ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউল করিম খোকন

গল্প ॥ দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৮ জুলাই ২০১৭

গল্প ॥ দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা

(পূর্ব প্রকাশের পর) রেস্টুরেন্ট থেকে যখন হাসান রুমানাকে নিয়ে বেরোতে যাবে তখন হঠাৎ করে ব্যাংকের পরিচিত এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ‘সøামালেকুম স্যার, ভালো আছেন’? ‘ওয়ালাইকুম সালাম, কি খবর জিয়া সাহেব, এই বিকেলে লাঞ্চ করতে এসেছেন- খুব দেরি হয়ে গেলো না, না কি আপনি দেরিতে লাঞ্চ করেন? ‘নাহ স্যার, আমার এক বিজনেস পার্টনার আসবে এখানে জরুরী আলাপ আছে, বিকেলে সময় দিয়েছে, খুবই ব্যস্ত মানুষ রাতের ফ্লাইটে হংক যাবে, সময় খুব কম, তাই এসেছি তাড়াহুড়ো করে, কে জানে এসেছে কিনা, না কি আমাকে আবার কতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, বলেই লোকটা হন্তদন্ত হয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে যায়। এতোক্ষণ হাসানের খেয়াল হয় লোকটা রুমানাকে সঙ্গে দেখে কিছু বলেনি জানতে চায়নি কিছু। হয়তো বলতে পারতো ভাবীকে নিয়ে এসেছেন বুঝি ভাগ্যিস অতি ব্যস্ততার কারণে লোকটা হাসানের পাশে দাঁড়ানো রুমানাকে ততোটা খেয়াল করেনি। খেয়াল করলেও তেমন কিছু বলার সুযোগ পায়নি। তেমন কিছু বললে অথবা রুমানাকে তার বউ মনে করে থাকলে ওটা অস্বাভাবিক হতো না। ওরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি বলে মনে মনে হাঁফ ছাড়ে হাসান। রেস্টুরেন্টের দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নামে তারা দু’জন। পাশাপাশি হাঁটতে থাকে হাসান আর রুমানা। ‘লোকটা হয়তো ভেবেছে তুমি তোমার বউকে নিয়ে খেতে এসেছিলে, আমার দিকে ওভাবেই তাকিয়ে দেখছিল, খেয়াল করেছি, ‘বাহ তুমি তো অনেক কিছুই খেয়াল করো দেখি, লোকটা যদি ওরকম কিছু ভেবে থাকে তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ঢাকা শহরে মানুষজন কি আজকাল শুধু বউকে নিয়ে চাইনিজে কিংবা ফাস্ট ফুডের দোকানে নয়তো কফি শপে যায়, গার্ল ফ্রেন্ডদের নিয়েই বেশি যায় বুঝলে, আমাদের মতো মানুষের বউকে নিয়ে তেমন কোনো অকেশন ছাড়া চাইনিজে যাওয়ার ফুরসত কোথায়, সংসারের ঘানি টানতে টানতেই তো বেহাল অবস্থা’। কয়েক মিনিট পথ হাঁটতেই ধানম-ির অভিজাত এলাকার একটি বাড়ির সামনে পৌঁছে যায় তারা। রুমানা বলে, ‘এটাই হলো আমার ঠিকানা, আমার বাড়ি চলো ভেতরে যাই’। হাসান কিছুটা ইতস্তত ঃ করে। বাড়িতে হয়তো রুমানার হাসব্যান্ড নেই, ওর ছেলে আছে। কাজের লোকজন থাকতে পারে। এছাড়া শ্বশুর বাড়ির অন্য মানুষজনও তো থাকতে পারে। তারা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করতে পারে, হাসানের পরিচয় জানতে চাইতে পারে। রুমানা তাদের প্রশ্নের জবাবে কী বলবে, ভাবতে থাকে সে দ্রুত। হাসান বাড়ির ভেতরে যেতে কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে মনে মনে এটা বুঝতে পারে রুমানা। ‘কী ভাবছো, আরে ভয় নেই, কেউ কিছু জানতে চাইবে না, এতোক্ষণ ধরে রেস্টুরেন্টে বসে কতো গল্প করলাম, কতো কথা বললাম তখন তো কিছুই ভাবনি কোনো দ্বিধা সংকোচ তোমাকে জড়িয়ে ধরেনি এখন এতো ভাবছো কেন। রুমানার কথায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায় হাসান। ‘নাহ, আমি কিছু মনে করছি না, বাড়িতে তোমার হাসব্যান্ড নেই, এ সময়ে একজন অপরিচিত পুরুষকে সাথে নিয়ে তুমি বাড়িতে ঢুকছো কেউ যদি অন্য কিছু ভেবে বসে- ’ বলেই থেমে যায় সে। সরাসরি তাকায় রুমানার দিকে। আর্শ্চয রুমানাও তাকিয়ে আছে তার দিকে সারাসরি। