ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৯ জুলাই ২০১৭

চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন

নিজস্ব সংবাদদাতা, পিরোজপুর, ২৮ জুলাই ॥ মুক্তিযুদ্ধে ৯নং সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার সাক্ষী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব) জিয়াউদ্দিন আহমেদ আর নেই। শুক্রবার দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ জুলাই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। এর আগে তিনি দুই সপ্তাহ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দুটি কিডনি অকেজো ছাড়াও তিনি লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। এ অবস্থায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন আইসিইউতে নিয়ে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত আড়াইটার দিকে মেজর জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং দুপুরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে পিরোজপুরে শোকের ছায়া নেমে আসে। শহরের পাড়েরহাট রোডস্থ বাসভবনে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা ভিড় জমায় এবং অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানগণ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আফতাব উদ্দিন কলেজে কালো পতাকা উত্তোলনসহ ৩ দিনের শোক পালনের কর্মসূচীর ঘোষণা করেছেন। তার পূর্বপুরুষের বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভা-ারিয়ায়। আইনজীবী পিতা আফতাব উদ্দিন আহমেদের ছেলে জিয়া উদ্দিন ১৯৫০ সালে পিরোজপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার আপন চাচাত ভাই। পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে তিনি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ’৭১ সালের ২০ মার্চ সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট হিসেবে ছুটিতে বাড়ি আসেন এবং ২৭ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে তিনি পিরোজপুর শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং সুন্দরবনে ঘাঁটি স্থাপন করে ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। এ সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীনে সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে সুন্দরবনেই সদর দপ্তর স্থাপন করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমে ক্যাপ্টেন ও পরে মেজর পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালে ৩ নবেম্বর ও ৭ নবেম্বর পর পর দুটি সেনা অভ্যুত্থানকালে মেজর জিয়া সরকারী কাজে পিরোজপুর শহরে মুক্তিবাহিনী সদস্যদের পুলিশে ভর্তি জন্য পিরোজপুরে ছিলেন। পরে ঢাকায় ফিরে কর্নেল তাহেরের নির্দেশে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ঘোষণা করে ’৭১ সালের মতো ঘাঁটি স্থাপন করেন। ’৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া মাঝের চরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে কর্নেল তাহেরসহ মেজর জিয়া এবং জাসদ নেতৃবৃন্দের বিচার হয়। এ বিচারে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি এবং মেজর জিয়াকে যাবজ্জীবনসহ অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। ৮০ সালে তিনি সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান এবং জাসদে যোগ দেন। ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি সুন্দরবনে দুবলার চরে মাছের ব্যবসা শুরু করেন এবং জেলেদের আর্থিক নিরাপত্তা, জলদস্যু দমন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৮৯ সালে পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কিছু স্মৃতি গ্রন্থ রয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের সেই উম্মাতাল দিনগুলো’ ও ‘সুন্দরবন সমরে ও সুসময়’ যার মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ শুক্রবার এক শোক বার্তায়, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় মেজর জিয়াউদ্দিনের অমূল্য অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তার মৃত্যুতে দেশ একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছে।’ শেখ হাসিনা তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এরশাদ ॥ মেজর (অব) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। শুক্রবার এক শোকবার্তায় তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে এই মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা ছিল অনন্য। আমরা একজন মহান মুক্তিযোদ্ধাকে হারালাম।
×