ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার

পুনরাভিনয়ে পাঠাভিনয়

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৭ জুলাই ২০১৭

পুনরাভিনয়ে পাঠাভিনয়

রঙ্গালয় সত্যিই বিচিত্র রং এবং বেরঙের আলয়! আলেয়া কিংবা মরীচিকাকে জল ভেবে ভ্রম করে না যে নাট্য সমালোচক সে বিভ্রান্ত হতেই পারে সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার ঢেউ দেখে। উদ্বোধনী মঞ্চায়নের সময় একদল প্রচার পাচ্ছে দর্শকদের বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও টিকিট ফুরিয়ে যাওয়ায় টিকিট দিতে পারল না বলে। কিন্তু ওই দর্শক কি দেখে কি মনের অবস্থা নিয়ে বাড়ি ফিরল সে বিষয়ে খোঁজ নেই। অপরাপর দল বলছে, জ্ঞান নয়, বিশাল আয়োজন নয়, সিম্পলি আমরা বিনোদন দিতে এসেছি। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আয়োজন ব্যতিরেকে সত্যিই বিনোদন দান সম্ভব কিভাবে ভাবনায় প্রযোজনা দেখে দর্শক কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিন্তু আয়োজক দল নিজেরাই স্লোগান ছড়িয়ে দিতে পেরে আনন্দে ভরপুর। আরেক দল তো প্রদর্শনের আগেই মঞ্চ সফল কেননা শ্রমিক শ্রেণী থেকে অভিনেতা, এটাই সফল মঞ্চায়নের সারকথা। বিষয় থেকে বিষয়ের অনুষঙ্গই যখন বড় হয় তখন নাটক মঞ্চায়ন প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে নাটককে ঘিরেই কথা বার্তা এবং স্বঘোষিত সফলতা প্রাধান্য পাবে এটাই সত্য। এতদসত্ত্বেও ‘লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়’ কথা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যায় না। মিথ্যা হয়ে যায় না স্বাধীন বাংলাদেশে নাটকের ঐতিহ্যের মূল্যায়নের পরম্পরা। ৩৬টা বছর কর্মমুখর নাট্যচর্চা চালিয়ে নেওয়ার গর্বিত দাবিদার নাট্যব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল পথপ্রদর্শক লিয়াকত আলী লাকী এবং তাঁর লোক নাট্যদল আগামীকাল থেকে আয়োজিত দুদিনব্যাপী নাট্যোৎসবে তুলে ধরছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ষোলোটি ঐতিহ্যবাহী নাটকের নাট্য প্রদর্শনী। নাট্য প্রদর্শনী কিন্তু মঞ্চ-আলো কিংবা আবহের আড়ম্বনা নয়। প্রযোজনার প্রাণ ভ্রমরা যে অভিনয় সেই অভিনয়ের প্রদর্শন। মিনিট দশেকের দৈর্ঘ্যে দুই কিংবা তিনজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সমন্বয়ে আঙ্গিকে বাচিক, উপস্থাপনায় পাঠাভিনয় করবে ষোলোটি দল আগামী ২৮ ও ২৯ জুলাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। জীবনের কোলাহলে সবাই জানে ট্রয় নগরী ধ্বংস এবং লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মরবার জন্য দায়ী হলেন। কিন্তু লোক নাট্যদল দেখাবে, ইউরিপিডিসের সেই হেলেনকে যে সততা, সৌন্দর্য ও বিজ্ঞতায় বিশ্বের সকল নারীর থেকে শ্রেষ্ঠা ও অদ্বিতীয়া। ঢাকা থিয়েটার তুলে ধরবে মানিকগঞ্জের হরগজ নামক স্থানে টর্নেডোর আঘাতে ল-ভ- হয়ে যাওয়া মানুষের শোকগাঁথা। রাজশাহীর অনুশীলন নাট্যদল দেখাবে, প্রেম-মমতার স্পর্শে আত্মঘাতী হতে চাওয়া যুবকের ঘরে ফিরবার তাড়না। আরণ্যক দি জুবলী হোটেল কে ঘিরে দেখবে, প্রগতি কিভাবে থমকে গেল সে কথা। রংপুর নাট্যকেন্দ্র দেখাবে, মায়ের নবমূল্যায়নের নাটক মেরাজ ফকিরের মা। নাগরিক নাট্যাঙ্গন দেখাবে, প্রাচুর্য্য দিয়ে মানুষকে দাস করে রাখা যায় কিন্তু দাসীকে সরিয়ে দাসের মুখের হাসিকে আদায় করা যায় না। তারাশঙ্করের ডাইনি গল্পের ডাইনি না চাইলেও যেমন তার দৃষ্টি বানে দৃশ্যমান ব্যক্তি মারা যেত ঠিক তেমনি এক নারীর প্রেমে পড়লে প্রেমিকের করুণ মৃত্যুর ধারাবাহিকতা তুলে ধরবে মনিপুরি থিয়েটার। থিয়েটার দল দেখাবে, সাপ নিয়ে খেললে সাপুড়েকেও ছোবল খেতে হয় যেমনটার সাদৃশ্য মেলে নাটকে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। অন্যায় না করেও কেন নিয়তির শাস্তিভোগ করতে হয় সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে শিল্পকলা একাডেমির রেপার্টরি নাট্যদলের হ্যামলেট। বরিশালের শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার বধ্যভূমিতে শেষ দৃশ্য করে দেখাবে এক যুগলের প্রণয় গাঁথা। উত্তরাধিকার কি মমতার পরম্পরায় নাকি উইল পেপারের লিখিত নামায় সে উত্তর খুঁজবে সময় তাদের শেষ সংলাপ প্রযোজনায়। প্রয়োজন ফুরিয়েছে ভেবে অস্তিত্বের টানাপোড়েন করবে প্রাচ্যনাট দি জু স্টোরি উপস্থাপনায়। উপরে উঠবার সাধনায় কাম আর প্রেমের টানাপোড়েনের পরিণতির কথা বলবে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় তাদের নীলাখ্যান প্রযোজনায়। অভাব দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানুষের নাভিশ্বাস বেরিয়ে আসবার কথা বলবে নাট্যচক্র মৃত্যুক্ষুধা’য়। ঢাকা পদাতিক ৭১এ ফিরবে ভর করে কথা ৭১ এর ডানায়। ডালে বসলাম আর প্রেমে মজে গেলাম বিষয়টায় আপাত সুখ যতটা, অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার দীর্ঘমেয়াদী যন্ত্রণাও ততটা- একথা বলবে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় তাদের ওপেন কাপেল প্রযোজনায়। ষোলোটি প্রযোজনার আলোকে উদযাপিত পাঠাভিনয় উৎসবে উৎসারিত হবে সারা যাকের থেকে ত্রপা মজুমদার, কৃষ্টি হেফাজ থেকে জ্যোতি সিনহ্া, কিসলু থেকে আকতারুজ্জামানদের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীর কণ্ঠ মাধুর্যতা আর অভিনীত চরিত্রের মর্মমূলের মর্মকথা তবেই নাটকের অতীত ঐতিহ্যের পাশাপাশি আদৃত হবে নাটকের বর্তমান আধুনিকতা।
×