ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যন্ত গ্রামে নাগরিক আবহ, ঘরে ঘরে আকাশ সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৯ জুলাই ২০১৭

প্রত্যন্ত গ্রামে নাগরিক আবহ, ঘরে ঘরে আকাশ সংস্কৃতি

বাবুল হোসেন গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনসহ বিদ্যুত সংযোগের ফলে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে এখন বিরাজ করছে শহরের আবহ। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পিচঢালা সড়কজুড়ে চোখে পড়বে সবুজ বৃক্ষরাজির সমারোহ। নগর জীবনের সুবিধার উন্নত মানের আধুনিক ভবনসহ আকাশ সংস্কৃতির সুবিধা মিলছে গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে। গত এক দশকে গ্রামীণ জনপদের এমন উন্নয়ন নিয়ে খুশি ময়মনসিংহের গ্রামগঞ্জের নানা শ্রেণী পেশার সাধারণ মানুষ। সুবিধাভোগীদের দাবি, স্থানীয় সরকার বিভাগ এলজিইডিসহ সরকারের নানা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকা- বদলে দিয়েছে গ্রাম বাংলার চিরচেনা দৃশ্যপট। এলজিইডির স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, ময়মনসিংহের লাখ লাখ জনগোষ্ঠী যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের এই সুবিধা ভোগ করছে এখন। এলজিইডি, ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির প্রকল্প ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নামে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-২-সহ দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও জাইকাসহ সরকারের অর্থায়নে সেকেন্ড রুরাল ট্রান্সপোর্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (আরটিআপি-২) ও নরদার্ন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইন্টিগ্রেটেড প্রজেক্ট-নবিদেপ প্রকল্পের চলমান উন্নয়ন কাজ শেষ হলে ময়মনসিংহের গ্রামীণ জনপদের চিরচেনা চেহারা পুরোপুরি পাল্টে যাবে। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা ত্রিশাল। এই উপজেলার বৈলর থেকে কালিরবাজার পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়ক পাকা করার ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়কের বৈলর থেকে এই সড়ক ধরে ত্রিশালের কালিরবাজার যাতায়াত অনেকটা সহজ হয়েছে। একই সঙ্গে ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল ও গফরগাঁওয়ের মধ্যে সড়ক যোগাযোগে এই ৬ কিলোমিটার সড়ক বাইপাস হিসেবেও কাজ করছে। অথচ এর আগে সড়কটির বেহাল দশার কারণে বৈলর, কালিরবাজার ও বালিপাড়া এলাকার মানুষকে ময়মনসিংহ সদর হয়ে ঘুরপথে যাতায়াত করতে হতো। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের ব্রহ্মপুত্র পারের প্রত্যন্ত জনপদ বোররচর। বর্ষাকালে নৌকায় আর শুকনো মৌসুমে বোররচর এলাকার কয়েক লাখ মানুষকে ফুলপুর কিংবা শম্ভুগঞ্জের ঘুরপথে যাতায়াত করতে হতো ময়মনসিংহ জেলা সদরে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণায় শম্ভুগঞ্জ বাজার হয়ে বোররচরের এই ৩০ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের ফলে পাল্টে গেছে ব্রহ্মপুত্র তীরঘেঁষা দুর্গম বোররচরের চেহারা। এলজিইডির এই সড়কটির উন্নয়নের ফলে বোররচর ছাড়াও পাশের পরানগঞ্জ, সিরতাসহ ফুলপুর উপজেলার রহিমগঞ্জ, রামভদ্রপুর এলাকার মানুষ সহজপথে কম সময়ে ময়মনসিংহ জেলা সদরে যাতায়াত করতে পারছে। বোররচরের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এখন সরাসরি যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। তারাকান্দা গ্রোথ সেন্টার থেকে শ্যামগঞ্জ এবং পরানগঞ্জ থেকে রামভদ্রপুর সড়ক উন্নয়নের কারণে ঘুরপথের যাতায়াত সহজ হয়েছে। একই রকম উন্নয়ন চোখে পড়বে ময়মনসিংহের গফরগাঁও, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, হালুয়াঘাট, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা উপজেলার গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে। এসব এলাকায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচা সড়কের জায়গায় এখন পাকা সড়ক হয়েছে। পিচঢালা এসব গ্রামীণ সড়কের দু’পাশজুড়ে শোভা পাচ্ছে সারি সারি বৃক্ষরাজির সবুজ সমারোহ। এলজিইডির স্থানীয় সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির সাতটি প্রকল্পের আওতায় গফরগাঁও ও ময়মনসিংহ সদরে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষ পথে। দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের দেয়া ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে আরটিআইপি-২ প্রকল্পের আওতায় গত ২০১৪ সালে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদী ৫৮ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের প্রকল্পটি আগামী ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে সড়কের ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার দেয়া ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নরদার্ন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইন্টিগ্রেটেড প্রজেক্ট-নবিদেপ প্রকল্পের ৮০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের ৫৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত ২০১৪ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ আগামী ২০১৯ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নামে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-২-এর আওতায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজের ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ শেষ হওয়ার কথা জানায় এলজিইডির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। এলজিইডি সূত্র আরও জানায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা সমাধানে জেলায় ৭০টি আবাসন পল্লী, ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ও আদিবাসীসহ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য হালুয়াঘাটে জয়িতা মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। ত্রিশালের বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ এলাকাবাসীর মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। ময়মনসিংহ সদরের বোররচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জানান, প্রত্যন্ত জনপদে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণের ফলে সরকারের মাঠ পর্যায়ের কৃষি, প্রাণী, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা বসার জায়গা পেয়েছে এবং এসব সংস্থার সেবা কার্যক্রম সহজ হয়েছে। এসবের বাইরে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের আরও একটি মেগা প্রকল্প আগামী একনেক সভায় উঠার কথা রয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের জন্য এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গ্রামীণ জনপদের চেহারার আমূল পরিবর্তন হবে বলে দাবি করছেন এলজিইডির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। গত এক দশকে এলজিইডি ছাড়াও ময়মনসিংহ সড়ক বিভাগ (সওজ), ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ময়মনসিংহের গ্রামীণ জনপদের যোগাযোগ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন কর্মকা-ে ভূমিকা রেখেছে। এর সুফল পাচ্ছে এখন প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিতে। গ্রামীণ যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের বাইরে ময়মনিসংহের প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুত সংযোগ ও ডিস এন্টেনার কল্যাণে ঘরে ঘরে মিলছে আকাশ সংস্কৃতির সুবিধাও।
×