ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবারও পূর্বাচল থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার

বিশাল অস্ত্রের চালান মজুদের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ জুলাই ২০১৭

বিশাল অস্ত্রের চালান মজুদের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর পূর্বাচলে সাতদিন লেকের পানি সেচে অস্ত্র, গ্রেনেড, গোলাবারুদ উদ্ধারাভিযান সমাপ্ত ঘোষণার পর আবারও একই স্থান থেকে উদ্ধার করা হলো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান। একই চক্র রাজধানীর উত্তরা, পূর্বাচলে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকার অস্ত্রের চালান মজুদ করেছে বলে পুলিশের দাবি। গত বছর রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির খাল থেকে অস্ত্রের চালান উদ্ধারের পর চলতি বছর পূর্বাচলের উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক অস্ত্রের চালান। কিন্তু এই চক্রটি কে বা কারা? কি উদ্দেশ্যে তারা এত বড় বিশাল অস্ত্রের চালান মজুদ করেছে তা এখনও রহস্যাবৃত। বুধবার রাজধানীর পূর্বাচল উপশহরের পাঁচ নম্বর সেক্টর ক্যানেল (লেক) এলাকার ৪০০ গজ পূর্ব থেকে আবারও হ্যান্ড গ্রেনেড, গুলি ও দূরবীন উদ্ধার করেছে রূপগঞ্জ থানার পুলিশ। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাজধানীর পূর্বাচল উপশহরের (নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের) ৫ নম্বর সেক্টরের লেকে তল্লাশি চালিয়ে এসএমজির আরও ২০০ গুলি, শটগানের ৪০টি কার্তুজ ও ১২টি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে গত ২ জুন পূর্বাচল উপশহরের ৫ নম্বর সেক্টরের লেক থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এরপর প্রায় সাতদিন লেকের পানি সেচে তল্লাশি চালানো হয়। লেকের পানিতে আর কোন অস্ত্র না পাওয়ায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। গত সোমবার খায়রুল নামের এক ব্যক্তি লেকের পাড়ের ঝোপে গিয়ে পলিথিনে মোড়ানো অস্ত্র দেখে পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ গিয়ে ঝোপের ভেতর থেকে মাটি খুঁড়ে ছয়টি এসএমজি উদ্ধার করে। আরও অস্ত্র গোলাবারুদ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে ঝোপ পরিষ্কার করে তল্লাশি চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বুধবার দুপুরে ঝোপ পরিষ্কার করে এসএমজি উদ্ধারের স্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতরে এসএমজির ২০০ গুলি, শটগানের ৪০টি কার্তুজ এবং ১২টি হ্যান্ড গ্রেনেড পাওয়া যায়। পুলিশ সূত্র জানান, গত ২ জুন এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারের পর তার দেয়া তথ্যানুযায়ী রাজধানীর পূর্বাচল উপশহরে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পূর্বাচলের ওই জলাধারে অভিযান চালিয়ে ৬১টি চায়নিজ এসএমজি, ২টি রকেট লঞ্চার, ২টি ওয়াকিটকি, ৭.৬২ বোরের ৫টি পিস্তল, ৫টি পিস্তলের ম্যাগজিন, ৪৯টি রকেট লঞ্চার প্রজেক্টর, ৪২টি হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএমজির ম্যাগজিন ৪৪টি, বিপুলসংখ্যক টাইমফিউজ, ইগনাইটার, গুলি ও ব্যাজ উদ্ধার করা হয়। বুধবার একই এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গ্রেনেড ও গোলাবারুদ। এর আগে গত ৩০ মে রূপগঞ্জ থানার এএসআই শাহজাহান খান দাউদপুর ইউনিয়নের বাগলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে শরীফের বসতঘর থেকে একটি এসএমজি উদ্ধার করেন। ওই দিন রাতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে শরীফকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১ জুন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২ জুন ৩ নম্বর সেক্টরের ব্লুসিটি নামে একটি আবাসন কোম্পানির বালুর ভেতর থেকে দুটি এসএমজি, পূর্বাচলের ৫ নম্বর সেক্টরের লেকের পানি থেকে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় মোট ৭৪টি এসএমজি, দুটি রকেট লঞ্চার, ৫৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, তিনটি হাই ফ্রিকোয়েন্সি নন ট্রেকার ওয়াকিটকি, পাঁচটি পিস্তল, ৬০টি ম্যাগজিন, বিপুল পরিমাণ গুলি, ডেটোনেটর এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ওইদিন রাতেই উপজেলার ভোলাব ইউনিয়নের কুড়িয়াইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মুরাদ নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৩ জুন শীতলক্ষ্যা নদীর বাসুন্দা এলাকা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদের সহায়তায় পাঁচটি এসএমজি উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত বছরের জুনে উত্তরার দিয়াবাড়ী লেক থেকে তিন দফায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ২৫ কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত দুটি স্থানের পরিবেশগত মিল রয়েছে। দুটোই বিরানভূমি, বসতি স্থাপনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, এর আগে দিয়াবাড়ী থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রগুলোর সঙ্গে রূপগঞ্জ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রগুলোর মিল রয়েছে। সেখানে যেভাবে অস্ত্রগুলো রাখা হয়েছিল, এখানেও একইভাবে ব্যাগের মধ্যে অস্ত্রগুলো পাওয়া গেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রূপগঞ্জ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র সবই কারখানায় তৈরি। আশির দশকের পরে এসবের ব্যবহার ও উৎপাদন তেমন দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন কোন গোষ্ঠী বহু আগে দেশে এনে মজুদ করে রেখেছিল। আরও একটি বিষয় পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ পর্যন্ত যে ক’টি জঙ্গী অভিযান পরিচালিত হয়েছে, সেখানে জঙ্গীদের কাছ থেকে এ ধরনের অস্ত্র, গ্রেনেড বা গোলাবারুদ পাওয়া যায়নি। এক বছরের মাথায় ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের দুটি স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ছাড়াও দেশের কয়েকটি স্থান থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে, যা বিষয়টি উদ্বেগের হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশের কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যদের সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্যের পরিধি আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ কোথা থেকে এলো, কারা এর সঙ্গে জড়িত সেই রহস্য উদ্ঘাটন জরুরী। যারা এসব অস্ত্র এনেছে, লুকিয়ে রেখেছে, তাদের সম্পর্কে সব তথ্য ও রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। মারাত্মক কোন অপপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা এবং লুকিয়ে রাখা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এসব ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা জড়িত তা উদ্ঘাটন করা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরী। বর্তমানে অনেকটা জঙ্গী তৎপরতা, সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে আছে। দেশে বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে জঙ্গী গ্রেফতার, তাদের লাশ উদ্ধারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অস্ত্রের যোগানদাতা কারা, কোথা থেকে এসেছে, কারা এনেছে, জঙ্গী দমনে এসব রহস্য উদ্ঘাটন জরুরী। এক বছর আগে দিয়াবাড়ী খাল থেকে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছিল সেই ঘটনায় পুলিশ তিনটি জিডি করেছে। কিন্তু তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনাগুলো হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের সব ঘটনার দ্রুত তদন্ত শেষ করা না হলে দেশের জন্য তা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
×