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কেটে যায়। তারপর রুমানা হেসে ফেলে। ‘আমার কাছে কেউ যদি তোমার পরিচয় জানতে চায় তাহলে বলে দেবো সব কথা। তুমি আমার প্রথম জীবনের একান্ত আপনজন ছিলে সবাইকে বলবো; আচ্ছা তাতে কি তোমার কোনো সমস্যা হবে, তুমি কি তাতে বিপদে পড়বে’? হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে রুমানা হাসানের হাত ধরে ফেলে। তারপর অনেকটা টেনে নিয়ে চলে বাড়ির ভেতরের দিকে। এই প্রথম রুমানার হাতের স্পর্শ পেলেও পুলক বোধ করে না হাসান। বরং দারুণ বিব্রতবোধ করতে থাকে। রুমানা কোন পাগলামি শুরু করছে আজ। কেউ যদি দেখে ফেলে এ অবস্থায় তাদের দু’জনকে কি ভাববে কে জানে? নাহ ভেতরে যেতে যেতে কারও মুখোমুখি হয় না তারা। বিরাট এলাকা জুড়ে পুরনো মডেলের তিন তলা বাড়ি। অনেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে। ওখানে নতুন বিল্ডিং তৈরির আয়োজন শুরু হচ্ছে দেখে বোঝা যায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময় রুমানা বলে, ডেভেলপারদের কাছে পুরো বাড়িটাই বিক্রি করে দিয়েছি আমরা। এখানে বেশ কয়েকটি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং হবে। পাশের বিল্ডিংটা হয়ে গেলে আমরা ওখানে একটা ফ্ল্যাটে উঠে যাবো তখন এই পুরনো বিল্ডিংটা ভেঙ্গে নতুন বিল্ডিং তৈরি করা হবে। দোতলায় উঠে কলিং বেল টিপতেই ভেতরে টুংটং মিষ্টি সুর বাজতে থাকে। একসময় দরজা খুলে যায়। দশ এগারো বছরের সুন্দর মায়াময় চেহারার একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ভেতরে। রুমানাকে দেখে কিছুটা অভিমানী গলায় বলতে থাকে, ‘মা তুমি এতোক্ষণ দেরি করলে কেন? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে- তোমাকে কয়েকবার কলও করেছি, তুমি মোবাইল বন্ধ রেখেছিলে, কথাগুলো বলতে বলতে ছেলেটা হাসানের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। এতোক্ষণ কথা বলার সময় ওর মায়ের সঙ্গে আসা অপরিচিত মানুষটাকে খেয়াল করেনি সে। রুমানা তখন হাসানের দিকে তাকিয়ে হাসে। ‘এই হলো, আমার সাতরাজার ধন অনন্য। আমার প্রিয় সন্তান, আমার একমাত্র ছেলে; এরপর অনন্যের দিকে তাকিয়ে বলে,‘এটা হলো তোমার এক আংকেল। আমরা একসঙ্গে ভার্সিটিতে পড়তাম।’ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল অনেকদিন পর, তোমার কথা বললাম, তোমাকে দেখার জন্য চলে এসেছে। তোমার হাসান আংকেলকে ভেতরে যেতে বলবে না- ’ এবার ছেলেটা সহজ হয়ে ওঠে। হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে। অনন্য এসে হাসানের হাত ধরে তারপর ভেতরে ড্রয়িং রুমের দিকে নিয়ে যায়। ড্রংই রুমটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো- গোছানো। সব কিছুতেই রুচি এবং আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। হাসান মুগ্ধ হয়ে যায়। ‘বাহ, চমৎকার তো’, সোফায় বসতে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে সে। ‘কী?’ রুমানা প্রশ্ন করে। ‘তোমার ড্রয়িং রুমটা, খুব সুন্দরভাবে সাজিয়েছ, সব কিছুতেই যতœ আর রুচির ছাপ রয়েছে। ‘থ্যাংকস ফর ইয়্যুর কমপ্লিমেন্টস; তা এখন কী খাবে বলো’। ‘আবার কী খাবো, এতোক্ষণ খেয়ে দেয়ে এলাম’ ‘ওহ সেই খাওয়া তো এতোক্ষণে হজম হয়ে যাবার কথা, আমার জীবনের গল্প শুনতে শুনতে খেয়েছি, দীর্ঘ লম্বা চওড়া কাহিনী শুনতে শুনতে তো এমনিতেই ক্ষিদে লেগে যাবার কথা’ রসিকতার সুরে কথাগুলো বলে রুমানা। তারপর অনন্যকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরের দিকে চলে যায়। যাবার আগে নিজেই তৈরি করেছি শুধু তোমার জন্য, খেয়ে দেখো আমার হাতের রান্না; হাসান রুমানাদের ড্রইংরুমে বসে দ্রুত ভাবতে থাকে অনেক কথা। সত্যি রুমানা আজ অন্য ভুবনের বাসিন্দা। তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সিনেমা নাটকে দেখা কাহিনীর মতো বেশ নাটকীয়তাপূর্ণ। অল্পক্ষণ পরে একটা প্লেট নিয়ে ফিরে আসে রুমানা। প্লেট কয়েক পিস পুডিং দেখা যায়। ‘আমার হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ তো হলো না তোমার, হাসান তোমার জন্য স্পেশালভাবে এই পুডিংটা করেছি, খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে বলবে? রুমানার হাত থেকে পুডিং এর প্লেটটা নেয় হাসান। মুখোমুখি আরেকটা সোফায় বসে আছে রুমানা। বেশ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে সে। হাসান তার হাতের তৈরি পুডিং খেয়ে কী কমেন্ড করে তা জানার কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ছে তার চোখেমুখে। ‘পুডিং , কিন্তু আমার ভীষণ প্রিয় একটা খাবার, আগে তো কোনোদিন তোমাকে বলিনি তুমি জানলে কীভাবে? ‘আরে বাবা, তোমার মনের খুব কাছাকাছি ছিলাম তো একদিন, তুমি সব না খুলে বললেও আমি জেনে গেছি মনের টানে? ‘সেটা কীভাবে’? ‘বলতে পারবো না। এখন বলে টলে কী হবে? আচ্ছা তোমার বউ কি প্রায়ই তোমার জন্য পুডিং তৈরি করে? ‘হু করে, সেও খুব ভালো রান্না বান্না করে, নানা পদে নাস্তা তৈরি করে খাওয়াতে ওস্তাদ’। ‘তাহলে তো তুমি খুব ভালো একটা বউ পেয়েছো, যে তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে আর ভালো ভালো জিনিস রান্না করে খাওয়ায়,’ রুমানা হাসতে হাসতে বলে,‘ইয়্যু আর লাকি এনাফ’। প্রসঙ্গ পাল্টাতে হাসান বলে,‘আচ্ছা তুমি কি আগের মতো গান টান গাও, না কি অনেক ব্যস্ততা আর ঘর সংসারের কাজের চাপে গান ছেড়ে দিয়েছ’? ‘এখনও গান গাইতে মন চায়, কিন্তু আগের সেই মুড নেই, মাঝে মাঝে নিজে নিজে আনমনে গুনগুনিয়ে ওঠে মনটা এই পর্যন্তই। এর বেশি কিছু নয়। তবে আমি অবসবে গান শুনি। এখনও গান শুনতে খুব ভালো লাগে আমার। তোমার কী অবস্থা। আমি একসময়ে খুব গান শুনতাম, এখন তেমন সময় পাই না, অবসরে তো শুধুই লিখি, তারপরও সুযোগ পেলে গান শুনার পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারি না। ‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ কী জানো’? ‘কাউকে ক্ষমা করা, এর চেয়ে কঠিন কাজ মনে হয় আর কিছু নেই’ ‘এর চেয়ে সহজ কাজও বোধ হয় আর কিছু নেই আমার মনে হয়’। ‘আচ্ছা, রুমানা তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছ’? ‘এ কথা বলছো কেন’? ‘আমি জানি আমাকে ক্ষমা করে দিতে তোমার কষ্ট হবে, তবুও আমি বলবো, আমাকে ক্ষমা করে দিও। ‘ছিঃ ওভাবে বলছো কেন? আমি তো তোমাকে কোনোভাবেই দায়ী করি না, এটা নিয়তির খেলা, আমাদের ভাগ্যে এমনই লেখা ছিল, ভাগ্যের লিখন তো আর খ-ানো যায় না, আমাদের ওটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই’ ‘কিন্তু তারপরও আমি নিজেকে অপরাধী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না, আমার বুকের মধ্যে চেপে আছে সেই বোধটা যা আমাকে তাড়া করে ফিরছে, স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না’ ‘হাসান মন থেকে সব কিছু ঝেড়ে ফেলে দাও, আমি বলছি, তোমার কোনো অপরাধ নেই, ভাগ্য আমাদের আজ এভাবে নিয়ে এসেছে সেটা তো খারাপ কিছু নয়। আমি, তুমি- কেউ কি খারাপ আছি। আমি আমার সন্তান সংসার নিয়ে বেশ আছি। আমার নিজস্ব একটা ভুবন গড়ে উঠেছে যেখানে আমি চমৎকার জীবন যাপন করছি। তুমিও তোমার সংসার কর্মজীবন নিয়ে ভালো আছো, খুব ভালো বউ পেয়েছো, চাকরি বাকরি আর সংসার এর পাশাপাশি লেখালেখি করে যাচ্ছ। এ ক্ষেত্রেও বেশ সুনাম অর্জন করছো কোন অপূর্ণতা তো নেই তোমার আমার কারও মধ্যে, তাহলে লেখা কষ্ট অনুভব করার কোনো অর্থ হয় না। কথা বলতে বলতে বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। এসময় হাসান অনুভব করে এবার বাসায় ফেরা দরকার। রুমানা আজ ওকে অনেকক্ষণ সময় দিয়েছে। সন্ধ্যের পর বাজারে বেরোতে হবে। ক্যাটারিং সার্ভিস এর বড় একটি অর্ডার আছে। সে জন্য বাজার করতে হবে। রুমানাই বলেছে। রুমানার বাসা থেকে বেরিয়ে হাসানা যখন ধানম-ির দুই নম্বর রোডে তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। শহরের এই ব্যস্ত জনপদে এখন অনেক মানুষের ভিড়। অফিস ফেরত নারী-পুরুষ বাস ধরার জন্য লাইন ধরে আছে। একের পর এক বাস আসছে। আর তাতে যাত্রীরা উঠছে কিংবা নামছে। এখন বাসায় ফেরার জন্য হাসানকেও কোনো একটা বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। এখান থেকে ওর বাসাটা বেশ অনেকটা দূরে। বাসে না গেলেও সি এন জি নিয়ে যাওয়া যায়। হাসান বাস ধরার জন্য লাইনে না দাঁড়িয়ে হাঁটছে ফুটপাত ধরে। কয়েকটা খালি সি এন জি ট্যাক্সি পাশ দিয়ে চলে যায়। হাসান অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে। এখানে রুমানার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে দুপুরে তার মনের মধ্যে যে উত্তেজনা টগবগ করছিল তা এখন আর নেই। তার বদলে এখন তার মনে নতুন এক অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। না দেখা এক নারী রুমানা এতোদিন ধরে তার মনের গভীরে চাপা কৌতূহল হয়ে ছিলো। তাকে এক নজর দেখার জন্য তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য তীব্র এক আকাক্সক্ষা মনে বাসা বেঁধেছিলো। তার সেই আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছে। রুমানার মুখোমুখি হয়েছে