ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল ইসলাম ঝড়ো

সমুখে শান্তি পারাবার...

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৮ জুলাই ২০১৭

সমুখে শান্তি পারাবার...

‘সমুখে শান্তি পারাবার’ হাসান আজিজুল হকের লেখা একটি গল্প, একটি দুর্যোগাক্রান্ত পরিবারের স্রেফ এক দিনের ঘটনাবলীর যোগ ও যোগফল। লেখক এ গল্পে বর্ণিত বাড়িটির ‘খাঁবাড়ি’ বা ‘সাহাবাড়ি’ এ রকম কোন নাম দেননি। পরিবারটিতে বসবাসকারী মানুষদেরও অকেজো জাত-পাত-বর্ণ-গোষ্ঠী-পরিচয় কেটে দিয়ে তাদের জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গল্পকার অত্যন্ত সচেতনভাবেই করেছেন এ কাজটি। কয়টি নাম লিখবেন, কয়জন মানুষের পরিচয় দেবেন তিনি? হিসাব-নিকাশের পর তাদের সংসারটি যে শ্রেণীতে পড়ে, সে শ্রেণীতে এরূপ পরিবার অনেক, এ ধরনের মানুষ অগণিত। একটুখানি ভিটামাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের মূল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, নিষ্ক্রিয় পিতার একমাত্র পুত্র কাজে-কর্মে স্ব-অধীন, এখন যাকে শখ করে ‘সেলফ্-এমপ্লয়েড’ বলা হয়। সে দূরের হাট থেকে একটু কম দামে ধান কিনে বাড়িতে চাল তৈরি করে পাশের গাঁয়ের হাটে বেচে। মা-বউ-বোন তার এই গোটা কর্মকা-ের অংশ বিশেষের সহযোগী, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। অনাহারী-অর্ধাহারী শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাওয়া পিতা ও দুধের শিশুটি শতভাগ এদের ওপর নির্ভরশীল। প্রায়শই প্রাকৃতিক বৈরীতাসহ নানা রকম অসদাচরণ কর্মক্ষম ব্যক্তিটিকে কর্ম থেকে সরিয়ে রাখে। পরিবারে ঢেলে দেয় অনতিক্রম্য অসহায়ত্ব। তাই বলা যায়, এ সংসারের গুটিকয়েক লোকের একদিনের চালচিত্র আসলে শত শত বছরের হাজার হাজার মানুষের জীবন-যাত্রার গড়রূপ। গল্পটি তাই হয়ে উঠেছে নিচু জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার তপ্ত বিবরণ। এদিক-ওদিক করে বলা যায়, এর মধ্যে চোখ ঢোকালে অনুভূত হয় বাস্তব জীবনের উত্তাপ। বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ-দুর্ভোগের খপ্পরে পড়ে মানুষ বিশেষ করে সহায়-সম্বলহীনেরা দিশাহারা হয়ে যায়। যন্ত্রণার পরিমাণ বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে গেলে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান থেকে নাম খসে যায়। যারা কোনমতে তালিকায় লটকে থাকে, তারাও ফসকে পড়ার ভয়ে চুপসে থাকে। তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, চোখে পড়ার মতো। গল্পকার বর্ষার টানা সাপোর্টে সৃষ্ট বিপর্যয়ে আয়-উপার্জন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন পুত্র ও পিতার কিছুক্ষণ ও কিছু কথা এঁকেছেন এভাবে- ‘... শেষ শ্রাবণের কালো আকাশ থেকে অনবরত বর্ষণ। আর তা না হলে টিপটিপ বৃষ্টি। খানিকক্ষণের জন্য যদি বা ধরে আসে, আবার ঝমঝমিয়ে তার উশুল। সাত দিনের দিন সকাল বেলায় বাপ-বেটা মুখোমুখি। এই ক’দিন একজন আর একজনকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। গোয়ালঘরের দাওয়ায় ছেলে এসে উঠে, ভিজতে ভিজতে একটা কুকুরও এসে একদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে কুঁই কুঁই করে দুঃখ প্রকাশ“করে। বাপ যেখানে ছিল সেখানেই