ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৮ জুলাই ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) মহারাজ যশোবন্তের তাঁবু বিলাস মার্চ মাসে উজ্জয়িনী পৌঁছানোর পর মহারাজ যশোবন্ত সিং সিদ্ধান্ত নিলেন আর বেশিদূর যাবেন না। সেখানেই তাঁবু গেড়ে অপেক্ষা করবেন। সম্রাট শাহজাহানের বিশ্বস্ত অমাত্য ও বীর যোদ্ধা মারোয়াড় রাজা যশোবন্ত সিং। সকালে তাঁবু হতে বেরিয়েছেন এলাকাটি ঘুরে দেখতে। দূরের প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে ঘোড়ার পিঠে চিন্তিত চেহারায় বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। মারোয়াড়ি ঘোড়াটা সম্ভবত আরোহীর দুশ্চিন্তা বুঝতে পেরে লেজের ঝাঁপটা মেরে অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকল। ঘোড়াটির চওড়া কাঁধে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চাইলেন তিনি। নাকের পাটা ফুলিয়ে হাল্কা হ্রেষা ধ্বনি দিয়ে প্রাণীটি তার প্রভুর সঙ্কেত মেনে নিল। এই মারোয়াড়ি জাতের ঘোড়া নিয়ে রাজপুত যোদ্ধাদের অনেক গর্ব। মরুভূমিতে একটানা দৌড়াতে পারে এই ঘোড়া। কোন বিকট আওয়াজে ভয়ে লাফিয়ে ওঠে না। পারস্য থেকে আনা আরবী ঘোড়া ও মধ্য এশিয়ার তুর্কী ঘোড়ার মিলনে এই বিরল জাতের ঘোড়া উৎপাদন করা হয় যোধপুর অঞ্চলে। রাজপুতদের ঘাঁটি। আকবরের আমল হতে রাজপুত রাজারা মুঘলদের বিশেষ মিত্র। বলা ভাল মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি করে রাজপুতরা নিজেদের অঙ্গরাজ্য টিকিয়ে রেখেছেন। তবে ভেতর ভেতর তাদের রক্তে স্বাধীন সত্তার জোয়ার ঠিকই উথলে ওঠে। ইতোমধ্যে মারাঠি শিবাজি ছত্রপতি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। রাজপুত নেতাদের মধ্যেও কাজ করছে চাপা অস্বস্তি। রাজা যশোবন্ত সিং সারা জীবন মুঘলদের নিমক খেয়েছেন। সেই সব নিয়ে তাই আপাতত ভাবছেন না। খবর পেয়েছেন ছোট শাহজাদা মুরাদ গুজরাট হতে রওনা দিয়েছেন আগ্রার পথে। আরও শুনছেন যে কোন সময় আওরঙ্গবাদ থেকে আওরঙ্গজেব মুরাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। তবে কখন তারা এক হতে পারেন তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সম্রাট ও বড় শাহজাদা দ্বারা এই দুই অতৃপ্ত শাহজাদাকে আগ্রার দিকে এগুতে না দিয়ে সন্ধিচুক্তি করে যার যার সুবেদারিতে ফেরত পাঠাতে কাশিম খানের সঙ্গে যশোবন্ত সিংকে পাঠিয়েছেন। তা কি আদৌ সম্ভব? নিজ মনে ভাবতে থাকলেন তিনি। তারা অনুরোধ করলেই কি দুই শাহজাদা সুবোধ বালকের মতো ফেরত যাবেন? যদি ফিরে না যান তবে শক্তি প্রদর্শন অনিবার্য। কিন্তু সম্মানের বিচারে শাহজাদাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা কি উচিত হবে? সম্রাট শাহজাহান ইঙ্গিতে জানিয়েছেন তিনি রক্তপাত চান না। কিন্তু দারা চান যুদ্ধ। তবে এর বিকল্প কি? যশোবন্ত সিং মুঘলদের এই হেঁয়ালি বুঝতে অক্ষম। ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজে পেছন ফিরে তাকালেন যশোবন্ত সিং। দেখলেন তার অনুগত সেনাবাহিনীর প্রধান আসকর খান আরও দুজন দেহরক্ষী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। মহামান্য, এভাবে দেহরক্ষী ছাড়া কেন তঁাঁবু হতে বের হলেন আমাদের না জানিয়ে? হাঁপাতে থাকলেন আসকর খান। একটু নিরিবিলি কিছু জটিল বিষয় নিয়ে ভাবতে চাচ্ছিলাম। বাঁকানো গোঁফে হাত বুলিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তর দিলেন রাজা। আসলেই পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে মহারাজ। আসকরের স্পষ্ট উদ্বিগ্ন স্বরে নড়েচড়ে উঠলেন যশোবন্ত সিং। ঘোড়াটাও দুলে উঠল একই সঙ্গে। কোন নতুন সংবাদ? জি। শাহজাদা মুরাদের সঙ্গে আর দুটি অশ্বারোহী সেনা দল যোগ দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন তার সৈন্য সংখ্যা দশ হাজার। এটা আর এমন কি? আমাদের সঙ্গে তো এর দ্বিগুণ সৈন্য আছে। এখনও পুরো কথা শেষ করিনি জনাব। আবার কি? অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলেন যশোবন্ত। আমাদের গুপ্তচর বুরহানপুর হতে খবর এনেছে আওরঙ্গজেব মুরাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। তাই নাকি? আমি তো জানতাম তিনি আওরঙ্গবাদে বসে মাথার টুপি সেলাই করছেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন। আসকর খান সেই হাসিতে যোগ না দিলেন না। বিষয়টা সহজভাবে নেবেন না রাজা। আওরঙ্গজেবের ইশারা ছাড়া মুরাদ এত দূর আসার সাহস করতেন না। তা ঠিক বলেছ আসকর খান। আজ হোক কাল হোক দুই ভাই এক হবেন এটা আমি বুঝতে পারি। বয়স তো আর কম হলো না। আর যদি আওরঙ্গজেব আগ্রার পথে এগিয়ে আসতে থাকেন তবে এখনও কয়েক শ’ মাইল দূরে আছেন। সময় থাকতে এক্ষুণি দাক্ষিণাত্য পার হওয়ার মূল বাধা নর্মদা নদী পারাপারের ঘাটগুলোতে নজরদারি বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন জরুরী। নর্মদা পাড়ি দেয়ার আগেই আমরা তার সংবাদ পেতে চাই। আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, এই এলাকাটি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অনুকূল নয়। আমাদের উচিত হবে উঁচু কোন এলাকায় সৈন্য শিবির স্থানান্তর করা। খুঁজে পেয়েছ তেমন কিছু? না মহারাজ! তবে পেয়ে যাব আশা করি। যশোবন্ত সিং তাঁবুতে ফিরে গেলেন। প্রায় রাতে ফুরফুরে মেজাজে নিজ তাঁবুতে আসর বসান রাজা। আজ রাতেও বসিয়েছেন। আসকর খান ছাড়াও সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানালেন রাজা। আরেক সেনাপতি কাশেম খান শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে এলেন না। সামান্য সুরা পান করলেই রাজা যশোবন্ত সিং বাচাল হয়ে পড়েন। পূর্ব পুরুষদের সুখ্যাতি করা ছাড়া অন্য কিছু তার মাথায় ঢোকে না। সেই সঙ্গে রাজপুত যোদ্ধাদের নানা কীর্তির গল্প শোনাতে থাকেন তিনি। আজ রাতে তিনি শোনাচ্ছেন রাজপুত রমণীদের সাহস ও শক্তিমত্তার কাহিনী। মহারাষ্ট্রের তুলসী বাঈ কিংবা রানী দুর্গাবতী যদি আজ বেঁচে থাকতেন তবে হিন্দুস্তানের ইতিহাস অনেক বদলে যেত। সেই সঙ্গে শোনাচ্ছিলেন আরেক রাজপুত মহীয়সী মীরা বাঈয়ের জীবন