ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশে রোগীর সংখ্যা ১২ লাখ

ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৯ জুলাই ২০১৭

ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা

নিখিল মানখিন ॥ দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল। চিকিৎসা করাতে না পেরে এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর অস্বাভাবিক হারে খোদ চিকিৎসকরাও চিন্তিত। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিক্যাল উপকরণ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর বছরে মারা যায় প্রায় দেড় লাখ রোগী। সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ের বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে বছরে ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসা গেলেও আড়ালে থেকে যায় আরও প্রায় আড়াই লাখ রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, জনসংখ্যা অনুপাতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সুবিধাসংবলিত ১৫০টি ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা আছে মাত্র ১৮টি। আমাদের ৩০০টি লিনাক মেশিনের প্রয়োজন। আছে মাত্র ১৪টি আবার এর সবই কার্যকর নয়, বেশির ভাগই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ক্যান্সার শনাক্তকরণে ভুল তথ্য দিয়ে থেরাপি ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্যান্সার একটি সমন্বিত চিকিৎসা। সার্জারি, কেমো ও রেডিওথেরাপি কখন, কোনটি, কীভাবে করতে হবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপারেশনের ছয় মাস পর কেমো নিলে ফলপ্রসূ হবে না। শুধু ভাল চিকিৎসক থাকলেই হবে না; এর সঙ্গে প্যারামেডিক, নার্স ও অন্যান্য সহযোগী মানবসম্পদ থাকতে হবে। কোন ওষুধ ৮ ডিগ্রী, কোনটি ২৫ ডিগ্রী সে?লসিয়াস তাপমাত্রায়, আবার কখনও সূর্যের আলোর বাইরে রাখতে হয়। এ জন্য ভাল ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন হয়। যারা ওষুধ লিখবেন, তাদের দক্ষতা থাকতে হয়। ওষুধ প্রয়োগের আগে প্রস্তুত করতে হয়। ওষুধ প্রস্তুত, কেমো ও রেডিওথেরাপি দেয়ার কাজগুলো অনকোলজিস্টরা করেন। দেশে অনকোলজিস্টদের স্বল্পতা রয়েছে। অনকো?লজিস্ট বাড়াতে হবে। দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা যা বলা হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতি ১০০ রোগীর জন্য একজন করে অনকোলজিস্ট থাকা দরকার। দেশে বর্তমানে ১ হাজার ২০০ ক্যান্সার রোগীর জন্য একজন অনকোলজিস্ট। ভারতে ৬৬৪ ও পাকিস্তানে ১ হাজার ৪০০ জনের জন্য একজন অনকোলজিস্ট। অধিকাংশ রোগীই আসে যখন বেশি মাত্রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাদের জন্য প্রয়োজন কেমোথেরাপি ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার। প্রায় সব ক্যান্সার হাসপাতালেই এ সেবার ব্যবস্থা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালে অনকোলজির কাজ হয়। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেডিক্যাল অনকোলজি বিভাগ খোলা হয়েছে। তবে নতুন যেসব মেডিক্যাল কলেজ হবে, পুরনো যেসব মেডিক্যাল কলেজ আছে, সেসব জায়গায় অনকোলজি বিভাগ খোলা প্রয়োজন। বাজারে নামে-বেনামে কিছু বাজে ওষুধ আছে, এগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য একটা পরিকল্পনা করে তা কার্যকর করা প্রয়োজন। সরেজমিন এক বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন ফেনীর মোঃ আসিফ (৩৭)। ক্যান্সার ধরা পরার পর ঢাকার একটি সরকারী হাসপাতালে এক বছর ধরেই তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। আসিফের সঙ্গে হাসপাতালে আসা তার একজন আত্মীয় বলছিলেন, প্রথমে তারা ভারতে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও চিকিৎসার খরচের কথা চিন্তা করে দেশের সরকারী হাসপাতালেই চিকিৎসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। মোঃ আসিফ জনকণ্ঠকে জানান, কুমিল্লা থেকে ঢাকা এসেছি। এখানকার ডাক্তাররা বলল, বাংলাদেশে চিকিৎসা আছে। তাই খরচের কথা ভেবে ভারতে যাইনি। কিন্তু এখানেও অনেক খরচ। এই রোগের চিকিৎসার একটি অংশ কেমোথেরাপি, যেটা আসিফকে দেয়া হয়েছে ১২টি। আর প্রতিবারেই এ বাবদ তাদের গুনতে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। তার এক আত্মীয় বলছিলেন জমি, গবাদি পশু বেঁচে ও অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে চলছে তার চিকিৎসা। মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালের তেমনি একটি বিভাগে কেমোথেরাপি নিতে কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন কাশেম মিয়া (৪৬)। তার সঙ্গে রয়েছে ছেলে বেলাল হোসেন (১৯)। সে জনকণ্ঠকে জানায়, ডাক্তার ১০টি কোমেথেরাপি নেয়ার কথা বললেও আপাতত ৬টার বেশির খরচ বহন করা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব না। শেফালী আক্তার, শেরপুর জেলা সদরের নয়াপাড়া লসমানপুর গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মেয়ে। বয়স মাত্র ৫ বছর। সে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার পেছনে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন শিশুটির পিতা মোঃ সাইফুল এক কথা জানায়। শেফালী সুস্থ হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েও চিকিৎসকদের এমন কথা বাড়িয়ে দিয়েছে শিশুটির মাতা-পিতার কষ্টের মাত্রা। সোয়া দু’ বছরের শিশু আরিয়ান রাসিফ। সে দুরারোগ্য ব্যাধি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সে। এ বয়সে গুঁটি গুঁটি পায়ে হেসে-খেলে বেড়ানোর কথা তার। কিন্তু জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সে। বর্তমানে সে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। উন্নত চিকিৎসা দেয়া হলে শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এজন্য প্রয়োজন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু স্বল্প বেতনের চাকরি করা বাবা মোঃ রাশেদ আলীর পক্ষে আরিয়ানের এ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসার পেছনে ইতোমধ্যে পরিবারটির সহায় সম্বল ফুরিয়ে গেছে। বর্তমানে টাকার অভাবে চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিশুটির পিতা মোঃ রাশেদ আলী। এভাবে ব্যয়বহুল, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিক্যাল উপকরণের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। চিকিৎসা করাতে না পেরে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অনেক রোগী। