয়ে আসলে তার পরিচয় কী হওয়া উচিত?’ ‘আমি জানি না। তুমি কে?’ ‘তুমি নিশ্চয় জানো। কেননা তুমি বইয়ে বহুবার পড়েছো।’ ‘ও মনে পড়েছে, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। তুমি আমার বন্ধু?’ ‘হু।’ ‘কিন্তু কেমন করে? তোমাকে তো আমি চিনি না। দেখতেও পাচ্ছি না।’ ‘এই যে তুমি বিপদে পড়েছ। বৃষ্টি হচ্ছে। এমনভাবে হচ্ছে ছাতা থেকেও তুমি বিপদে আছো। কেননা তোমার ভেজা যাবে না। আর আমি তোমাকে নিশ্চিত করব চুল পরিমাণও তুমি ভিজবে না। তুমি শুধু ছাতার হাতলটা শক্ত করে ধরে থেক।’ খুব সহজেই আচ্ছা বলে দিল মেহজাবিন। কিন্তু ঠিকই খানিক পরে আবার জানতে চাইল, ‘তুমি যদি আমার বন্ধু হবে তবে আমি তোমাকে দেখতে পাব না কেন?’ ‘অবশ্যই দেখতে পাবে। তবে এখন তো আমি তোমার ছাতার ওপর ঝুলে আছি। তাই দেখতে চাইলে ছাতা সরাতে হবে। আর ছাতা সরালে তুমি ভিজে যাবে। অথচ তোমার কিন্তু কোনভাবেই ভেজা যাবে না।’ ‘হু তাই তো। কিন্তু জানো বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়।’ ‘হু, আমি জানি। তোমার বৃষ্টি প্রিয় অথচ বৃষ্টির কাছে থেকেও তুমি ভিজতে পারছ না। আর আমি ভেজার জন্য ছুটে এসেছি অন্য গ্রহ থেকে।’ ‘অন্য গ্রহ থেকে?’ ভুরু কুঁচকে যায় মেহজাবিনের। ‘হু।’ ‘তাহলে তো তুমি এলিয়েন।’ ‘হু। তোমরা তো আবার ভিনগ্রহের প্রাণীদের এলিয়েন-ই বলো।’ অতি বৃষ্টির কারণে রাস্তায় পানি উঠেছে। অথচ সেই পানি তার পা ছুঁতেই পারছে না। ছাতাটা যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। নিশ্চয় ওপর থেকে ছাতাটা ধরেছে এলিয়েন। এলিয়েন সত্যিই ওকে সহযোগিতা করছে ভেবে খুব ভাললাগে মেহজাবিনের। মেহজাবিন আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা তোমার ইউএফওটা কোথায়?’ ‘ইউএফও!’ এলিয়েনটা থতমত খায়। ‘সেটা আবার কী?’ ‘ও মা বলে কী। তুমি যেটাতে চড়ে এ পৃথিবীতে এসেছ। সেটাই তো ইউএফও।’ এলিয়েনটা বলল, ‘ও আচ্ছা। ওটার পূর্ণরূপ হচ্ছে, আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট। তোমাদের পৃথিবীর মানুষদের এই এক সমস্যা তোমরা সব কিছু শর্টকার্ট করে ফেল।’ মেহজাবিন কিছু বলল না। এলিয়েনটা আবার বলল, ‘ঐ যান তো আমার সঙ্গেই আছে।’ ‘ওটাকে কি ছোটবড় করা যায় নাকি?’ ‘হু যায়। বাদ দাও ওসব। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার খুব আনন্দ লাগছে। আচ্ছা তোমাদের পৃথিবীতে তো বৃষ্টি নিয়ে অনেক কবিতা আছে। আমি একটা কবিতা শোনাই। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কবিতাটা বানালাম। শুনবে?’ মেহজাবিন বলল, ‘অবশ্যই শুনব।’ ‘তাহলে শোন, বৃষ্টিতে ভিজে এক এলিয়েন বৃষ্টির সাথে খুব খেলিয়েন বৃষ্টির কাছ থেকে উদারতা শিখে নিয়ে আনন্দে উড়বার পাখনাটা মেলিয়েন বৃষ্টিতে ভিজে এক এলিয়েন।’ মেহজাবিন বলল, ‘অনেক সুন্দর হয়েছে।’ কবিতা বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে মেহজাবিন এসে বাসায় পৌঁছে গেল। বাসার বারান্দায় ছাতাটা রেখে ও এলিয়েনকে খুঁজতে লাগল। বন্ধু বন্ধু বলে ডাকতেও থাকল। বলল, বন্ধু তুমি কোথায়? কিন্তু এলিয়েনটা কোন সারা শব্দ করল না। মেহজাবিন মন খারাপ নিয়ে অনেকক্ষণ পর ওর রুমে ঢুকল। রুমে ঢুকে ওর টেবিলে চোখ যেতেই আকাশ সমান চমকে উঠল ও। বাবার নিয়ে আসা লাল রঙের বাহারি ছাতাটা তো তার টেবিলেই পড়ে রয়েছে। তাহলে যে ছাতাটা মাথায় দিয়ে আসল সেটা কার ছাতা! টেবিল থেকে ছাতাটা হাতে নিয়ে মেহজাবিন দ্রুত বাইরে বেরুল। বাইরে বেরিয়ে যা দেখল তা যেন নিজের চোখকে বিশ^াস করাতেই পারছে না। বারান্দায় রাখা ছাতাটা বৃষ্টিতে ভিজছে। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×