ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আগামী নির্বাচনে লড়াই হবে কাদের মধ্যে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৮ জুলাই ২০১৭

আগামী নির্বাচনে লড়াই হবে কাদের মধ্যে?

সম্প্রতি আমাকে এক বন্ধু জিগ্যাসা করেছেন, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন মূলত কাদের মধ্যে হবে? দু’টি দলের মধ্যে, না দু’টি পক্ষের মধ্যে? এখানে দু’টি পক্ষ বলতে তিনি মতাদর্শিক পক্ষ বুঝিয়েছেন। যেমন, ব্রিটেনে এখন যদি কোনো নতুন নির্বাচন হয়, তাহলে তা মূলত হবে ব্রেক্সিটের পক্ষের ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে। আমেরিকায় পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে মূলত ট্রাম্পপন্থী ও বিরোধীদের মধ্যে। রিপাবলিকান দলের অনেক ভোটারও এবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। ভারতের রাজনীতিকে বিজেপি সরকার উগ্র হিন্দুত্ববাদকে প্রশ্রয় দিয়ে যতই বিভাজিত করে ফেলুক না কেন, দেশটির আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে মূলত হিন্দুত্ববাদ ও সেকুলারিজমের দুই পক্ষের মধ্যে। আমি বন্ধুকে বলেছি, বাংলাদেশেও আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার পক্ষের জোট এবং ধর্মনিরপেক্ষ জোটের মধ্যে। এই ধর্মনিরপেক্ষ জোট ভোট-রাজনীতির কৌশলগত কারণে কিছু নরমপন্থী ধর্মভিত্তিক দলের সমর্থন সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু মূলত যুদ্ধটা হবে সেকুলারিস্ট ও সেকুলারিজম-বিরোধী দুই পক্ষের মধ্যেই। পাকিস্তান আমলে যেমন দেখা গেছে, মুসলিম লীগের ধর্মভিত্তিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে হক-ভাসানীর নেতৃত্বে যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, তাতে তখনকার নেজামে ইসলামের মতো সাম্প্রদায়িক দলকেও গ্রহণ করা হয়েছিল। বর্তমানেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মহাজোট ক্ষমতায় রয়েছে এবং বিএনপির নেতৃত্বে যে কুড়ি বা একুশ দলীয় জোট প্রধান বিরোধী দল (সংসদের বাইরে) আছে, তাদের মতাদর্শিক চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামী জোটের চরিত্র অসাম্প্রদায়িক এবং বিএনপি জোটের চরিত্র সাম্প্রদায়িক। এই জোটে নামসর্বস্ব দু’একটি অসাম্প্রদায়িক দল আছে বটে (এবং বিএনপিও নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করে) কিন্তু এটিকে মূলত ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠীর জোটই বলা চলে। আগামী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত এই দুই পক্ষের মধ্যে। একটি সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরো দু’একটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। সেগুলো হবে ‘জিরো প্লাস জিরো, প্লাস জিরো ইকুয়ালটু জিরো’ হওয়ার মতো। এই সম্ভাব্য জিরো জোটগুলোর হিরো হলেন জেনারেল এরশাদ এবং ড. কামাল হোসেন প্রমুখ। সুবিধাবাদ ছাড়া জেনারেল এরশাদের আর কোনো নীতি ও আদর্শ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাহলেও বাহ্যত তিনি বিএনপির সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু এসে জুটেছেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতীয়তায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের মহাজোটে। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও সংবিধানের যতো ক্ষতি করে গেছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান, ততোটাই ক্ষতি করেছেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদ। গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুতির পর বিভিন্ন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলায় শাস্তি পাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য তিনি কখনো বিএনপি জোট, কখনো আওয়ামী জোটের আশ্রয় নিয়েছেন। তার দল এখন নামে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল, কাজে আওয়ামী লীগের ‘শয্যাসঙ্গী’। এখন একটি সাধারণ নির্বাচন সামনে আসতেই এরশাদ সাহেব আবার পুরনো চরিত্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজেই উদ্যোগী হয়ে