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান জাফর মোঃ মাসুদ জানান, হাসপাতালের খরচ ছাড়া ওষুধের দাম সবখানেই এক। তিনি মনে করেন এই বিশাল খরচ কমাতে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা দরকার। হয়ত সরকারী হাসপাতালে, হাসপাতাল খরচটা ফ্রিতে পাওয়া যায়, কিন্তু ওষুধের দাম একই। এক্ষেত্রে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে বিশ্বের সব জায়গায় যাদের অর্থ আছে তারা সরকারের সঙ্গে সাহায্য করে। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোয়াররফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, দেশের জনসংখ্যা বাড়ার হারের সঙ্গে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বাড়ছে, তা সামাল দেয়া অনেকটাই কঠিন। এ ক্ষেত্রে সবার আগে সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার, যাতে করে ক্যান্সারে আক্রান্ত না হতে হয়। এ জন্য তামাক সেবন থেকে শুরু করে যেসব কারণে ক্যান্সার হয় সেগুলো পরিহার করা জরুরী। রোগীদের বিদেশে পাড়ি ও চিকিৎসা খরচ দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা ও চিকিৎসকের ওপর আস্থাহীনতার কারণে প্রতিবছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। এ ধারণা সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ ভারতসহ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন এমনকি জাপানেও যাচ্ছেন। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, দেশে ক্যান্সার রোগীর রেজিস্ট্রেশন না থাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা যাবে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দেশে বর্তমানে মোট ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ হাজার রোগী দেশের বাইরে যায় চিকিৎসা করাতে। সে হিসাবে রোগীপ্রতি গড়ে ২ লাখ টাকা করে খরচ হলেও বছর শেষে সেই অংক দাঁড়ায় ৪০০ কোটিতে। তবে সবারই সমান টাকা এবং সমান সময় ব্যয় হয় না। চিকিৎসা ভিসা ছাড়া পর্যটন ভিসাসহ অন্য ভিসাতে দেশের বাইরে অনেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন বলেও জানান ডাঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার। তিনি বলেন, চিকিৎসা ভিসা নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া রোগীর সংখ্যা দিয়ে মোট চিকিৎসাপ্রার্থীর সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। জানা গেছে, একই ক্যান্সার চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রে খরচ পড়ে ৫০ লাখ, সিঙ্গাপুরে ১০ লাখ, থাইল্যান্ডে ৭ লাখ, মালয়েশিয়ায় ৬ লাখ এবং ভারতের দক্ষিণে অর্থাৎ মাদ্রাজ, বেঙ্গালুরু, ভ্যালুর ও চেন্নাইতে খরচ পড়ে মাত্র আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। সবখানেই চিকিৎসার মান একই। তবে রোগীর ধরন এবং রোগের ধাপ (স্টেজ) অনুযায়ী খরচের তারতম্য হয়। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ আরও ১৯টি দেশে রোগীরা চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছেন ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর। দেশে চিকিৎসা সুবিধা সরকারী পর্যায়ে একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, একটি ইন্সটিটিউটসহ মাত্র ৯ মেডিক্যাল কলেজে বর্তমানে অনকোলজি বিভাগ চালু রয়েছে। সরকারী হাসপাতালগুলো দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত রোগীদের সেবা দেয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব সেবা প্রদানকে দুরূহ করে তুলছে। অধিকাংশ রোগী তাদের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারী সেবার পাশাপাশি কিছু প্রাইভেট হাসপাতালও ক্যান্সার সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ডেলটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু করে ৩৫০ শয্যার এই হাসপাতালটি দুটি লিনিয়ার এক্সিলেটর, দুটি কোবাল্ট-৬০ এবং দুটি ব্রাকিথেরাপি এর মাধ্যমে ক্যান্সার সেবা দিয়ে আসছে। এছাড়াও স্কয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল উন্নত ক্যান্সার সেবা দিয়ে আসছে। কিছু বেসরকারী সংস্থা ক্যান্সার সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন আহসানিয়া মিশন, ক্যান্সার সোসাইটি, আশিক ফাউন্ডেশন, দিগন্ত মেমোরিয়াল, মোসাব্বির ক্যান্সার সেন্টার তাদের নিজ নিজ উদ্যোগের মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসা ও সচেতনতায় অবদান রাখছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটমিক এনার্জি (আইএইএ) বাংলাদেশের জনশক্তিকে রেডিয়েশন থেরাপিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের সামনে বিস্তর বাধা রয়েছে- চিকিৎসার উচ্চ খরচ, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা, প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব এবং সচেতনতার অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আমাদের ক্যান্সার সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
×