হাসান। তার জীবনের অনেক অজানা কথা জেনেছে। রুমানাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে। অনেক বছর আগে যে রুমানাকে চিনেছিলো, জেনেছিলো শুধুমাত্র চিঠিপত্রে যোগাযোগের মাধ্যমে সেই রুমানা অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েছে, প্রতিকূল পরিস্থিতি আর দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে, বঞ্চনা আর প্রতারণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। সেদিন রুমানার ডাকে সাড়া দিতে পারেনি সে। তখন যদি রুমানার ডাকে সাড়া দিয়ে সব দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে ঢাকা এসে তার পাশে দাঁড়াতে, তার সব দুঃখ কষ্ট আর অসহায়ত্বের অংশীদার হতো তাহলে হয়তো রুমানার জীবনের ছকটা অন্যরকম হতো। এ জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবলেও রুমানা অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছে, মাথা তুলে সম্মানের সাথে জীবনযাপন করছে। সে এখন সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এবং সুখে আছে ভেবে হাসানের মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। এখন অন্য ভুবনের বাসিন্দা সে। আরেক সংসারের গৃহিণী। অন্য এক পুরুষের স্ত্রী। তারপরও রুমানাকে মনে হয় সরাতে পারে না সে। হৃদয়ের গহীনে ঠাঁই হয়ে গেছে তার। সেখান থেকে তাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয় কোনভাবেই। হাঁটতে হাঁটতে হাসান এলিফ্যান্ট রোডে চলে এসেছে কখন খেয়ালই হয় না। পাশে একটা মিউজিক শপে চমৎকার একটি গান বাজছে। কান পাতে হাসান। রেজাওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন ‘তুমি রবে নীরবে’। এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের এ গানটা হাসানের মনে তোলপাাড় জাগায়। রুমানার জন্য মনটা কেমন করে ওঠে। তখনই কিছুক্ষণ আগে বিদায়ের সময় রুমানার কথাগুলো মনে পড়ে যায়, ‘এখন আমি আরেক জন মানুষের স্ত্রী। আমার সংসার আছে স্বামী আছে, সন্তান আছে। আমার সংসারের ক্ষতি হোক এমন কিছু করতে পারি না। তোমাকে দেখার সাধ ছিল, সেটা পূরণ হয়েছে। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না, এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে যাওয়াটা অন্যায়। তোমারও সংসার আছে, বউ বাচ্চা আছে, তোমারও এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যেটা তোমার সংসার জীবনে অশান্তি বয়ে আনে, আমি তোমার সুখি জীবন কামনা করি। আজকের দিনটার কথা তোমার এবং আমার মনে থাকবে আজীবন। এরপর আমাদের আবার হয়তো দেখা হবে, ফোনে কথা হবে। কিন্তু আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকেই সম্পর্ক বজায় রাখবো। এর বাইরে আর কিছুই থাকবে না। সেটাই হবে দু’জনার জন্য মঙ্গল। হাঁটতে হাঁটতে আরও অনেকদূর চলে এসেছে হাসান। এখন আর গানটা শোনা যায় না। কিন্তু মনের মধ্যে তার অনুরণ বয়ে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হয় আকাশে চাঁদ উঠেছে। ঝলমলে জ্যোৎস্না নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। মিষ্টি নরম আলোর ছোঁয়া হাসানের মনটা ভরিয়ে দেয়। (শেষ)
×