ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পানামা পেপার্স মামলায় পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের সর্বসম্মত রায়

প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা ॥ নওয়াজের পদত্যাগ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৯ জুলাই ২০১৭

প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা ॥ নওয়াজের পদত্যাগ

হাফিজুর রহমান বিপ্লব ॥ আলোচিত পানামা পেপার্স মামলায় আদালতে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর পদত্যাগ করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ (৬৭)। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্তের পর সুপ্রীমকোর্টের পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ শুক্রবার দুপুর ১২টার পর সর্বসম্মত এক রায়ে নওয়াজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে। নওয়াজ বরাবরই দুর্নীতির এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসেছিলেন। তবে আদালতের আদেশের পরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক বিবৃতিতে তার পদত্যাগের কথা ঘোষণা করে। এদিকে, পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকেও দায়িত্বে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করেছে দেশটির সুপ্রীমকোর্ট। নওয়াজ পরিবারের সাবেক হিসাবরক্ষক ইসহাক ছিলেন দেশটির মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। আদালতের নির্দেশে তিনিই নওয়াজের পরিবারের সম্পদের তথ্য ও নথি আদালতে উপস্থাপন করেছিলেন। আদালতের দেয়া এই রায়ে নওয়াজের জামাতা মুহাম্মদ সফদারকেও জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। খবর ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার। এই রায়ের ফলে তৃতীয় মেয়াদেও পুরো সময় ক্ষমতায় থাকা হলো না পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) নেতা নওয়াজ শরীফের। প্রায় এক বছর বাকি থাকতেই তাকে দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সরে যেতে হলো। এ অবস্থায় ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সরকার চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে নওয়াজের ভাই পাঞ্জাব প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের নাম জোরালোভাবে আলোচনায় রয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা গেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এখন স্পীকারের অনুমতি নিয়ে নতুন একজনকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করতে পারবে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তিনিই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন। নওয়াজ শরীফের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। তার আগের ১৭ প্রধানমন্ত্রীর কেউই তাদের পুরো মেয়াদ কখনও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। পাকিস্তানের অনেকেই মনে করছেন, নওয়াজ শরিফকে দিয়েই দুর্নীতির চক্র ভাঙ্গার কাজ শুরু করল দেশটির উচ্চ আদালত। কারও কারও ধারণা, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে প্রক্রিয়ায় যুগের পর যুগ বেসামরিক প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, এটা তারই একটি অংশ। দুর্নীতির চক্র ভাঙ্গার বদলে এই রায় আসলে একদল নতুন লোকের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের পথ খুলল, যেমনটা অতীতেও হয়েছে। এই রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় আদালত এলাকাসহ পুরো রাজধানীতে হাজার হাজার সেনা ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিচারক যখন রায় ঘোষণা করেন, তখন আদালত কক্ষে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। বিচারপতি এজাজ আফজাল খান রায়ে বলেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য প্রমাণ থেকে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, একজন সৎ পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নওয়াজ শরীফের আর নেই। এ্যাটর্নি জেনারেল আসতার আওসাফ জানান, নওয়াজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী পদে আজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি ভবিষ্যতে কোন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এদিকে, নওয়াজ শরীফ, তার মেয়ে মরিয়ম, জামাতা সফদার ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নিয়মিত মামলা দায়ের করতে বলা হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের এই রায়ে। গত বছর ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সে নওয়াজ শরীফের মেয়ে মরিয়ম ও ছেলে হাসান-হুসেনের নাম আসে। তারা তিনজন ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির নামে লন্ডনে সম্পত্তি কিনেছেন বলে সেখানে তথ্য পাওয়া যায়, যার উল্লেখ তাদের ঘোষিত সম্পদ বিবরণীতে ছিল না। পানামা পেপার্স আলোড়ন তোলার পর বিরোধী দলগুলো নওয়াজ পরিবারের সম্পত্তির হিসাব ও দুর্নীতির তদন্ত করতে সুপ্রীমকোর্টের কাছে দাবি জানায়। গত জুনে পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্ট জানায়, পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অপসারণ করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি। তবে নওয়াজ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সে সময় একটি যৌথ দল গঠনের নির্দেশ দেয় আদালত। সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সদস্যদের নিয়ে গঠিত ছয় সদস্যের এ তদন্ত দলকে নওয়াজ পরিবারের তিন পুরুষের সম্পত্তির হিসাব নিতে বলা হয়; একইসঙ্গে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। নওয়াজ শরীফ ও তার সন্তানরা শুরু থেকেই তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পরিবারের সব সম্পত্তিই বৈধ উপায়ে কেনা বলেও দাবি তাদের। যৌথ তদন্ত দলের (জেআইটি) জিজ্ঞাসাবাদেও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও তার সন্তানরা একই কথা বলেন। নওয়াজের বাবা ছিলেন দেশটির একজন খ্যাতিমান শিল্পপতি। তাকে ঘিরেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর পানামা পেপার্সে যেসব সম্পদের তথ্য এসেছে, সেসব নিয়ে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েই পাকিস্তানে তদন্ত শুরু হয়েছিল। এর আগে ১৯৯০ ও ১৯৯৭ সালে দুই বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় কোনবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি নওয়াজ। দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি দেশান্তরিত হয়েছিলেন। তখন বেশিরভাগ সময় তিনি থাকতেন সৌদি আরবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। গত বছর পানামাভিত্তিক আইনী সেবাপ্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি প্রকাশ করে। এতে বিশ্বের বহু ক্ষমতাধর, ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ সামনে আসে; যা বিশ্বে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি নামে পরিচিতি পায়। এরই নথিতে নওয়াজ ও তার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজনের নাম আসে। এর আগে আইসল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও পদত্যাগের বাধ্য হয়েছিলেন পানামা পেপার্সে নাম আসায়। এদিকে, ‘সবচেয়ে সম্ভাব্য প্রার্থী’ হিসেবে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের নাম সামনে চলে এসেছে। তবে খাজা আসিফের ৪৫ দিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ ‘মূল সম্ভাব্য প্রার্থী’ আসলে নওয়াজের স্ত্রী কুলসুম নওয়াজ ও ছোট ভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। তবে দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আগে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতে হয়। তাই কুলসুম বা শাহবাজ উপনির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন খাজা আসিফ। পিএমএল-এন কয়েকজন নেতা জানান, নওয়াজের স্থলাভিষিক্ত কে হতে পারেন, তা নিয়ে গত শনিবার পিএমএল-এনের বৈঠক হয়েছে। সেই আলোচনাতেই অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সংক্ষিপ্ত তালিকায় খাজা আসিফের পাশাপাশি নাম আসে জাতীয় পরিষদের স্পীকার সরদার আয়াজ সাদিক ও দলের নেতা শাহিদ খাকান আব্বাসীর। আওয়ামী মুসলিম লীগের (এএমএল) প্রধান শেখ রশিদ বলেছেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত করা হতে পারে। শেখ রশিদের এএমএল বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের অংশীদার। শনিবারের বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। আসিফকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হলে পিএমএল-এনের দ্বন্দ্ব হওয়ার আশঙ্কা আছে জানিয়ে শেখ রশিদ জানান, মনে হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার নওয়াজের সুনজরে নেই। নওয়াজের সুনজরে থাকা একজন হলেন স্পীকার সরদার আয়াজ সাদিক। শরিফ পরিবার তাকে সমর্থন করেন। এর আগে নওয়াজের পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে সোমবার একটি প্রতিবেদন সুপ্রীমকোর্টে দাখিল করে যৌথ তদন্ত দল। প্রতিবেদন গ্রহণ করে তিন বিচারকের গঠিত একটি বেঞ্চ। পরে পাকিস্তান সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান জাফর হিজাজির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চালুর নির্দেশ দেন বেঞ্চ। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফআইএ) নথিপত্র নষ্টের অভিযোগ উঠেছে হিজাজির বিরুদ্ধে। বিচারপতি শেখ আজমত সাঈদ, বিচারপতি ইজাজুল আহসান ও বিচারপতি এজাজ আফজালের সমন্বয়ে গঠিত ওই বেঞ্চ জেআইটির প্রতিবেদন পরীক্ষার পর নওয়াজ পরিবারের ব্যবসায়িক নথি নষ্ট করার পেছনে কে দায়ী, তা খুঁজে বের করতেই জাফর হিজাজির বিরুদ্ধে ওই মামলা করার নির্দেশ দেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন শাহবাজ এদিকে জিও নিউজ জানায় ভাই শাহবাজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অনুমোদন দিয়েছেন নওয়াজ। ক্ষমতাসীন পাক মুসলিম লীগের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য শাহবাজের নাম উঠলে তাতে সায় দেন নওয়াজ। শাহবাজ বর্তমানে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
×