কাহিনী। কিভাবে মীরা বাঈ এক রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে সংসার ছেড়ে আশ্রমে চলে গেলেন। আড্ডার মাঝখানে আসকর খানের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান দানেশ খান বলে উঠলেন, হুজুর অনুমতি দিলে একটি কথা বলব? বিলক্ষণ। অনুমতি নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তরল কণ্ঠে বললেন রাজা। এ জন্যই তো মির্জা কোকা সাহেব মুসলমানদের চার বিবির মধ্যে হিন্দু রাজপুত রমণী বিয়ে করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কি বলেছিলেন বাদশাহ নামদারের সৎ ভাই সভাসদ মির্জা আজিজ কোকা? লাল চোখে জানতে চাইলেন যশোবন্ত সিং। প্রসঙ্গ পরিবর্তনে অসন্তুষ্ট হলেও চেহারায় তা প্রকাশ করলেন না। কোকা বলেছিলেন, একজন মুসলমান পুরুষের চার ধরনের নারীকে বিয়ে করা দরকার। পারস্যের নারীÑ যে মধুর স্বরে কথা বলবে আর দিনরাত সঙ্গম করবে। খোরাশানের নারীÑ যে ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। হিন্দু নারীÑ যে স্বামীর সেবা ও সন্তানদের দেখাশোনায় ব্যস্ত থাকবে। আর মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান-তাজাকিস্তানের নারীÑ যাকে মাঝে মাঝে লাঠি পেটা করতে হবে যেন বাকি বিবিরা সতর্ক থাকেন। রাজপুত রমণীর এত বড় অপমান? কপট রাগ দেখালেন রাজা যশোবন্ত। পুরো তাঁবু অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। তপতী নদীর তীরে কেল্লা শহর বুরহানপুর হতে তিন দিকে রাস্তা চলে গিয়েছে। একটি রাস্তা গিয়েছে সুরাটে, একটি গিয়েছে বিজাপুরে ও তৃতীয়টি উত্তর ভারতে আগ্রা ও দিল্লীতে। যশোবন্ত সিংয়ের কেউ তখনও জানলেন না ৩০ মার্চ বুরহানপুর ত্যাগ করে দিনরাত না থেমে আওরঙ্গজেব বাহিনী চুপিসারে আগ্রার পথে আকবরপুর পৌঁছে গেছেন। এই জায়গায় নর্মদা নদীর গভীরতা অনেক কম ও শীর্ণকায়। নদীর পাড় শক্ত পাথুরে। সমূহ বিপদ হতে পারে জেনেও আওরঙ্গজেব আদেশ দিলেন গোলন্দাজ বাহিনীকে নদী পাড়ি দিতে। আকবরপুরের স্থানীয় গ্রামবাসীকে সহায়তায় নির্বিঘেœ পেরুলেন প্রথম প্রাকৃতিক বাধা। ১৩ এপ্রিল নর্মদা পেরিয়ে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য পেরিয়ে পা রাখলেন হিন্দুস্তানের উত্তর প্রান্তে। মহারাজ খবরটা যখন পেলেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পুরো বাহিনী নিয়ে যশোবন্ত সিং দৌড়ালেন উজ্জয়িনীর চৌদ্দ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে গম্ভীরা নদীর পাড়ে ধর্মাতপুর গ্রামে। অবস্থান নিলেন সেখানে। শত্রু সৈন্য ঠেকানোর আদর্শ জায়গা হতে পারে সেটি। সেই পথ ধরেই আওরঙ্গজেব বাহিনী এগিয়ে আসছে। গম্ভীরা কি চম্বল নদীর শাখা? আমতা আমতা করে ধানেশ জিজ্ঞাসা করলেন আশকর খানকে। ব্যক্তিগতভাবে নদীর পাড়ে বা খাড়ি এলাকায় সৈন্য সমাবেশ করার পক্ষপাতি নন গোলন্দাজ সেনাপতি ধানেশ। নদীর পাড় ঘেঁষে পিচ্ছিল কাদাময় ভাঙ্গাচোড়া নরম মাটির পথ বেয়ে মুঘল বাহিনীর ভারি কামানগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। (চলবে)
×