ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণ লেখকদের সাহিত্য ভাবনা ॥ কবিতার দুরারোগ্য ব্যাধি আমাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২৮ জুলাই ২০১৭

তরুণ লেখকদের সাহিত্য ভাবনা ॥ কবিতার দুরারোগ্য ব্যাধি আমাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে

লোকালয় ছেড়ে যে পাখি উড়ে উড়ে পথ রচনা করে, তার ডানার পালকে কবি লিখে যাচ্ছে সমুদয় কীর্তিগাথা...। কবি কী শেষ পর্যন্ত কীর্তিগাথা লিখতে পারে কিংবা গূঢ় ভাষ্য। কবিতা সেই অব্যাখ্যেয় পঙ্ক্তি যার রহস্য ভেদ করা দুরূহ বিষয়। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি হর্ষ-বিষাদ, মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাওয়া অনুভূতি বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণ আমি ধরতে চেয়েছি কবিতার বাক্যে। প্রথম কৈশোরে ঈর্ষা ও বিষাদের যে বীজ আমার ভেতর বাসা বাঁধে, তা আমাকে ক্রমে ক্রমে নিঃসঙ্গ করে তোলে। এক অসহনীয় নৈশব্দ এসে আমার সমগ্র অস্তিত্বকে গ্রাস করে। কিন্তু পর মুহূর্তেই আমি আমার চার পাশের জগত এক অচেনা মোহ ভিন্নতর অর্থ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়া কুহকিনীর ইশারায় প্রলুব্ধ আমি ঘোরের ভেতর পতিত হই। দিকভ্রান্তি পথিক কবিতা-ই অন্বেষণ করি পথের দিশা। হয়ে ওঠি উপমা ব্যাকুল নেশাতুর মানুষ। কবিতার দুরারোগ্য ব্যাধি আমাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব চরাচরে আমি ধূলিকণা থেকেও অণুবিশেষ। কিন্তু আমার স্বপ্ন-আহ্লাদ সব কিছুকে অতিক্রম করে বিশ্ব চরাচরের অংশ হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার ক্লেদ ঘৃণা, অবজ্ঞা সংক্রামিত পরাজয় রক্তের ভেতর ধারণ করে আমি খুঁজি শব্দ অতুল, শব্দ ছবি, উপমা ও চিত্রকল্প। এই উপমা চিত্রকল্প ও অনুভূতিই কী কবিতার শেষ কথা? হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নদীর বাঁকে বাঁকে কত বীরত্বগাথা, জলমাতৃক ইতিহাস আমার ও আমাদেরও আছে। অশ্বখুরের ধূলো জলের ছোবলে আঘাত হানে কত আগ্রাসন কত উপনিবেশ। বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার উপস্থিতি নিতান্ত গৌণ। কবিকে কী শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি মানুষের পরিধির ভেতর আটকে রাখা যায়? তার আছে ইকারুশের ডানা। সমাজ, রাষ্ট্র, ঘর-সংসার পাওয়া না পাওয়ার দ্বৈরথে নিতান্ত সাধারণ মানুষ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে পৃথক অস্তিত্ব, পরমাণুর মতো ভূম-লকে ল-ভ- করে দিতে পারি। আমার হাতের তালুতে খেলে বিষধর ফণা তোলা সাপ। কবিতা এক অর্থে আমার ব্যর্থতা, পরাজয় ও বেদনামিশ্রিত আত্মগ্লানির ইতিহাস, লোকালয় থেকে দূরে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ এক প্রাচীন বটগাছ। কবিতা আর এক অর্থে অধরা সুন্দর স্বপ্নও বটে। তাই কবিতা না লিখে শান্তি নেই। ট্র্যাজেডি এই লিখেও শান্তি নেই। আত্মহননের অবিরাম খেলা...। ** বৃষ্টিসূত্র বৃষ্টি যেন আজও দ্রবীভূত করে পুরনো সম্পর্কের মতো। নদী মরে যায় বিলুপ্ত সেই আগ্রাসী ডানার স্পর্শে কত জনপদ, কত নগরের ধ্বংসস্তূপ অতল গহ্বর হারিয়ে গেল আজও তবু নদী-উপাখ্যানের গান প্রবাহিত হয় বৃষ্টির ফেনিল বুদবুদে মানুষের অন্তর্গত রক্তে জেগে থাকে স্মৃতির পরম্পরা। বৃষ্টির