ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবু সুফিয়ান

অবিন্তার স্বপ্ন তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ জুলাই ২০১৭

অবিন্তার স্বপ্ন তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল

মর্মান্তিক, ভয়ঙ্কর ও রক্তস্নাত ঘটনার মধ্য দিয়ে অবিন্তা কবিরের নামটি আমরা প্রথম শুনি ২০১৬ সালের ১ জুলাই। সেদিন কয়েকজন তরুণ হিংস্র হায়নার মতো হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যে তা-ব চালিয়েছিল তাতে প্রাণ হারায় ২০ জন মানুষ। যাদের অধিকাংশই বিদেশী। তিনজন বাংলাদেশীর মধ্যে অবিন্তা কবিরও ছিলেন। মাত্র ১৯ বছরের এই তরুণী ছিলেন পরিশ্রমী, সাহসী ও মেধাবী। এই বয়সে একজনের চলে যাওয়াটা সত্যি দুঃখজনক। যে তরুণীর স্বপ্ন ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করা। পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও তার মন পড়ে থাকত ঢাকায়। সে মনে করত দারিদ্র্য বিমোচন ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সহায়তার জন্য কিছু করা উচিত। আর এই ধারণা ইচ্ছা সে পোষণ করেছিল খুব ছোট বয়স থেকে। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় নিহত হওয়ার পর খুঁজে পাওয়া যায় অবিন্তার একটি ডায়েরি। সেখানে তিনি লিখেছেন আমি মানুষের জন্য ভাবি এবং আমার লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করা। আমার বিশ্বাস, আজকের এই আমি, আমার সংস্কৃতি ও জাতীয়তার একটি অংশ। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল একটি দেশ এ দেশের জন্য কিছু করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। যদিও একটি এনজিও গড়া অতি সামান্য একটি পদক্ষেপ।’ আজ অবিন্তা নেই কিন্তু তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে। গড়ে তোলা হয়েছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের কাজ হচ্ছে অবিন্তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। আর এর মাধ্যমে গড়ে উঠবে হাজারো মানুষের জীবন। তাই অবিন্তার মৃত্যু নেই। চলতি বছরের মার্চে ঢাকার এক অভিজাত হোটেলের অনুষ্ঠানে এই ফাউন্ডেশনের উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে নিহতের পরিবারের সদস্য, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ‘অন ইনটিমেট পোট্রেট অব অবিন্তা কবির’ শিরোনামের একটি বই ও একটি ওয়েবসাইটও উন্মোচন করা হয়। অবিন্তার ছবি, হাতে লেখা কিছু নোট, মাকে লেখা চিঠি ও তাকে নিয়ে নির্মিত ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে অবিন্তার মা রুবা আহমেদ বলেন ‘তাকে হারানোর যে যন্ত্রণা তা কখনও বর্ণনা করা যাবে না। যারা এই সময়টা অতিক্রম করছেন তাই কেবল বলতে পারবেন আমরা কেমন সময় কাটিয়েছি। কতবার আমরা ভেঙ্গে পড়েছি।’ মেয়েকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন ‘তোমাকে নিয়ে চিন্তা করতে চমৎকার লাগে তবে তুমি ছাড়া বেঁচে থাকা খুব কঠিন। তুমি আমার আত্মার অংশ।’ রুবা আহমেদ আরও বলেন ‘তুমি চাইতে এমন কিছু হতে যেন তোমার মা গর্ববোধ করেন। তুমি তোমার মায়ের মতো হতে চাইতে। আমার মতো হতে পারা সহজ তবে তোমার মতো হওয়া কারও পক্ষে অসম্ভব। আমি একজন গর্বিত মা হয়ে এখানে দাঁড়িয়েছি।’ আর এই কারণে গর্বিত মা হিসেবে মেয়ের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। ছোটবেলা থেকেই অবিন্তা ছিল ব্যতিক্রমী। সে ছিল খুব মিশুক ও হাস্যোজ্জ্বল। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা মার সঙ্গে তাকে পাড়ি জমাতে হয় আমেরিকায়। শৈশব থেকেই সে ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছে। ফলে তার মধ্যে একটি আলাদা জগত তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অবিন্তা নিজের নিকটজন ও বন্ধুবান্ধবদের কথা ভাবার পাশাপাশি সে ভেবেছিল দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা। বিদেশের চাকচিক্যময় জীবন তাকে বাংলাদেশের মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যখন সে সেকেন্ড গ্রেডের ছাত্রী সেই সময় সে লিখেছিল, ‘আমি বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই, যেন শিশুদের সত্যিকার মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারি।’ কখনও তার মনে হয়েছে ডাক্তার হয়ে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবে। মোটকথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল বঞ্চিত, দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের সাহায্যে কিছু করা। বাংলাদেশে ফিরে হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর অবিন্তা বিভিন্ন সংস্থায় স্বেচ্ছামূলক কাজের দায়িত্ব পালন করেছিল। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে কাজ করেছেন। ফলে গ্রামের নারী ও শিশুদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় তার এবং এভাবেই সে নিজেকে যুক্ত করেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায়। বিদেশে পড়ার সময় ২০১৫ সালে ১৮ নবেম্বর সে লিখেছে ‘মনে হয় পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছে যারা হতভাগ্য এবং সুবিধাবঞ্চিত তাদের সাহায্য করার জন্য। তাদের সাহায্য করা আমাদের জীবনের ব্রত বলে মনে করি।’ ২০১৫ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর এক সেমিনারের জন্য লেখায় অবিন্তা বলেছে তার জীবনের মূল্যবোধের জন্য সে মায়ের কাছে ঋণী। তার মা তার জীবনের আদর্শ ব্যক্তি। মার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবার এগিয়ে আসর দায়িত্ববোধ জন্ম নেয় তার মধ্যে। আর এই কারণে অবিন্তার মা রুবা আহম্মেদ মেয়ের স্বপ্ন পূরণে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের জন্য কাজ করছেন নিরন্তর। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন অবিন্তা। গত বছরের জুনে ঢাকায় এসেছিলেন অবিন্তা। ১ জুলাই রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় প্রাণ হারায় এই তরুণী। অবিন্তা এলিগ্যান্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবা আহম্মেদ ও ইহসানুল কবীরের মেয়ে। মাত্র তিন বছর বয়সে অবিন্তাকে বাবা মার সঙ্গে প্রবাসী হতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সময় সে লিখেছিল, ‘আমি বিদেশে থাকি। আমার নানা-নানির কথা খুব মনে পড়ে। আমি প্রতি গ্রীষ্মে দেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হই। আমি যখন চলে আসি তখন আমার নানা-নানির মন খুব বিষণœœ হয়। আমারও খুব খারাপ লাগে। অবিন্তার নানা ল্যাভেন্ডর গ্রুপের মালিক মঞ্জুর মোরশেদ, নানি নিলু রওশন মুর্শেদ স্নেহময়ী এই নাতনির জন্য গড়ে তুলেছেন অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। দুই ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত আছেন মা রুবা আহম্মেদসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। গত ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রন্থাগারে অবিন্তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মরণে ‘অবিন্তা কবির সাইবার সেন্টার ও আর্কাইভ’ উদ্বোধন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এই সাইবার সেন্টারের উদ্বোধন করেন। ইতোমধ্যে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানীর ভাটারায় একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি স্কুল খোলা হয়েছে। নাটোরে এই ফাউন্ডেশনের আরও ৫টি স্কুল রয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর বাসাবোতে আরও একটি স্কুল খোলা হবে। এভাবেই বাস্তবায়িত হতে চলেছে অবিন্তা কবিরের স্বপ্ন। কিছু কিছু তা-ব বা হিংস্রতা মানুষের দেহকে ধ্বংস করতে পারে কিন্তু অবিনাশী সত্তাকে কখনও ধ্বংস করা যায় না। যেমন ঘটেছে অবিন্তার ক্ষেত্রে। আদর্শ এক মানুষ হিসেবে অবিন্তা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
×