বসে। গোয়ালের ভেতরে দু’তিনটি গরুর চখে প্রচুর পিঁচুটি। বাপ শুরু করে, শুয়োরের বাচ্চা, সাপের পাঁচ পা দেহিছো? বাপের হাত-পা শরীরের মধ্যে সেঁধুনো। ছেলেরও তাই। গরুর মতোই শরীরের চামড়া কাঁপিয়ে লেজ নেড়ে সে বলে, সাপের পাঁচ পা আবার কহন দ্যাখলাম? দেখলিনে? কি রহম? তুই আমার বাড়িথে বারোয়ে যা। হ, বারোয়ে যাচ্ছে? যা, বারোয়ে যা। হ। হ। অঃ-বাপ দাঁতের মাড়ি বের করে। অঃ-ছেলেও দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। এ নিছক এক দুস্থ পরিবারের পিতা ও পুত্রের কথোপকথন নয়। এ যে বিত্তহীন কর্মহীন মানুষদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী। অভাবি সংসারের অর্থের, সম্মানের, সবদিক দিয়েই পরাজয়ের ইতিহাস। এ ইতিহাস রচনায় কল্পনার মিশেল আছে, বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হয়। অনেকেই তাঁর মূল্যায়ন করেছেন, ‘গল্পে তিনি দারুণভাবে বিষয়-অনুগামী, বক্তব্যে কোন রাখঢাক নেই। ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা অনেক সময় কাহিনীকে গতি দিয়েছে।’ কিন্তু তাঁর উপস্থাপনায়ও যে আসাধারণ দক্ষতার প্রদর্শন রয়েছে তা নিঃসন্দেহ। তিনি যে আপন জনপদে বিচরণ করেছেন, চোখ-কান খোলা রেখে যদি সেখানে চলাফেরা করা যায়, তাহলে এ কথাগুলো শোনা যাবে, এ দৃশ্যগুলোও গোচরিভূত হবে। কিন্তু তাঁর তীক্ষè দৃষ্টির ফলায় অসহায় মানুষদের অবস্থা-অবস্থান, তাদের ব্যক্ত-অব্যক্ত চিন্তা, তাদের সোজা-সাপটা অথবা মনের পাঁকে আটকে যাওয়া কথা, তাদের ভেতর গেঁড়ে বসা বোধ-অনুভাব-অনুভূতি, অপ্রতিরোধ্য আবেগ-উৎকণ্ঠা যেভাবে গেঁথে উঠে আসে, এসে মনের মধ্যে ভাংচুর বাধায়, তা জীবন্ত হয়ে থাকে স্মৃতিশক্তির মৃত্যু ঘটা না পর্যন্ত। কী বিস্ময়কর শিল্পমান! তিনি যখন গুছিয়ে গুছিয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্য, কথার পিঠে কথা মেলে ধরেন, তখন চিন্তার ভেতরে নির্মিত হয়ে যায় নতুন বাঁক, যেখান থেকে সচেতনতা সৃষ্টির পথ দৃষ্ট হয়। কোন কোন স্থানে তাঁর রসময় বুদ্ধিদীপ্ত অভিব্যক্তি প্রচুর আনন্দের জোগান দেয়, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে উৎসাহিত ও অনুপাণিত করে। ‘আধ-মরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর’ জেদ প্রস্তুত হতে থাকে। ওই ছবি, ওই কথা, ওই বিত-া অভাবি মানুষের। হাসান আজিজুল হক যেন তাদের খুব কাছে দাঁড়িয়ে দেখছেন এসব। ‘গোয়ালের ভেতর দু’তিনটি গরুর চোখে প্রচণ্ড পিঁচুটি’, ‘গরুর মতোই শরীরের চামড়া কাঁপানো’, ‘উঠে বসতে সম্পূর্ণ অপারগ পিতার স্থবিরতা-নিষ্ক্রিয়তা’, ‘ভিজে জবজবা কুকুরের দুঃখ প্রকাশ’, ‘কলসিতে ধোঁয়া ঢোকে যেমন করে, তেমনি করে অন্ধকার ঢুকছে মাথার ভেতরে’-সবই দেখেন এবং দেখান হাসান স্যার। এই হলেন হাসান আজিজুল হক। এমন সব ছোট ছোট শিল্পের সমাবেশ ঘটিয়ে তিনি তাঁর গল্পের ভিত মজবুত করেছেন। কেবল বাইরের চোখ দিয়ে নয়, কাল ও ঘটনা সম্পর্কে অত্যধিক সচেতন ও স্পষ্ট এই লেখক বাইরের দৃষ্টি দিয়ে যেমন বিরাজমান অসহনীয় করুণ দুর্গতি লক্ষ্য করেছেন, তেমনি অতলভেদী অন্তর-দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন এবং বিচরিয়ে বের করতে সদা সচেষ্ট থেকেছেন নানা সঙ্কট ও অসঙ্গতির ভিত্তিভূমি। পরিণতিটাও যে দেখতে পাননি, তা নয়। বাপ আবার