প্রবাহে নয়, থাকো পাখি বেষে হও নতজানু জানাও শত সহস্র প্রণতি জানবে কাকে বলে? নিষাদ পালক সংশয়তাড়িত গোপন সম্পর্ক দ্বিধা থরথর কাঁপে স্পর্শের মহিমা। ** মায়াকোভস্কি চাঁদ হিম প্রলোভন হয়ত জেগেছিল মত্ত রাতে নেশাতুর মায়াকোভস্কি চাঁদের গোপন ইশারায় কেবলই ঝিঁঝি পোকা একটানা ডেকে যায় রক্তে, স্নায়ুতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে জলস্রোতের খেলা। আর কেউ একজন বাঁশপাতার খচখচ স্বরে বেমালুম ভুলে যায় ফুলের আবেশ মাতাল গন্ধ মায়াকোভস্কি সে, অলীক ঘোড়া টিপে দিলে দ্রিম দ্রিম শব্দের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ে কুহক বেলায় চলন্ত রেল গাড়ির কোরাসে... শব্দের ঐক্যতান থেকে কিছু একটা বুঝে নিতে জীবনানন্দ মায়াকোভস্কির সাথে কথা বলতে বলতে তবে কী একটু ঝুঁকে পড়েছিল ট্রামলাইনে ঝিঁঝি পোকার গূঢ় মন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে ** জেলে ইচ্ছে টিয়ে পাখি জেল পাচিলে লেখো ইচ্ছেমত সঙ্কেত চিহ্ন এখানেও বৃষ্টি পড়ে বেড়ে ওঠে সবুজ শ্যাওলা বুনো ফুলের গন্ধ বাতাসে বয়ে যায় দূরে তোমারও নাকে এসে লাগে জলের ঘ্রাণ তুমি লেখো পাচিলে তার নাম অসঙ্কোচে, কাঠ কয়লা, ভাঙা সুরকিতে আঁকো ইচ্ছে টিয়ে পাখি। যাকে ভেবে এই দুঃসহ প্রাচীরের ভেতর তুমি অনায়াস তৈরি করে নিলে পাথর প্রতিমা জানালায় তার, রাতে নুয়ে পড়ে গন্ধরাজের শাখা... ** গাজা উপত্যকায় সাইরেন না বাজিয়ে অতর্কিতে পুড়ছে বসতবাড়ি শহরে জলের লাইন, জাতিসংঘের ত্রাণ শিবির রক্তের বিমূর্ত ছবি এঁকে স্কুলের ইউনিফর্ম স্টেশনের ওয়ার্নিং ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ার আগে আবারও শোনা যায় এ্যাম্বুলেন্সের আর্তি। বলো তো শোনা পাখি কেন ঘুম থেকে মৃত্যু থেকে এভাবে জেগে ওঠে আমাদের শিশু নিহত স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে ফুটো বেলুনের বেদনা বয়ে বেড়াবে, গড়াগড়ি যায় তার পুতুল লাটিমের ঘূর্ণি ভঙ্গিমা। জানালায় এক খ- লাল মেঘের মতো উড়তে থাকে গুলিতে শতচ্ছিন্ন দয়িতার বসন, ঠোঁটের তিরতির জায়নবাদী রাক্ষসদের কালো থলের ভেতর হারিয়ে যায় রূপকথার ঝুলি গাজা উপত্যকায়। ** স্বপ্নে ফিলিস্তিনী মুভি যদি মুভির শেষ দৃশ্যে মৃত্যু চিরতরে সিন আউট হয়ে যেতো যদি ডিকশনারি থেকে রক্তের কোনো প্রতিশব্দ না থাকে পৃথিবীর ভাষা-পরিম-লে। তাহলে শিশুগুলো রঙের হোলি খেলায় মেতে সুতো কাটা ঘুড়ি মুক্ত পাখি হয়ে যাবে। ইসরাইলের যুদ্ধ বিমানগুলো পোষমানা পায়ড়ার মতো হয়তো করবে খেলা নারী ও শিশুর কোমল হাতে ঈদে গাজা উপত্যকামুখর হবে আতশবাজির শব্দে... ধীরলয়ের মৃদু আবহ সঙ্গীতে ঘুমে ডুবে আমরা প্রত্যেকে ফিরে পাব ছেলেবেলার জংধরা চাবি সাইকেলের ধ্বনি, উপকূলে সমুদ্রে উজ্জ্বল চোখ। এমন একটা মুভি নির্মাণের স্বপ্ন দেখে শরাহত পাখি আহত নিহত হয় জনপদে জনপদে... ** হাওড় হাওড়ের জল ছুঁয়ে দেয় তরুণীর চুল প্রবঞ্চক বাতাসে হয় এলোমেলো দূর থেকে মনে হয় প্রতারণার শিকার গোপন আহ্বানে উড়ছে সঙ্কেত নিশান জল বাতাসে টলোমলো দোল খায় আজও দূরে বিন্দুর মতো কম্পমান নৌকা উন্মাদ স্রোত এসে ছোবল দিলে হাওড় জলে সমুদ্রের সাদৃশ্য ভেবে ভুল হয় ভাবো তবে, অসহায়ত্ব কাকে বলে, জল ঘুমে মাছে ঘাই মারে নাভিমূলে সাঁতার ক্লান্ত নাবিক শুয়ে আছে বালুতটে।
×