ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

সব সীমান্ত যদি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৯ জুলাই ২০১৭

সব সীমান্ত যদি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়

শ্রম হলো বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য। অথচ কঠোর ইমিগ্রেশন বা অভিবাসন আইনের কারণে এই শ্রমের বেশিরভাগই অপচয় হয়। মেক্সিকোর শ্রমিক যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারলে ১৫০ শতাংশ বেশি আয় করতে পারে। নাইজিরিয়ার অদক্ষ শ্রমিক পারে এক হাজার শতাংশ বেশি আয় করতে। নাইজিরিয়ার মানুষকে নাইজিরিয়ায় থাকতে বাধ্য করা কৃষকদের এন্টার্কটিকায় চাষাবাদ করতে বলার মতোই অর্থহীন। মানুষ যদি অবাধে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল করতে পারে তার অর্থ হবে শ্রমের অবাধ চলাচল। শ্রমের অবাধ চলাচল শ্রমিকের আয় বাড়িয়ে দেয়। শ্রমের অবাধ চলাচলের জন্য দরকার ‘উন্মুক্ত সীমান্ত’। উন্মুক্ত সীমান্ত মানে এই নয় যে, কোন সীমান্ত থাকবে না কিংবা জাতি-রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটবে। সব ঠিকই থাকবে। শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া-আসাটা বাধাবিঘœমুক্ত হবে। দেশান্তর গমনের ব্যাপারটা অতি আকর্ষণীয়। সেটা হওয়ার একটা কারণ হলো কিছু দেশ অর্থনীতি, প্রশাসনসহ সব দিক দিয়ে অতি আকর্ষণীয় এবং অন্য দেশগুলোর অবস্থা অতি শোচনীয়। ধনী দেশগুলোর শ্রমিকরা গরিব দেশগুলোর শ্রমিকদের তুলনায় অধিক আয় করে। সেটা অংশত এই কারণে যে, তারা অধিকতর শিক্ষিত। তবে অধিকাংশত এর কারণটা হলো তাদের বাস এমন সমাজে যেখানে বহু বছর ধরে কালক্রমে এমন সব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলো সমৃদ্ধি ও শান্তির সহায়ক। কানাডীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কানাডিয়ায় স্থানান্তর করা খুব কঠিন। কিন্তু কম্বোডিয়ার একটি পরিবারের পক্ষে বিমানে করে কানাডায় চলে যাওয়া খুবই সহজ। চরম দারিদ্র্য দূর করার সহজতম উপায় হলো যেখানে সেই দারিদ্র্য বিদ্যমান সেখান থেকে লোকদের বাইরে যেতে দেয়া। বাইরে বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে গেলে তাদের দারিদ্র্য সে দেশের নাগরিকদের কাছে অধিকতর দৃশ্যমান হবেÑ বিশেষ করে তারা যখন লাইবেরিয়া বা এই শ্রেণীর গরিব দেশের মানুষদের টেবিল পরিষ্কার করা বা শেলফ গোছানোর কাজ করতে দেখবে। কিন্তু তারপরও তাদের দারিদ্র্যের তীব্রতা হবে অনেক কম। সীমান্ত যদি উন্মুক্ত থাকে তাহলে কত মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাবে? ২০১৩ সালে গ্যালাপ পোলের হিসাবে দেখানো হয় যে, ৬৩ কোটি নর-নারী অর্থাৎ বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৩ শতাংশ পারলে অন্য দেশে স্থায়ীভাবে এবং এরও বেশি অস্থায়ীভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমাবে। এদের প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ যুক্তরাষ্ট্রে, ৪ কোটি ২০ লাখ ব্রিটেনে এবং ২ কেটি ৯০ লাখ সৌদি আরবে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। গ্যালাপের এই সংখ্যাটা হয়ত অতিবাঞ্ছিত। লোকে যা করবে বলে তা সর্বদা করে না বা করতে পারে না। অনেকে বিরাট ও বৈষয়িক লাভের সম্ভাবনা জেনেও স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে যেতে রাজি হয় না। জার্মানিতে মজুরি গ্রীসের মজুরির দ্বিগুণ। ইসির নিয়মানুযায়ী গ্রীকরা অবাধে জার্মানিতে যেতে পারে। কিন্তু ২০১০ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে ১ কোটি ১০ লাখ লোকের জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে মাত্র দেড় লাখ লোক সে দেশে গেছে। ১৯৮৬ সাল মাইক্রোনেশিয়ার নাগরিকদের বিনা ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসবাস ও কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মাইক্রোনেশিয়ায় থেকে গেছে যদিও যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় তাদের দেশের ২০ গুণ। এসব অবস্থা সত্ত্বেও মোটামুটি বাজি ধরে বলা যায় যে সীমান্ত থাকলে বিপুল সংখ্যক লোকের প্রবাহ ঘটবে। বিশ্বব্যাপী ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর ব্যবধান ইউরোপের ভেতরকার সর্বাধিক ধনী ও অপেক্ষাকৃত কম ধনী দেশগুলোর মধ্যকার ব্যবধানের চাইতে অনেক বেশি। তাছাড়া অনেক দরিদ্র দেশ শুধু যে গরিব তা নয়, উপরন্তু সেখানে নিপীড়নমূলক সরকার ক্ষমতায় আছে। আজ ধনী দেশগুলোর লোকসংখ্যা ১৪০ কোটি এবং অতটা ধনী নয় এমন দেশগুলোর লোকসংখ্যা ৬০০ কোটি। এমন কল্পনা মোটেই অবাস্তব কিছু নয় যে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এই জনগোষ্ঠীর একশ’ কোটি বা তারও বেশি লোক আইনগত কোন বাধা না থাকলে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে পারে। স্পষ্টতই এর ফলে ধনী দেশগুলোর রূপান্তর এমন সব উপায়ে ঘটতে পারে যার ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। গন্তব্যস্থল দেশগুলোর ভোটাররা অভিবাসন নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না। তবে শঙ্কিত বোধ করে এই ভেবে যে সত্যি সত্যি সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া হলে তাদের চারপাশে বিদেশীরা গিজ গিজ করবে। এর পরিণতিতে তাদের জীবনের অবস্থার অবনতি ঘটবে এবং যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে তাদের দেশ প্রথম কাতারে চলে আসতে পেরেছে সেটি সম্ভবত বিপন্ন হবে। তাদের উদ্বেগবোধ করার আরও কারণ হলো ব্যাপক হারে বাইরের লোক আগমনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ ও সন্ত্রাসেরও আগমন ঘটবে, স্থানীয়দের মজুরি কমে যাবে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ওপর অসম্ভব চাপ পড়বে। ভয়াবহ লোকাধিক্য হবে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান সংহতি মারাত্মকভাবে নস্যাত হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, দুর্বৃত্তকবলিত গুয়াতেমালা কিংবা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ কঙ্গো থেকে ভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি তাদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামাও নিয়ে যায় তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াবে? অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিকরা এই বিষয়টিকে পুঁজি করে তাদের আশঙ্কাকে বড় করে দেখান। তবে এমন আশঙ্কা নেহায়েতই অনুমানমূলক এবং এর সমর্থনে বাস্তব কোন প্রমাণ নেই। এটা ঠিক যে, অভিবাসীদের কেউ কেউ অপরাধ করে এমনকি শিরোনাম কেড়ে নেয়ার মতো সন্ত্রাসী কর্মকা-ও করে। কিন্তু দেখা গেছে সে আমেরিকান বিভিন্ন অপরাধের কারাবন্দীদের মধ্যে দেশজ নাগরিকরা শতজন তাদের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ হলো এই বিদেশজাত মানুষ। সুইডেনের মতো কিছু কিছু ইউরোপীয় দেশে অভিবাসীরা স্থানীয়দের তুলনায় বেশি গোলমালে জড়ায় এবং সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কারণে যে তারা তরুণ ও পুরুষ। ১৯৭০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১৪৫টি দেশে অভিবাসন প্রবাহের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে অভিবাসনের কারণে সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার বদলে বরং কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং সেটা বহুলাংশে এই কারণে অভিবাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটায়। ব্যাপক আকারে অভিবাসনের কারণে কি স্থানীয়রা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়? এর জবাব হলোÑ এ পর্যন্ত তা হয়নি। বরং দেখা গেছে, স্থানীয়দের চেয়ে অভিবাসীরাই নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে আসে এবং নিজেরাই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দেয় ও তাতে অনেক স্থানীয়কে নিয়োগ করে। সামগ্রিকভাবে স্থানীয়দের তুলনায় অভিবাসীরা সরকারী অর্থের ক্ষরণ কম ঘটায় যদি না স্থানীয় আইনে কাজ করতে পারা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠেÑ যেমন হলো ব্রিটেনের আশ্রয় সন্ধানীরা। বিপুলসংখ্যক বিদেশী শ্রমিকের আগমনের কারণে একই দক্ষতাসম্পন্ন স্থানীয় শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা কমে যেতে পারে। তবে বেশিরভাগ অভিবাসীর বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা থাকে। বিদেশী ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষতার ঘাটতি লাঘব করে দেয়। অদক্ষ অভিবাসীরা শিশু বা বয়স্ক পরিচর্যার কাজ করে। এর ফলে স্থানীয় শ্রমিকরা এ ধরনের কাজের গ-ি থেকে মুক্ত হয়ে আরও আকর্ষণীয় কাজ করতে পারে। উন্মুক্ত সীমান্ত কি জনাধিক্য সৃষ্টি করতে পারে? এর জবাব হলো লন্ডনের মতো জনপ্রিয় নগরীগুলোতে করতে পারে। তবে পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ নগরী উর্ধমুখে বিস্তৃত হওয়ায় সেগুলো অধিক মানুষের বসবাসের জন্য অধিকতর জায়গা তৈরি করতে পারে। ব্যাপক হারে দেশান্তরের ফলে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে লোকের ভিড় কমে আসবে। কারণ, নতুন দেশে গিয়ে বসতি স্থাপনের পর অভিবাসীদের সন্তান জন্মহার নতুন দেশটির হারের কাছাকাছি না হওয়া পর্যন্ত ক্রমশ কমতেই থাকে। গণঅভিবাসনে ধনী দেশগুলোর রাজনীতি ও সংস্কৃতি বদলে যায়। আমেরিকাই তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ১৮০০ সালে সেখানকার লোকসংখ্যা ছিল ৫০ লাখ যার অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ। আজ তা ৩২ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে যার মধ্যে বহু বর্ণের মানুষ আছে। তবে তা থেকে এই প্রমাণ হয় না যে ভবিষ্যতে অভিবাসীর ঢল নামলে তার প্রভাব হবে নির্দোষ। এর উল্টোটাও হতে পারে। অনুদার দেশ থেকে আগত লোকেরা অনাকাক্সিক্ষত রীতিনীতি, অভ্যাস ও চর্চাও নিয়ে আসতে পারে। যেমন রাজনৈতিক দুর্নীতি ও অসহিষ্ণুতা। অভিবাসীর প্রবাহ গ্রহণ করে নেয়ার মতো সঠিক নীতি উদ্ভাবন না করে সীমান্ত সহসা উন্মুক্ত করে দেয়া হলে কিছু কিছু ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। তবে এসব ঝুঁকির প্রায় সবই দূর করা যায়। শুধু প্রয়োজন একটু সৃজনশীল চিন্তার। এর জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে তার অনেকই হয়ত দারুণ বৈষম্যমূলক শোনাবে। তথাপি এর প্রয়োজনও আছে। সীমান্ত উন্মুক্ত থাকলে বিদেশীরা কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বেশি ধনী হবে। কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বেশি সম্পদ সৃষ্টি হওয়ার মানে সেই সম্পদ সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষেরও উপকৃত হওয়ার সুযোগ থাকে। সেই সুযোগ এত বিশাল যে সংশ্লিষ্ট সকল দেশের উচিত তার সদ্ব্যবহার করা। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×