বলে, ... লজ্জা করতিছে না? না-লজ্জা কিসির? কাজ না পালি আমি কি করবানে? মরবা। আবার কি করবা? সে জন্যি কি চেষ্টা করতি হবে? দুদিন বাদে আপনিই চিত্তির হবা!... তবু গরিবেরা দুর্বলেরা নির্বংশ হয় না একেবারে। হাজার বছর ধরে শোষণ-বঞ্চনা-দুঃখ-কষ্টকে প্রতিদিন সঙ্গ দিয়ে টিকে আছে। এমনি দুঃখীদের, সমাজের কাছে তুচ্ছদের, ম্লানদের নানা পীড়ার কথা তাদের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। হ্যা, আমরা যেখানে দিনাতিপাত করছি, তা যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কোন্ এক দানব-শক্তি আমাদের হৃদয় থেকে আমাদের স্বজন ও পরস্পরের প্রতি স্নেহ প্রেম মায়া মমতা ভালবাসা সমবেদনা, এক কথায় যাকে আমরা মানবিকতা বলি, উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, কিন্তু জীবন থেকে সেসব পুরোপুরি মূলোৎপাটিত হতে পারে কি? পারে না। জীবন যতদিন থাকবে ততদিন এসব গুণাবলী ক্ষীণ পরিমাণে হলেও বেঁচে থাকবে। তাই পিতা বুঝতে পেরেছে গালাগালি দিয়ে লাভ তেমন কিছু নেই। এখনও সে ভরসা করে পুত্রের ওপরই, কোন যন্ত্র-তন্ত্রের ওপর করে কিছু হবে না, বোঝে। তাহলি এ্যাহন কি করা? ছেলেপিলেগুলো মরবে? মরলি আর কি করব? কাজ-কাম নেই দেখতেই তো পাচ্ছো। তা তুই সহ্য করতিছিস কি করে? দুধের বাচ্চা উপোস দেচ্ছে এই কি সহ্য করা যায়? বেঁচে থাকার সাঙ্ঘাতিক পণ থেকে মানুষ বাঁচার উপায় খুঁজে বেড়ায়। যখন তার সামনে প্রবলের দাপটে আয়-উপার্জনের সম্ভাব্য পথগুলো ভেঙ্গে ধসে যায়, তখন ভেতরের ক্ষুব্ধতা চেপে থাকে না। সোহাগ-ভালবাসা যেমন মানুষের সহজাত, তেমনি রাগ-ক্রোধও। বাপ দু’হাত মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে বলে, খাল কাটার কথা কি কচ্ছিস? কচ্ছি চুরি করে সব ফাঁকা করে দিচ্ছে তো! দিচ্ছে তো তোর কি? গরমেন্টের বিরুদ্ধে বলতিছিস্? গরমেন্ট তোর সাঙর ভেঙে দেবেনে দেহিস ক্যানো? আমার আবার সাঙর কোয়ানে যে ভাঙবে। আমার কথা ভারি শুনতিছে গরমেন্ট! গরমেন্টের বিরুদ্ধে বলতি নেই বাপ। সোনা আমার, জাদু! শুয়োরের বাচ্চা-বলবি তো মরবি। এখানে আহ্বান আর হুমকি, আদর আর অনাদর, রাগ-বিরাগের কী এক সাংঘর্ষিক অবস্থা! এ এক ভীষণ দ্বান্দ্বিক পর্ব। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তাদের পেটের চামড়া যখন পিঠের চামড়ার সঙ্গে মিশে যায়, সহ্য করতে না পেরে পিতা-পুত্র যুক্তি-বুদ্ধি করে পাঁচ শ’ টাকা নগদ নিয়ে আর পাঁচ শ’ বাকিতে দলিলে সই করে দেয়। এখন পিতা-পুত্র একবার লাফ দিয়ে আকাশে ওঠে, একবার সুর সুর করে পাতালে নামে। একবার হাতের মধ্যে দেখে সারা দুনিয়াটাকে, একবার দেখে শুধুই শূন্যতা। একবার হাসে, একবার বাপ-বেটা গলা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদে। পিতা ভাবে, ‘...স্রোত থাকলে খড়কুটো আবার কোন্ দিকে যায়? যেদিকে স্রোত সেই দিকেই তো! যেদিকে টাকা সেদিকেই জমি। এ তো সোজা আর ন্যায্য হিসাব। যেদিকে ঢালু সেদিকেই পানি গড়বে। আর জমি যার, কথা তার, বার্তা তার, মাল তার, মসলা তার, ভাত তার, কাপড় তার, থানা তার, পুলিশ তার, পুলিশের বাবা তার।’ পরের অংশটুকু আরও নির্মম। ওইদিন রাতেই সেই মহাজনের দুর্যোগ-শক্তির হাতে লুটপাট ও এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় ওই পাঁচ শ’ টাকা এবং বাড়ির সব সম্ভ্রম।
×