ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণের চেয়ে আমানত প্রবৃদ্ধি কম ॥ নতুন দুশ্চিন্তার বিষয়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৮ জুলাই ২০১৭

ঋণের চেয়ে আমানত প্রবৃদ্ধি কম ॥ নতুন দুশ্চিন্তার বিষয়

দুটো দৈনিক কাগজের তিনটি খবর আলোচনার দাবি রাখে। আলোচ্য দৈনিক দুটোর একটিতে বলা হয়েছে : ‘ব্যাংকে আমানত আসছে কম ঋণ যাচ্ছে বেশি।’ একই দৈনিকের আরেকটি খবর হচ্ছে : ‘৮০ ভাগ অর্থ পাচার বাণিজ্যের আড়ালে।’ দ্বিতীয় দৈনিকটির খবরে বলা হয়েছে : ‘অর্থ পাচারের উল্লেখযোগ্য অংশ অবৈধভাবে বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে।’ তিনটি খবরের মধ্যে শেষের দুটোর মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেখা যাচ্ছে পাচারের অর্থই বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে প্রথম খবরটি ব্যাংক আমানত ও ঋণ প্রবাহের ওপর। এতে বলা হচ্ছে আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে কম; কিন্তু ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশি। বলা বাহুল্য, তিনটি খবরই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংক আমানত ও ঋণের বিষয়টিই প্রথমে আলোচনা করা যাক। সংশ্লিষ্ট খবরটিতে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে আমানত বৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবেই হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৪ সালে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ হারে। আর ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত সময়ে আমানত বৃদ্ধির হার মাত্র ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। এই খবরটি কী ব্যাংকিং খাত অথবা অর্থনীতির জন্য সুখবর? নিশ্চয়ই নয়। আমানত বৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়া অর্থনীতির দুর্বলতার লক্ষণ। অধিকন্তু যখন খবর হয় যে, ঋণ প্রবাহের হার উক্ত সময়ে বেশ বেড়েছে তখন উদ্বেগ আরও বাড়ে। তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ হারে। সেই স্থলে ২০১৭ সালের মে মাসে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ হারে। ঘটনাক্রমে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির হার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্কলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবাহ বেশি হারে বাড়লে এক সময়ে ব্যাংকিং খাত বড় সমস্যার মধ্যে পড়বে। এই খাতটি পড়বে ‘লিক্যুইডিটি’ সঙ্কটে। অর্থাৎ টাকার টানাটানি পড়বে। আমানতকারীদের স্বার্থ হতে পারে বিঘিœত। অতএব, এই অবস্থা চলতে দিলে ভীষণ সমস্যায় পড়বে অর্থনীতি। সুতরাং দেখা দরকার কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হলো? আমানত বৃদ্ধির হারে শ্লথগতি কেন? প্রথম কারণ হতে পারে মানুষের আয়ে ছেদ পড়েছে। আয় আগের মতো বাড়ছে না। সঞ্চয় কমছে। মূল্যস্ফীতি মানুষের সঞ্চয়ে বাধা তৈরি করছে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে মানুষ তার সঞ্চয় নিয়ে ব্যাংকে যাচ্ছে না। কারণ ব্যাংক এখন কোন সুদ দেয় না। সঞ্চয়ী আমানতের সুদের হার মূল্যস্ফীতি থেকে ২-৩ শতাংশ কম। আর মেয়াদি আমানতেও সুদের হার মূল্যস্ফীতির হার থেকে কম। এমতাবস্থায় লোকজন ব্যাংকমুখী হচ্ছে কম। লিজিং ও ফিন্যান্স কোম্পানিগুলোর ‘এসএমএস’ থেকে বোঝা যাচ্ছে তাদের পোয়াবারো। এমনিতে সাধারণ লোকজন এসব কোম্পানিতে টাকা রাখতে চায় না। কিন্তু এখন ভিন্ন সময়। তাদের সুদের হার বেশ বেশি, উপরন্তু ব্যাংক কোন সুদ দেয় না। এ কারণে কিছু লোক এসব কোম্পানির দিকে ঝুঁকেও থাকতে পারে। আবার লোকজন ‘এমএলএম’ কোম্পানি, সমবায় ইত্যাদির দিকেও ঝুঁকে থাকতে পারে। এ অবৈধ ব্যাংক ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়। তারা এমনিতে মানুষকে প্রলোভিত করে ‘আমানত’ সংগ্রহ করে। বর্তমান মুহূর্তে তারা আরও বেশি প্রলোভনের কাজ করতে পারে। শেয়ার বাজারেও কিছু লোক ঝুঁকতে পারে। কিছু লোক থাকেই যারা সব সময় অর্থের সন্ধানে থাকে, ঝুঁকি থাকলেও। আবার এমনও হতে পারে ‘ক্যাশহোল্ডিং’ মানুষের বেড়ে গেছে। টাকা হাতেই রেখে দিচ্ছে- উপায়ন্তর না দেখে। আরেকটা কারণের কথা ব্যাংকাররা বলে, যা আমি বলি না। যেমন তারা বলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমানত হ্রাস পাচ্ছে। এ যুক্তি খাটে না। কারণ টাকা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকেই আশ্রয় নেয়। অবশ্য এই যুক্তি অনেক ক্ষেত্রেই খাটে। এমতাবস্থায় আয় হ্রাস ও সঞ্চয় হ্রাসের যুক্তি প্রবলতর হয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। কারণ যাই হোক, আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে কম হারে এটাই বাস্তব সত্য। এতে অসুবিধা ছিল না, যদি ঋণ প্রবাহ না বাড়ত। কিন্তু ঋণ প্রবাহের গতি ও হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে আমানত বৃদ্ধি ও ঋণ বৃদ্ধির মধ্যে তিন শতাংশ তফাৎ অর্থাৎ ঋণ বাড়ছে তিন শতাংশ বেশি হারে। এমতাবস্থায় বলা হচ্ছে এবার নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে। তা করুক, করলে পরে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু যদি আমানত বৃদ্ধি পায় ১১-১২ শতাংশ হারে আর ঋণ বৃদ্ধির টার্গেট হয় ১৬ শতাংশ হারে তাহলে তো এক সময়ে ‘লিক্যুইডিটি’ সঙ্কট দেখা দিতে পারে। বাজারে কথা আছে এখন অনেক ‘লিক্যুইডিটি’ ব্যাংকগুলোতে। কিন্তু এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। আমানতের চেয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি হতে থাকায় ‘অতিরিক্ত লিক্যুইডিটির’ পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এই অতিরিক্ত লিক্যুইডিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দায় আছে। সস্তা ঋণের কথা বলে বহু কোম্পানিকে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। নিজের দেশের ব্যাংকে অতিরিক্ত লিক্যুইডিটি, অথচ অনেক কোম্পানিকে বিদেশে ঋণ করতে অনুমতি দেয়া হলোÑ এর আসল যুক্তি কী তা একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকই বলতে পারবে। তবে আমার মনে হয় পুরো বিষয়টি ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। বিশেষ করে বর্তমান অবস্থা। এতদিন আমানতের কদর ছিল না। ব্যাংকাররা আমানতকারী দেখলে দৌড়ে পালায় এমন একটা অবস্থা। কিন্তু আগামীতে এই অবস্থা নাও থাকতে পারে। ঋণ প্রবাহ বাড়তে থাকলে, সরকার বাড়াতে চাইলে আমানত লাগবে। তখন নিঃসন্দেহে আমানতকারীদের কদর বাড়বে। তখন কী সুদের হার বাড়বে? আমি নিশ্চিত নই। ব্যাংকাররা যত সহজে ঋণের ওপর সুদের হার বাড়ায় তত সহজে আমানতের ওপর সুদের হার বাড়ায় না। আমানতকারীদের কদর ব্যাংকের কাছে খুবই সামান্য। তারা ঋণ গ্রহীতাকে ডেকে চা খাওয়ায়। ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, উপহার সামগ্রী তাদের জন্যই। সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্যই। ঋণের পুনঃ তফসিল, ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি, পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড ইত্যাদি সবই ঋণ গ্রহীতাদের জন্য। আর ঋণ গ্রহীতারা যদি খেলাপী অথবা সম্ভাব্য খেলাপী হয় তাহলে তো তার জামাই আদর, বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী হলে। কিন্তু আমানতকারীদের কদর ব্যাংকে কেমন? তাদের ‘ক্যাশ ডেস্ক’ থেকেই বিদায়। ক্যালেন্ডার, গিফট আইটেম ‘নৈবচ নৈবচ।’ এটাই বাস্তবতা। অতএব ব্যাংকের আসল বন্ধু আমানতকারীদের কদর ভবিষ্যতে বাড়বে এই আশা আমি বেশি করি না। অথচ আমানত ছাড়া ব্যাংকিং শুরু হয় না। আগে আমানত, পরে ঋণ। এক সময় তা ছিল না। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা নিজের টাকায় ব্যাংকিং ব্যবসা করতেন। সেটা ছিল মধ্যযুগীয় ব্যাংকিং। এখন আধুনিক ব্যাংকিং। আমানত তাই প্রথমে। ব্যাংকারদের শেখা উচিত কীভাবে আমানতকারীদের সম্মান দেখাতে হয়, কীভাবে তাদের যথাযথ পরিমাণ সুদ দিতে হয়। পরিশেষে টাকা পাচার সম্পর্কে দুটো কথা। বলা হয়েছে টাকা পাচার হয় ব্যবসার আড়ালে। অর্থাৎ আমদানি ও রফতানি ব্যবসার আড়ালে চলে টাকা পাচারের ঘটনা। এখন ব্যবসায়ীরাই বলছেন ওই পাচারের টাকা বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে কেউ কেউ বিদেশে কিছু বিনিয়োগ করছে। প্রশ্নটা সেখানে নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে একটা অবৈধ কাজ হচ্ছে, অতএব এটাকে বৈধ করা হোক। অবৈধভাবেই যেহেতু লোকেরা পাচার করা টাকা বিনিয়োগ করছে বিদেশে, অতএব বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হোক। জানি না শেষ পর্যন্ত সরকার কী করবে। তবে আলামত দেখে মনে হয় ব্যবসায়ীরা দিনে দিনে এই দাবি নিয়ে প্রবলতর হচ্ছেন। তারা অনেক সমর্থকও পেয়ে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে অনেক ব্যবসায়ী এখন ‘সাবালক’ হয়েছেন। তারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তারা বিদেশে বিনিয়োগের সামর্থ্য রাখেন। হয়ত তাই। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো রয়েছে। দেশে টাকা বিনিয়োগ না করে বিদেশে কেন? দ্বিতীয়ত দেশের ব্যবসায়ীরা বলেন পরিবেশ নেই বলে যদি বিদেশে বিনিয়োগ করতে চান তাহলে বিদেশী ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে কেন বিনিয়োগ করবেন? এই প্রশ্ন তো উঠবেই। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই তারপর ব্যবসায়ীদের দাবির প্রতি নজর দেয়া দরকার। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা খুবই প্রটেকটেড অবস্থায় ব্যবসা করছেন। তারা ‘নাদুস-নুদুস’ হয়েছেন সরকারের আনুকূল্য পেয়ে। বিদেশে কী তা তারা পাবেন? জানি না। এর পরেও কথা থাকে। যে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট আইন স্থগিত করাতে পারেন তারা বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েও যেতে পারেন। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×