একটি জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনো গণতান্ত্রিক ছোট দলকেও তিনি সঙ্গে পাবেন না এটা জেনে তিনি ‘বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো’ সাইনবোর্ডসর্বস্ব কিছু দল নিয়ে যে জোট গঠনের চেষ্টা করছেন, তার নাম নাকি হবে ‘ইসলামিক ঐক্যজোট’। এরশাদ সাহেব শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের অভ্যুত্থানের সময়ে হেফাজতিদেরও সমর্থন জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ বিএনপির মতো তিনিও ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসায়ে বিশ্বাসী। কিন্তু এই ব্যবসায়ের উপর একক দখলদারিত্ব এখন আর কারো নেই। ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা করার এই বেলুনটি ফুটো করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ পরবর্তীকালে হেফজাতিদের কাছে টেনে নিয়ে। হেফাজতিরা আওয়ামী লীগের কতোটা কাছে আসবে তা আমি জানি না, কিন্তু আওয়ামী লীগের এই হেফাজতি রাজনীতি বিএনপিকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি ছিল ক্যান্টনমেন্ট এবং জামায়াত (মস্ক এ্যান্ড মিলিটারি)। ক্যান্টনমেন্টের এই শক্তির ভিত্তিটা বিএনপির আগের মতো নেই। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দ-িত হওয়ায় এবং নির্বাচনে যোগ দেয়ার নিবন্ধিত পার্টি না থাকার দরুন বিপর্যস্ত জামায়াতও এখন বিএনপিকে আগের মতো শক্তি যোগাতে সক্ষম নয়। এই অবস্থায় যেসব নামকাওয়াস্তে ধর্মীয় ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল নিয়ে বিএনপি কুড়ি দলীয় জোট গঠন করেছে, তাকে ৪০ দলীয় জোট নাম দিলেও কোনো লাভ হবে না। বিএনপিকে অঘোষিত সাম্প্রদায়িক জোট নাম নিয়ে নিজের একার শক্তিতে (নেপথ্যে জামায়াত) নির্বাচনে লড়তে হবে। তবে তারাই হবেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটের প্রধান বিরোধী পক্ষ। ভাদ্র মাস এলে যেমন পুকুরে কই মাছ উজায়, বাংলাদেশে নির্বাচন এলে তেমনি কিছু রাজনৈতিক পুঁটি মাছও বাজারে আসর জমাতে চায়। ফখর-মইনুদ্দীনের এক-এগারোর সরকারের সময় একটি হোন্ডা পার্টি (সম্ভবত তখনকার সরকারের প্রশ্রয়ে) গঠিত হয়ে দেশে চমক সৃষ্টি করেছিল। এমনকি হাফ নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসও একটি আকাশচারী রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা দ্বারা দেশে কৌতুকের বন্যা বহায়েছিলেন। পরে তারা পলিটিক্যাল অরফ্যান বা রাজনৈতিক এতিম হিসেবে গণ্য হন। এই রাজনৈতিক এতিম নেতারা (যাদের দলে নিজেরা ছাড়া আর কেউ নেই) ২০০১ সালের মতো আবার আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এবার জোট গঠনের নামে ঘোট পাকানোর রাজনীতি শুরু করেছেন। এরা সকলেই সেই পুরনো মুখ। ড. কামাল, ডাঃ বদরুদ্দোজা, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না। এরা ধর্ম ব্যবসায়ী নন; গণতন্ত্র ব্যবসায়ী। গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ইত্যাদি ইত্যাদি রেটোরিক তাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। এদের শক্তির ভিত্তি একটি সুবিধাভোগী সুশীল সমাজ এবং একটি বর্ণচোরা ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়া গোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন আছে, ‘ভালো বলে আরো ভালো কোথা খুঁজে পাই’ তেমনি বাংলাদেশে যে দলটি নানা বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখে নাজুক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে, তার নানা দোষত্রুটি বের করে অনবরত ‘আরো অতি ভালো গণতন্ত্রের’ নামে এরা চিৎকার শুরু করেছেন। এই চিৎকার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের বিরোধিতা কার্যত গণতন্ত্রের বাহুতে শক্তি না জুগিয়ে সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক শিবির অর্থাৎ বিএনপি জোটকেই শক্তি জোগান। অতীতেও তারা তাই করেছেন। ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস প্রমুখের আওয়ামী লীগ বিদ্বেষ বিএনপি রাজনীতির অঘোষিত সমর্থকদের দলে তাদের ঠেলে দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তারা জোট গঠন করুন আর না করুন, এদের ভূমিকা হবে বিএনপি জোটের অক্সিলিয়ারি ফোর্সের। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে তাই বিএনপির বর্তমান বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে আত্মসন্তোষে ভুগলে চলবে না। আওয়ামী মাহজোটের শরিকেরা যত দুর্বল ও ছোট দল হোক, তাদের সঙ্গে ঐক্যকে ছোট করে দেখলে চলবে না। হেফাজতিরা সময় ও সুযোগ বুঝে ঘুরে দাঁড়াবে না এবং দংশন করতে চাইবে না, এই আশঙ্কা সম্পর্কে সতর্ক না থাকলে চলবে না। আওয়ামী লীগের ভেতরেও অনেক ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ আছে, তাদের সম্পর্কে সময় থাকতে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই, আগামী সাধারণ নির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে হবে না, হবে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মধ্যে। এক কথায় সেকুলারিজম ও এ্যান্টি সেকুলারিজম শিবিরের মধ্যে। এক্ষেত্রে সিপিবি, বাসদ প্রভৃতি দলকেও কাছে টানার জন্য আওয়ামী লীগকে চেষ্টা চালাতে হবে। সিপিবি এবং বাসদ প্রমুখ দলকেও বুঝতে হবে তারা যেন ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির মতো (সিপিআই ও সিপিএম) ভুল না করে। কংগ্রেস সরকার দুর্নীতিপরায়ণ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দিকে ঝুঁকেছে, প্রকৃত সেকুলারিস্ট দল আর নেই, ইত্যাদি অভিযোগ তুলে দিল্লীতে কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে এই বামপন্থীরা প্রকৃত সেকুলার ও গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় আনতে পারেনি। এনেছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে। এই ভুলটা যেন বাংলাদেশে বাম গণতান্ত্রিক শিবিরের কোনো দল আগামী নির্বাচনে না করে। বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের গড়ে না তোলা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বিরোধিতা করা হবে বাংলাদেশে বিএনপির বকলেসধারী জামায়াতের রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দরোজা খুলে দেয়া। ভারতে একটি সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীকে হটিয়ে জনতা পার্টি (তখনকার বিজেপি) এবং অন্যান্য ডান-বাম দলের সমর্থনে কট্টর ডানপন্থী মোরারজী দেশাইকে যখন ক্ষমতায় বসতে সাহায্য জোগান এককালের সমাজতন্ত্রী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, তখন তাকে উদ্দেশ করে বিখ্যাত কলামিস্ট খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন, ‘নারায়ণজী, আপনার রাজনৈতিক জীবনের চরম ভুলটি করলেন। ইন্দিরার পতনে ভারতে গণতন্ত্রের ভিত্তি পাকা হলো না, দুর্বল হলো।’ অতঃপর খুশবন্ত সিং মন্তব্য করেছেন, ‘ইন্দিরা ব্যক্তিগতভাবে স্বৈরাচারী। কিন্তু তার দল গণতন্ত্র ও সেকুলারিজমের দল। তাদের সরিয়ে আপনি যাদের ক্ষমতায় এনেছেন এদের চরিত্র কর্পোরেট ডিকটেটরশিপের এবং নীতি সেকুলারিজম বিরোধী। এই নীতি ভারতের চরম সর্বনাশ ঘটাবে।’ পরবর্তীকালে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রকাশ্যে তার এই ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশেও যারা আওয়ামী লীগের দোষত্রুটিগুলোকে বড় করে তুলে ধরে তার সর্বাত্মক বিরোধিতা করছেন, তাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ একটি ব্রড চার্চের মতো। এখানে শয়তান এবং ফেরেশতা দুইয়েরই অবস্থান আছে। এই ফেরেশতারা যাতে দলটির কর্তৃত্বে থাকে এবং সেকুলারিজম বিরোধী এবারের চরম সন্ধিক্ষণের যুদ্ধেও দলটি সফল নেতৃত্ব দিতে পারে, সে জন্য সহযোগিতা দানে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী পক্ষ পরাজিত হলে যেমন বাংলাদেশের ভাগ্য একশো বছরের জন্য অন্ধকারে তলিয়ে যেতো, তেমনি আগামী সাধারণ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট জয়ী না হয়, তাহলে আগামী ৫০ বছরের জন্য দেশটির ভাগ্যে ঘন কালো অন্ধকারের যুগ নেমে আসবে। এবারের লড়াই হবে সেকুলারিস্ট ও এ্যান্টি সেকুলারিস্ট শক্তি-শিবিরের মধ্যে। এই যুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধের মতোই নিরপেক্ষ ও মধ্যপন্থী থাকার কোনো সুযোগ নেই। [লন্ডন ২৭ জুলাই, বৃহস্পতিবার, ২০১৭
×