ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাদ্রাসাছাত্রী নিজেই নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দিল

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৮ জুলাই ২০১৭

মাদ্রাসাছাত্রী নিজেই নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দিল

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ নিজেই নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে লিমু আক্তার (১৫)। লিমু নীলফামারী সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের বাহালীপাড়া চৌধুরীবাজার দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী। তার রোল নম্বর ৮। গত ১৪ দিন গৃহবন্দী থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে মাদ্রাসায় এসে মেয়েটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ঘটনার কথা শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছে তুলে ধরে। এমন খবর পেয়ে সংবাদকর্মীরা ছুটে যায় ওই মাদ্রাসায়। লিমু আক্তার পূর্ব খামাতপাড়া টেপুয়ারডাঙ্গা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলামের মেয়ে। লিমু জানায়, সে এখন আত্মপ্রত্যয়ী। ডিগ্রী পাস করে নিজের কর্মসংস্থানের পর বিয়ে করবে। লিমুর বাল্যবিয়ে বন্ধ করার ঘটনা জানতে পেরে সহপাঠীরাও সোচ্চার হয়ে ওঠে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে লিমু দ্বিতীয়। সংসারে কোন অভাব-অনটন না থাকলেও গ্রামের লোকের খপ্পরে পড়ে লিমুর বাবা এক বেকার ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। বর পার্শ্ববর্তী কচুকাটা ইউনিয়নের দুহুলী ঘনপাড়া গ্রামের মোখছেদ আলীর ছেলে সেলিম মিয়া (২০)। বিয়েতে যৌতুক ঠিক হয় দুই লাখ টাকা। বরপক্ষকে কেনাকাটার জন্য এক লাখ টাকা দিলেও এর মধ্যে গ্রাম্য টাউটরা ৪১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেয়ে বড় হয়েছে- গ্রামের কিছু মানুষের কথা ধরে বাবা নজরুল ইসলাম ও মা লিপি আক্তার তাদের মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন গত ১৫ জুলাই। গত ১২ জুলাই হতে লিমুর দাখিল মাদ্রাসায় আসা বন্ধ করে দেন অভিভাবকরা। মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী লিমুর বিয়ের বিষয়টি গোপন থাকায় জানতে পারেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা। তাকে গৃহবন্দী করে রেখে প্রচার চালানো হয় সে নানির বাড়ি বেড়াতে গেছে। লিমু জানায়, তার বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সে গৃহবন্দী হয়ে যখন হা-হুতাশ করছিল তখন তার মনে পড়ে যায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তাদের ইউনিয়নকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাল্যবিয়ে ও যৌতুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত নীলফামারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেন খান তার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিলেন কোথাও বাল্যবিয়ে হলে তাকে জানাতে। এছাড়া শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে অবগত করতেন। এসব মনে হতেই লিমু তার বাবা-মাকে ডেকে জানায়, আমার বাল্যবিয়ে তোমরা বন্ধ না করলে পুলিশকে জানিয়ে তাদের সাজা দিতে বাধ্য হবে। তবুও সে বিয়ে করবে না। লিমুর এ কথায় কাজ হয়। বিয়ে বন্ধ করে দেন লিমুর বাবা-মা। এরপর লিমু পুনরায় নিজেকে তৈরি করে বৃহস্পতিবার তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে ঘটনার কথা শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছে খুলে বলে। লিমু এখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর। এ ঘটনায় বিষয়ে লিমুর বাবা-মা সাংবাদিকদের বলেন, এজন্য তারা অনুতপ্ত। তারা যে ভুল করতে যাচ্ছিল, এমন ভুল আর কেউ যেন না করেন। লিমুর ক্লাস শিক্ষক মাওলানা গোলাম মোস্তফা বলেন, আমি প্রতিনিয়ত ক্লাসে পড়ার পাশাপাশি বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবগত করি। লিমু তার বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, তা অন্য শিক্ষার্থীদের সহায়তা করবে। মাদ্রাসার সুপার আ ন ম হামিদুল ইসলাম বলেন, লিমু আক্তারের এ ঘটনা আমরা জানতে পেরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের প্রতিষ্ঠানের ৩২০ শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ডেকে বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে একটি অনুষ্ঠান করব। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২৯ মে নীলফামারী সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাল্যবিয়ে ও যৌতুকমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। এ ঘোষণার আগে স্থানীয় প্রশাসন প্রতিটি ইউনিয়নে পৃথক পৃথক সমাবেশ করে ইউনিয়নগুলোকে বাল্যবিয়ে ও যৌতুকমুক্ত ঘোষণা করেছিল।
×